চন্দন কান্তি নাথ:
তদন্ত একটি ফৌজদারী মামলার প্রাণ। সুষ্ঠু তদন্ত হলে সুষ্ঠ বিচার হয়। আমলযোগ্য অপরাধ থানায় রেকর্ড হওয়ার সংগে সংগে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন ব্যতিত পুলিশ তদন্ত শুরু করে। যে ম্যাজিস্ট্রেটের ১৯০ধারার অধীনে আমল গ্রহনের ক্ষমতা আছে, সেই ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে এফআইআর এন্ট্রিপূর্বক পুলিশ মামলা তদন্ত করতে পারেন। (ধারা ১৫৬) আর যেখানে আমল যোগ্য অপরাধের সন্দেহ করা হয়, সেক্ষেত্রে সে থানার অফিসার ইনচার্জ (সার্কেল এএসপির মাধ্যমে) একটি রিপোর্ট অবশ্যই যে ম্যাজিস্ট্রেট আমল গ্রহণ করেন তার নিকট পাঠাবেন এবং দ্রুত নিজে অথবা তার অধিনস্ত একজন অফিসারকে ঘটনার বিষয়ে তদন্ত ও আসামী গ্রেফতার (যদি দরকার হয়) করতে পাঠাবেন। ঘটনা খুব ঘোরতর না হলে এবং তদন্ত করার মত গুরুত্বপূর্ণ নাহলে তিনি কাউকে পাঠাবেন না। না পাঠালে কেন পাঠালেন না তা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট অবশ্যই রিপোর্টে উল্লেখ করবেন। আর তদন্ত না করলে তথ্য প্রদানকারীকে অবশ্যই এর কারণ জানাবেন। আর ম্যাজিস্ট্রেট উক্ত রিপোর্ট পাওয়ার পর পুলিশকে তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা নিজে কিংবা কাউকে ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে ইনুকোয়ারী করার জন্য বলতে পারেন। (ধারা ১৫৭, ১৫৮, ১৫৯)
সিআর মামালার ক্ষেত্রেও ম্যাজিস্ট্রেট মামলা আমলে না নিয়ে ১৫৬(৩) অধীনে মামলা তদন্তের জন্য পাঠাতে পারেন অথবা ২০০ ধারার অধীনে জবানবন্দি গ্রহণে পুলিশকে প্রসেস স্থগিত রেখে তদন্তের জন্য পাঠাতে পারেন। ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে একজন পুলিশ সর্বদা ইনভেস্টিগেশন করে। আর ইনভেস্টিগেশন চলাকালীন পুলিশ কাউকে গ্রেফতারও করতে পারে। তবে আমাদের দেশে সিআর মামলার ক্ষেত্রে গ্রেফতারের বিষয়টি প্রচলন নেই। (ধারা ২০০, ২০১, ২০২)
পুলিশ অবশ্যই দ্রুত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করবেন। আরো সাক্ষী কিংবা সাক্ষ্য পেলে ফৌজদারী ১৭৩(৩বি) ধারা অনুসারে পুলিশ আদালতে তা রিপোর্ট দেওয়ার পরেও অধিকতর রিপোর্ট আকারে প্রদান করতে পারে। পিআরবির বিধান ২৭০ অনুসারে কোন একটি ঘটনা প্রমান করার জন্য যেটুকু সাক্ষী দরকার হয় তাদের জবানবন্দি নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হয়। অনর্থক অপ্রয়োজনীয় সাক্ষীকে রিপোর্টের অন্তর্ভুক্ত করে আদালতে পাঠানো উচিত নয়। পিআরবির ২৭২ (বি-১) বিধানে আছে, কোন মামলার দ্রব্য রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে রাসায়নিক পরীক্ষার রিপোর্ট লাভ করা পর্যন্ত অবশ্যই পুলিশ রিপোর্ট প্রেরণে বিলম্ব করা যাবেনা। তাতে আছে, ‘When a prima facie case is made out in a case in which articles have been sent for chemical analysis, the charge sheet shall not be delayed till receipt of the Chemical Examiner’s report.’
সর্বক্ষেত্রে পুলিশ ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭ (১) ও ১৬৯ এবং ১৭০ ধারা অনুসারে আগে তথ্য প্রমান সংগ্রহ করবেন এবং পরে গ্রেফতার করবেন। কিন্তুু অনেকের ধারনা গ্রেফতার না করে পুলিশ রিপোর্ট প্রদান করা যায়না। তবে এটি সঠিক নয়। পিআরবির ২৭২ বিধান অনুসাওে পুলিশ আসামী গ্রেফতার করতে পারুক বা পারুক অভিযোগ প্রমাণিত হলেই অবশ্যই সংগে সংগে দ্রুত রিপোর্ট প্রদান করবেন। ২৭২(এ) নং বিধানের ১নং লাইনে আছে, ‘(a) When an officer in-charge of a police station on completion of an investigation Under Chapter XIV, Code of Criminal Procedure, finds the charge proved and proposes to proceed against any person, he shall, notwithstanding that he has failed to arrest all or any of the persons against whom the charge is proved, at once submit a charge-sheet in B.P. From no 39, which is the report prescribed under section 173, code of criminal procedure, Thus a charge-sheet shall be submitted when the accused is absconding or is sent up for trial in custody or on bond (section 170, Code of Criminal Procedure).’ আর যেখানে আসামী পলাতক থাকবে সেখানে পুলিশ অবশ্যই পলাতকের সম্পত্তির একটি তালিকা প্রদান করবেন। যাতে করে সংশ্লিষ্ট আদালত সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ প্রদান করতে পারেন। ২৭২(এ) নং বিধানের ৩নং লাইনে আছে, ‘In cases where an accused is absconding, the investigating officer shall submit with the charge-sheet a list of the absconder’s property so that the court may issue attachment orders.’
পুলিশ অবশ্যই দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুুত করবেন। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘Whenever any person is arrested and detained in custody, and it appears that the investigation cannot be completed within the period of twenty-four hours fixed by section 61, and …forward the accused to such magistrate’ মাননীয় আপীল বিভাগের BLAST VS Bangladesh মামলায় আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য নীতিমালার দফা নং-৯ এ যাবলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধির ৬১ ধারা অনুযায়ী যখন কোনো ব্যক্তিকে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা তাঁর প্রতিবেদনে কেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে তদন্ত কার্যক্রম শেষ করা সম্ভব হয়নি, তা ১৬৭(১) ধারায় বর্ণনা করবেন। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ কেন সুনির্দিষ্ট বলে মনে করছেন, তাও উল্লেখ করতে হবে। কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট কেস ডায়েরি ও ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করবেন।” ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(১) ধারা অনুসারে ২৪ ঘন্টায় শেষ করতে না পারলে পিআরবির ২৬১(সি) এর প্রবিধান অনুসারে সর্বোচ্চ ১৫ পনের দিনের মধ্যে পুলিশ তদন্ত শেষ করবেন। তাছাড়া পুলিশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুসারে দ্রুত বিচারের নিমিত্তে প্রতিদিনই তাঁর তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। পি.আর.বি ২৬১(গ) এর (ক) তে বলা হয়েছে, “প্রবিধানের নির্দেশ সমূহ কড়াকড়িভাবে অনুসরণ করা হইলে সবচাইতে জটিল মামলার তদন্ত শেষ করতেও ১৫ দিনের বেশি লাগিবার কথা নহে।”
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৭২ (১) ধারায় বলা হয়েছে- 172. (1) Every police-officers making an investigation under this Chapter shall day by day enter his proceedings in the investigation in a diary setting forth the time at which the information reached him, the time at which he began and closed his investigation, the place or places visited by him, and a statement of the circumstances ascertained through his investigation. ফৌজদারী কার্যবিধি ১৭৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে “(1) Every investigation under this Chapter shall be completed without unnecessary delay, and, as soon as it is completed, the officer in charge of the police-station shall (a) forward to a Magistrate empowered to take cognizance of the offence on a police-report a report,..”
আর ম্যাজিস্ট্রেট দ্রুত তদন্তের জন্য প্রযোজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডারস বিধি ৭৫(২) এ বলা হয়েছে, The magistrate shall impress upon the police to complete investigation of an offence as expeditiously as possible and on no account, the period of detention in police custody shall exceed 15 days in the whole in a case.
পি.আর.বি ২১এ প্রবিধানে বলা হয়েছে,“21 (a) Except as provided in the Code of Criminal Procedure or…………… subordinate Magistrates have no power to interfere in police work. But Magistrates having jurisdiction and empowered to take cognizance of police cases are reminded of their responsibility for watching the course of police investigations in the manner laid down in Chapter XIV of the Code of Criminal Procedure.”
দ্রুত ও তদন্ত না হলে আসামী সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর দায়-দায়িত্ব তদন্তকারী কর্মকর্তার উপর পড়ে। এমনকি ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৭(৫) ধারা অনুসারে দ্রুত তদন্ত না হলে আসামী জামিন পেয়ে থাকেন। তাই ফৌজদারী কার্যবিধির অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ নিজেদের দায়িত্ব পালনকরলে তদন্তের সময় সীমা কমে আসবে এবং দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট প্রস্তুুত হলে দ্রুত বিচার অন্তে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৩) অনুযায়ী মানুষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে।
লেখক: সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, কুমিল্লা।