মশিউর রহমান:
জেনে আনন্দিত হয়েছি যে, সুপ্রীমকোর্টের বেশিরভাগ আইনজীবী, বিশেষত মুসলিম বীফ বা গরুর রান্না করা মাংস খেতে পছন্দ করেন! আমার পছন্দের জিনিস এত লোক পছন্দ করে তা আগে জানা ছিল না! সত্যি কি, মাংস বলতে আমি বীফকেই বুঝি! অন্য কিছু আমায় টানে না! মাসের তিরিশ দিন দিব্যি গরুর রান্না করা মাংস দিয়ে চালিয়ে দিতে পারি, এ আমি এখনি বাজি ধরতে পারি!
কিন্তু সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির কোন ক্যান্টিনে গত এক যুগে আমি কখনো গরুর রান্না করা মাংস খেয়েছি বলে জানা নেই! এমনকি অন্য কাউকে খেতেও দেখেনি! আজব বিষয় হচ্ছে, এ নিয়ে আমার কখনো কোন অনুযোগ ছিল না, এখনো নেই! এমনকি অন্য কাউকেও অনুযোগ করতে দেখিনি!
আমরা আদালতে কাজ করি বছরের ছয় মাস! সেহিসেবে মাসের পনের দিন! দিনের দুইবেলা বাসায় খাই, আর একবেলা আদালতের কেন্টিনে! আবার আদালতে যাওয়া সকলেই যে কেন্টিনে নিয়মিত একবেলা খায় তাও নয়! একটা অংশ!
শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, প্রকাশ পাকড়াশী, মোদারেস আলি, এস আর পাল এবং দীনেশ চন্দ্র রায়দের নিয়ে ১৯৪৮ সালে এ সমিতির শুরু! শেরে বাংলা এ সমিতি গড়ে তোলার কমবেশি আট নয় বছর আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন! গত ৭৩ বছরে শ’দেড়েক সভাপতি-সম্পাদকের মধ্যে ১ জন বাদে সকলের ছিলেন মুসলিম! ধর্ম বিবেচনায় মুসলিমরাই এ সমিতির অগ্রভাগে ছিল! এখনো আছে!
মুসলিমদের ধর্মমতে গরুর বিশেষ মর্যাদা থাকলেও গত তিহাত্তর বছরের ইতিহাসে সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির কেন্টিনে কোন দিন গরুর মাংস রান্না বা খাওয়া হয়েছে বলে জানা নেই! এর কারন কি? কেন তারা এত বছর এ ট্রেডিশন মেনে চলেছেন? অথবা আজকে এমন কি হল যে, বাপ-দাদার গড়ে তোলে ট্রেডিশনকে খারিজ করে দিতে হবে?
আমার অল্প বিবেচবায় বিষয়টি কেবলি গরুর রান্না করা মাংস খাওয়া না খাওয়ার নয়! ধরুন, আপনি আয়েস করে গরুর রান্না করা মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন আর আপনার পাশে বসা লোকটি তার ধর্ম মতে মনে করে গরুর রান্না করা মাংস খাওয়া হারাম! একইভাবে আপনি মনে করেন শুকরের মাংস খাওয়া হারাম অথচ একই টেবিলে বসে অন্যজন আয়েস করে তা দিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছে! অথবা ভাবুন, আপনি মুসলিম হয়ে সনাতন এক বন্ধুকে নিয়ে কেন্টিনে গেলেন! আপনি চাইলেন গরু আর সনাতন বন্ধু শুকর!
কেন্টিনে যারা বীফ খেতে চাইছেন, নিজেকে প্রশ্ন করুন, বাসায় গিয়ে নাবালক সন্তানের মুখের উপর ধোয়া ফুক দিয়ে জীবনে কয়বার সিগারেট খেয়েছেন? বাসায় হয়ত সিগারেট খেয়েছেন, বারান্দায়, টয়লেটে, বেলকনিতে বা অন্যরুমে বসে! একটু জায়গা বদল করে নেয়া আরকি! একইভাবে মাসের পনের দিনের একবেলায় বীফ না খেয়ে অন্য বেলায় বাসায় বা অন্য কোথাও খেলে কি এমন সমস্যা? সমিতির কেন্টিনে বসেই কেন খেতে হবে?
আবার এমনও নয়, সকল মুসলিম আইনজীবী কেন্টিনে নিয়মিত বীফ খেতে চাইছেন! শুধুমাত্র অল্পকিছু লোকের অতিরাজনীতির কারনে আজ এ তর্ক বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে!
আইনপেশা কিংবা অধিকার আদায়ের রাজনীতিতে আমাদের পুর্বসুরী যারা সারা জাতিকে পথ দেখিয়েছেন কাদের কারনে আজ তাদের পথ থেকে আমরা সরে যেতে চাই? কার দাবী এটি? কেন?
হালাল-হারাম, ধর্ম-বিধর্ম, উচিত-অনুচিত, স্বাদ-বিস্বাদ, তর্ক-বিতর্কের বাইরে আরো কিছু জিনিস আছে! মুল্যবোধ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান! আর অগ্রজের পথে হেটে চলা তো আইন পেশার উচ্চতম সোন্দর্য!
বিচারপ্রার্থীর জন্য যদি ভেবে-চিনতে আদালতে যুক্তি তোলে ধরতে পারেন নিজের জন্য কেন নয়?
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।