সিরাজ প্রামাণিক:
স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন। তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর আপনার ও আপনার পরিবারেকে শায়েস্তা করার জন্য তালাকের বিষয় গোপন করে থানা কিংবা কোর্টে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। ভাবছেন কি করবেন, কোথায় যাবেন, কিভাবে মিথ্যা মামলা থেকে পরিত্রাণ পাবেন। তালাক আপনার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবেন।
আপনি শুরুতেই মামলার কপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। যদি এমন হয় যে, আপনি জানতে পারলেন না আর হঠাৎ পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেল, তাহলে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে আদালতে প্রেরণ করা হবে। তখন আপনার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করুন। যদি দলিলপত্র ও সাক্ষ্যপ্রমাণ ঠিক থাকে, তাহলে মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই মিলবে। আর মামলাটি যদি থানায় হয়, তাহলে তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে তালাকের কপিসহ মিথ্যা মামলার ডকুমেন্টসগুলো প্রদান করুন। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে পারেন।
আর তদন্তকারী কর্মকর্তা যদি এ কাজটি না করে চার্জশীট দাখিল করেন, তাহলে আপনি বিচারিক আদালতে মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন কোন কারণে নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চাইতে পারেন। মনে রাখতে হবে, যদি থানায় মামলা না হয়ে আদালতে সি.আর বা পিটিশন মামলা দায়ের হয়, তাহলে আদালত সমন দিতে পারেন কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আদালতে একজন আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আগাম জামিন নিতে পারেন।
আপনার স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর পরিবারের কেউ আপনাকে ক্ষতিসাধনের ইচ্ছায় মিথ্যা যৌতুকের মামলা করেন কিংবা মামলা করাতে সহায়তা করলে, যিনি মিথ্যা মামলা করেছেন বা করতে সহযোগিতা করেছেন তারা প্রত্যেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। তবে এ মামলাটি করতে হবে যখন আপনি মিথ্যা মামলার দায় থেকে বেকসুর খালাস পাবেন। তারপর আদালতে আবেদনের মাধ্যমে মামলাটি করতে হবে। যৌতুক নিরোধ আইন ৬ ধারায় এ কথাগুলো স্পষ্ট করে বলা আছে।
মনে রাখবেন যৌতুকের অভিযোগে যে কেবল স্ত্রীই মামলা করতে পারবেন, তা নয়, স্ত্রী যদি আপনার কাছে যৌতুক দাবি করেন, আপনিও স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করতে পারেন।
এবার জেনে নিই তালাকের পর আপনার স্ত্রী যৌতুক মামলা করলে সে মামলার ফলাফল কি হবে। যৌতুকের অপরাধ প্রমাণ করতে হলে ঘটনার তারিখ থেকে এক বৎসর কাল সময়ের মধ্যে যৌতুকের মামলা করতে হয়। উক্ত সময় অতিক্রান্তের পর মামলা রুজু করলে তা সম্পূর্ণ বেআইনী হবে এবং ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৬১ (এ) ধারামতে বাতিল যোগ্য হবে। (১৬ বিএলডি, এডি, ১১৮)। সেকারণ তালাক প্রাপ্তির পর মামলা হলে বাদীপক্ষ থেকে মামলা প্রমাণ করা মুশকিল হয়ে পড়ে।
মনে রাখবেন দÐবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত হলে মিথ্যা অভিযোগকারী বা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে আপনি পাল্টা মামলা করতে পারেন। এছাড়া দণ্ডবিধির ১৯১ ও ১৯৩ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যদানের শাস্তির জন্য সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডসহ অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ আছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর ১৭ ধারায়ও মিথ্যা মামলা দায়েরের শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কারও ক্ষতি সাধনের উদ্দেশ্যে এই আইনের অন্য কোনো ধারায় মামলা করার জন্য আইনানুগ কারণ না জেনেও মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেন অথবা অভিযোগ করান, তবে সেই অভিযোগকারী অনধিক সাত বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কাজেই তালাকের পর আপনি যদি মিথ্যা মামলার শিকার হয়েই যান, তাহলে আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটি লড়ে যান। বিজয় আপনার অবশ্যাম্ভাবী।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।
Email: seraj.pramanik@gmail.com