মোঃ সাজিদুর রহমান :
লেখার শুরুতে একটি কাল্পনিক গল্প বলতে চাই- গল্পের একজন চরিত্র খায়রুল সাহেব, তিনি একজন সম্মানিত বাংলাদেশী নাগরিক। চাকুরি জীবন শেষ করে পেনশনের টাকায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি যে এলাকায় জমি কিনে থাকছেন সেই এলাকায় গল্পের আরেক চরিত্র কালা রকিবের বসবাস। কালা রকিব একজন দুষ্ট চরিত্রের ব্যক্তি। জবর দখল সহ সকল প্রকার দুষ্টু কাজে তার অংশগ্রহণ। এক সকালে কালা নিজে খায়রুল সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে খায়রুল সাহেবের কেনা জমি নিজের বলে দাবি করে। কালা রকিবের দাবি, এই জমি তার বাবার কেনা এবং সে পৈতৃক সূত্রে মালিক। কালা রকিব ১০ দিনের মাঝে জায়গা খালি করে দিতে বলে। অন্যথায় সে লোক দিয়ে খায়রুল সাহেবকে উচ্ছেদ করবে। কাল্পনিক হলেও গল্পটি আমাদের সমাজে ভিন্ন নামে ভিন্ন চরিত্রে অনেক অংশেই সঠিক।
‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’ এর তৃতীয় ভাগের মৌলিক অধিকার অংশের অনুচ্ছেদ-৩৬ অনুসারে প্রত্যেক নাগরিক যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করে যে-কোনো স্থানে বসবাস বা বসতি স্থাপন করতে পারে এবং সেই সাথে অনুচ্ছেদ-৪২ অনুসারে, প্রত্যেক নাগরিক আইন সম্মত ভাবে নিজে সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্য কোনো পন্থায় বিলিবন্টন করতে পারে।
এবার দেখা যাক এমন পরিস্থিতিতে একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে খায়রুল সাহেব কি করেন? প্রকৃত অর্থে এমন পরিস্থিতিতে খায়রুল সাহেব ৩টি কাজ করতে পারেন-
১) কাইলা রকিব জমিটি দখল করতে এলে তাকে বাধা দিয়ে তাড়িয়ে দিতে পারেন, যার অধিকার আইন তাকে দিয়েছে।
২) কালা রকিব কর্তৃক খায়রুল সাহেব উৎখাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। বেদখল হওয়ার পর আদালতে গিয়ে মামলা করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে আদালতের সিদ্ধান্ত নিজের পক্ষে পেলে পুনরায় জমিটি দখল করবেন।
অথবা, ৩) কালা রকিবের দুষ্ট কাজ থামিয়ে দেবার জন্য খায়রুল সাহেব আদালতে যেয়ে আদালতের সামনে পুরো ঘটনা উপস্থাপন করে নিজের স্বত্ব ও অধিকারের যাবতীয় দলিলাদি উপস্থাপন করে আদালতের তাৎক্ষণিক আশ্রয় প্রার্থনা করতে পারেন। ঘটনার সব অবস্থা বিবেচনা করে আদালত কালা রকিবকে ওই জমিতে প্রবেশ অধিকার নিষেধ করে আদেশ দিতে পারেন।
উপরোক্ত তিনটি পদক্ষেপের মধ্যে শেষোক্ত পদক্ষেপটি খায়রুল সাহেবের জন্য তুলনামূলকভাবে উত্তম। কারণ খায়রুল সাহেবকে কালা রকিবের জমি দখলের দুষ্টু কাজ নিরোধ করতে হবে অর্থাৎ প্রতিরোধ করতে হবে।
নিরোধ প্রতিকার সম্পর্কে বলা আছে ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের তৃতীয় খন্ডে। যেখানে নিরোধ প্রতিকার হলো এমন এক ধরনের প্রতিকার, যার মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু করা হতে বিরত থাকতে অথবা তার দ্বারা কৃত কোন অন্যায় কাজকে অপসারণ করতে বলা হয়। নিরোধমূলক প্রতিকার বা প্রতিরোধমূলক প্রতিকার দেবার ক্ষেত্রে, ‘ইনজাংশন’ বা ‘নিষেধাজ্ঞা’ হলো উত্তম পন্থা।
আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে খায়রুল সাহেবের ইনজাংশন বা নিষেধাজ্ঞা, যা বিবাদ শুরু হবার পূর্বে বা পরে অথবা বিবাদ নিয়ে মামলা চলাকালিন যে কোন পর্যায় বা মামলা শেষে রায় বা ডিক্রি হিসেবে প্রার্থনা করা যায়।
নিষেধাজ্ঞা বা ইনজাংশন সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আইনে উল্লেখ নেই। সাধারণত সকল কিছুর বিবেচনায় স্থিতাবস্থা (Status que) অর্থাৎ কোন বিষয় যেমন ছিল তেমন অবস্থা বজায় রাখবার জন্য আদালত তার সুবিবেচনামূলক ক্ষমতাবলে যে আদেশ প্রদান করে তাই ‘ইনজাংশন’ বা ‘নিষেধাজ্ঞা’ নামে আইনে বা সমাজে প্রচলিত। ১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৩য় খন্ডের (৫২ – ৫৭) ধারা পর্যন্ত ‘ইনজাংশন’ বা ‘নিষেধাজ্ঞা’ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা দেবার সময় কোনো পক্ষ অধিকার হিসেবে তা দাবি করতে পারে না। আদালত তার সুবিবেচনামূলক ইচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করে এমন নিষেধাজ্ঞার আবেদন মঞ্জুর করে থাকেন। এই সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে-‘’আদালতের ইচ্ছাধীন ক্ষমতা স্বেচ্ছাচারিতা নয়, বরং তা হল নিখুঁত ও যুক্তিসঙ্গত, বিচার বিভাগীয় মূলনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং আপীল আদালতের দ্বারা সংশোধনযোগ্য।‘’ সকল কিছুর বিবেচনায় নিষেধাজ্ঞা সাধারণত ৩ ধরণের হতে পারে – ১.অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা/Temporary Injunction ২.চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা/Perpetual Injunction এবং ৩.বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা/Mandatory Injunction.
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা/Temporary Injunction-
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৩ ধারায় অস্থায়ী এবং চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। যেখানে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে- ‘’অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বা অস্থায়ী ইনজাংশন হলো এমনতর ইনজাংশন, যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অথবা আদালতের পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কার্যকর থাকে। মামলার যে কোন অবস্থায় তা মঞ্জুর করা যায় এবং দেওয়ানী কার্যবিধি দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়‘’। সাধারণত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আদালত মামলার যে কোন পর্যায়ে মঞ্জুর করতে পারেন এবং ১৯০৮ সালের দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৯ আদেশ দ্বারা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার যাবতীয় বিধান নিয়ন্ত্রিত হয়।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য হলো মোকদ্দমা দায়ের থেকে শুরু করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত মামলার বিষয়বস্তুর স্থিতাবস্থা (Status que) বজায় রাখা এবং মোকদ্দমার বিষয়বস্তুর কোন প্রকার ধ্বংস, নষ্ট, ক্ষতি, অপচয়, হস্তান্তর, অপসারণ অথবা আকৃতি প্রকৃতির পরিবর্তন রোধ করা যেন মামলায় প্রদত্ত আদালতের কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়।
দেওয়ানী কার্যবিধির ৩৯ আদেশের বিধি-১ বা বিধি-২ অনুসারে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার পিটিশন দাখিল করতে হয়।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রার্থনার সময় আবেদনকারীকে কিছু বিষয় প্রমাণ করতে হবে –
(১) আবেদনকারীকে অবশ্যই (Prima facie case) প্রমাণ করতে হবে। সংক্ষেপে বলতে গেলে মামলার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে।
(২) আবেদনকারী আদালতকে এই মর্মে সন্তুষ্ট করবে যে অস্থায়ী নিষেধজ্ঞার আবেদন গ্রহণ করা না হলে অপূরণীয় ক্ষতি (Irreparable loss) হবার সম্ভাবনা আছে। যেখানে অপূরণীয় ক্ষতি বলতে সেই ক্ষতিকে বুঝাবে যা অর্থ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।
(৩) অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন গ্রহণ করার ক্ষেরে আদালত (The balance of convenience and inconvenience of the Parties) বিবেচনা করেন। তাই আবেদনকারীকে সুবিধা এবং অসুবিধার ভারসাম্য আদালতে উপস্থাপন করতে হবে।
(৪) জনস্বার্থে আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদন করা যায়। যা সাধারণত সরকারের বিপক্ষে করা হয়। সেই ক্ষেত্রে জনস্বার্থ (Public interest) বিষয়টি কার্যকর ভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
৩৯ আদেশের বিধি-১ অনুসারে আদালত স্থাবর বা অস্থাবর উভয় ক্ষেত্রে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ প্রদান করতে পারেন। অন্যদিকে ৩৯ আদেশের বিধি-২(১) এর অধীন শুধুমাত্র চুক্তি ভঙ্গ (Breach of contract) বা ক্ষতি সাধন (The commission of an injury) করা হতে বিরত রাখতে আদালত অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করেন।
অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা যদি গ্রহণ করা হয় এবং সে সাথে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে আদালত ৩৯ আদেশের বিধি-২(৩) আনুসারে অমান্যকারীর সম্পত্তি ক্রোক অথবা উক্ত অমান্যকারীকে ৬ মাস দেওয়ানী কারাবাসে আটক অথবা উভয় প্রকার দণ্ড প্রদান করতে পারেন। এই ক্রোকের মেয়াদকাল আবার কখনোই ১ বছরের বেশী সময় বলবৎ থাকবে না, বিধি-২(৪) অনুসারে।
নিষেধাজ্ঞা প্রদানের আগে ৩৯ আদেশের বিধি-৩ অনুসারে আদালত অপর পক্ষকে নোটিশ প্রদান করতে বলবেন যা বাধ্যতামূলক। এবং বিধি-৩ক ’তে বলা আছে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আবেদনকারী পক্ষ অপর পক্ষকে নোটিশ দিলে, উক্ত নোটিশ বিনা জারিতে ফেরত আসলে, আবেদনকারীকে নোটিশ ফেরত আসার ৭ দিনের মাঝে আবার নোটিশ প্রদান করতে হবে।
বিধি-৫ অনুসারে কোন কর্পোরেশনের বা অফিসের উপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলে তা উহার কর্মকর্তাদের উপর বাধ্যতামূলক ভাবে কার্যকর হয়। বিধি-৫ক ‘তে বলা আছে অতি জরুরি বিষয় ছাড়া সরকারের বিপক্ষে এক-তরফা অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা যাবে না।
সকল কিছুর বিবেচনায় ৩৯ আদেশের বিধি-৪ অনুসারে আদালত যে কোন সময় অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশ পরিবর্তন বা বাতিল করতে পারেন। সেই সাথে বিধি-৫ক(৪) আরো বলে কেউ যদি মিথ্যা বা প্রতারণামূলক ভাবে আদালত হতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা নিজের পক্ষে গ্রহণ করে, তবে আদালত তাকে ক্ষতিপূরণমূলক ১০,০০০/- টাকা পর্যন্ত খরচের আদেশ প্রদান করতে পারেন। এবং পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় ৩৯ আদেশের (৬-১০) বিধিতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের আরো কিছু নিয়ম নীতি উল্লেখ করা আছে।
আবার যখন ৩৯ আদেশের বিধি-১ এবং বিধি-২ অনুসারে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা যখন মঞ্জুর করা যায় না সেই ক্ষেত্রে আদালত উক্ত কার্যবিধির ১৫১ ধারা অনুসারে অন্তর্নিহিত ক্ষমতা (Saving of inherent powers of Court) প্রয়োগ করে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে আবেদনকারীকে প্রমাণ করতে হবে যে, অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা না হলে তার অপূরণীয় ক্ষতি হবে। এই ক্ষেত্রে এই নিষেধাজ্ঞাকে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা না বলে ১৫১ ধারার নিষেধাজ্ঞা বলা হয়।
চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা/Perpetual Injunction-
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৩ ধারায় Perpetual Injunction/চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে- ‘’চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র শুনানির পর মামলার গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত ডিক্রি দ্বারাই মঞ্জুর করা যায়। তার দ্বারা প্রতিবাদীকে চিরস্থায়ীভাবে এমন একটি অধিকার প্রয়োগ হতে অথবা এমন একটি কাজ করা হতে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়, যা বাদীর অধিকারের বিপরীতে হতে পারে’’।
সাধারণ কথায় বলা যায়, যে নিষেধাজ্ঞা মোকদ্দমা শেষ হবার পর মামলার গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে ডিক্রির মাধ্যমে মঞ্জুর করা হয় তাকে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলে।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ দ্বারা চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার যাবতীয় বিধান নিয়ন্ত্রিত হয়। ‘Perpetual injunction when granted’ শিরোনামে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৪ ধারায় চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ৫৪ ধারায় বলা আছে, আবেদনকারী যদি বিরোধীয় বিষয়বস্তুতে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং সেই সাথে নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করে তবে শুনানি শেষে আদালত তার বিবেচনামূলক স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে সন্তুষ্টচিত্তে ৫টি ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন। চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করার সময় আদালত আবেদনকারীর কার্যাবলী এবং সেই সাথে আবেদনকারী ও বিবাদীর প্রতিকারের মধ্যে ভারসাম্য (The balance of remedies) লক্ষ্য রাখেন। এই সকল বিষয় সম্পর্কে এই ৫৪ ধারাতে ১টি ব্যাখ্যা সহ ২৬টি উদাহরণ দেয়া হয়েছে।
৫৪ ধারায় যে ৫টি বিষয়ে আদালত চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন-
(১) যেখানে বিবাদী আবেদনকারীর সম্পত্তির জিম্মাদার। জিম্মাদার বলতে কাদের বুঝাবে সে সম্পর্কে এই আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, জিম্মাদার এমন ব্যক্তিকে বুঝাবে যার উপর বিশ্বাস পূর্বক মালিকানা ন্যস্ত করা হয়েছে।
(২) যেখানে অধিকার লঙ্গনের ফলে কৃত ক্ষতি অথবা সম্ভাব্য ক্ষতি নিরূপণের কোন মানদণ্ড নাই।
(৩) যেখানে অধিকার লংঘন এমন যে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পর্যাপ্ত প্রতিকার হবে না অর্থাৎ আর্থিক ক্ষতিপূরণের অপর্যাপ্ততা।
(৪) যেখানে এমন হস্তক্ষেপের ফলে আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না অর্থাৎ আর্থিক ক্ষতিপূরণের অনিশ্চয়তা।
এবং (৫) To prevent a multiplicity of Judicial proceedings অর্থাৎ বিচারিক কার্যক্রমের সংখ্যাধিক্য রোধের জন্য।
চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা কেউ অধিকার হিসেবে দাবি করতে পারবে না। সেই সাথে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৪ ধারায় চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে যে সকল বাধ্যবাধকতা রয়েছে তা যদি চুক্তি থেকে সৃষ্ট হয়ে তবে আদালত এই আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের (১২ থেকে ৩০) ধারার বিধানাবলী অনুসারে তা নিষ্পত্তি করবেন।
চিরস্থায়ী মোকদ্দমা দায়েরে তামাদি মেয়াদ ৬ বৎসর। মোকদ্দমা দায়েরে কারণ উৎপত্তির তারিখ হতে ৬ বৎসরের মাঝে মামলা দায়ের করতে হবে। সেইসাথে ‘ট্রেডমার্ক’ ৫৪ ধারা অনুসারে সম্পত্তি বলে গণ্য হয়।
বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা/Mandatory Injunction-
কোন ব্যক্তি কোন কাজ করতে আইনগত ভাবে বাধ্য থাকা শর্তেও তা করা থেকে বিরত থাকলে আদালত তাকে কাজটি সম্পাদন করতে বাধ্য করে তথা কোন বাধ্যবাধকতা ভঙ্গ রোধ করার জন্য নির্দিষ্ট কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে যে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে তা বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা নামে পরিচিত। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৫ ধারায় এই সম্পর্কে বলা হয়েছে।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ৫৫ ধারা উল্লেখ করে- ‘’যখন একটি বাধ্যবাধকতা ভঙ্গ করাকে রোধ করার জন্য এমন নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করতে বাধ্য করা আবশ্যক হয়, এবং আদালত তা কার্যকরী করার যোগ্য হয়, তখন আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতা অনুসারে, যে চুক্তি ভঙ্গ করার আভিযোগ করা হয়েছে তা রোধ করা এবং সেই সাথে প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদনে বাধ্য করিবার জন্য ইনজাংশন মঞ্জুর করতে পারে’’। সেই সাথে এই ধারায় (ক থেকে ছ) পর্যন্ত ৭টি উদাহরণ দেয়া আছে।
আইনের ৫৩ এবং ৫৪ ধারার অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা এবং চিরস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা হলো ‘নিষেধমূলক’ প্রতিকার কারণ এখানে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কোন পক্ষকে কোন কাজ করতে বিরত রাখা হয়। কিন্তু ৫৫ ধারার বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা নিষেধমূলক প্রতিকার না বরং ‘আদেশাত্নক’ প্রতিকার।
বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে কোন ব্যক্তিকে সে যে কাজ করতে বাধ্য তাকে তা করতে আদেশ দেয়া হয়। সে জন্য ৫৫ ধারার বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা আদালতে প্রার্থনা করা হলে আদালত তার বিবেচনামূলক স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতাবলে সন্তুষ্টচিত্তে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে মঞ্জুর করে থাকেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে- গল্পের খায়রুল সাহেবের সেই বাড়ির প্রবেশ মুখে দুষ্টু লোক কাইলা রকিব যদি জোড়পূর্বক দেয়াল তুলে দেয় যা খায়রুল সাহেবের জন্য বাড়িতে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে। সেই ক্ষেত্রে খায়রুল সাহেব তাৎক্ষনিক আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ৫৫ ধারার বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করতে পারে। যেখানে আদালত কালা রকিবের দেয়াল তুলার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করবে না বরং দেয়াল ভেঙ্গে ফেলার আদেশ প্রদান করবেন। তবে খায়রুল সাহেব বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞা অধিকার হিসেবে প্রার্থনা করতে পারবে না।
তামাদি আইন; ১৯০৮ এর প্রথম তফসিলের এর অনুচ্ছেদ-১২০ অনুসারে বাধ্যতামূলক নিষেধাজ্ঞার মামলা দায়েরের তামাদি মেয়াদ ৬ বৎসর।
নিষেধাজ্ঞার আরো কিছু আইনি বিস্তার-
নিষেধাজ্ঞার আরো একটি ধারণা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনে ৫৭ ধারায় বলা আছে। যার শিরোনাম ‘’নেতিবাচক চুক্তি পালন সম্পাদন করার জন্য নিষেধাজ্ঞা (Injunction to perform negative agreement)’’। এই ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় একটি চুক্তিতে হাঁ-সূচক এবং না-সূচক অংশ থাকলে, আদালত হা-সূচক অংশ সুনির্দিষ্ট ভাবে কার্যকর করতে না পারলেও না-সূচক অংশের জন্য নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- আমাদের উপরের গল্পের শেষ চরিত্র মিস রাখী যিনি একজন স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী। তিনি কালা রকিবের সাথে এই মর্মে চুক্তি করেন যে, সে ১২ মাসের জন্য কালা রকিবের থিয়েটারে গান গাইবে যা (হাঁ-সূচক) এবং অন্যত্র জনসম্মুখে গান পরিবেশন করবে না যা (না-সূচক)। এই চুক্তি ভঙ্গ হলে কালা রকিব কখনোই মিস রাখী’কে তার থিয়েটারে গান পরিবেশন করতে বাধ্য করতে পারবে না তবে আদালতের নির্দেশে ১২ মাসের জন্য অন্যত্র জনসম্মুখে গান পরিবেশনের উপর নিষেধাজ্ঞার আদেশ পেতে পারে। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারা-২১(খ) অনুসারে গান একটি মানুষের ব্যক্তিগত যোগ্যতা যা সুনির্দিষ্ট ভাবে কার্যকর করা যায় না। মিস রাখী’র অসম্মতিতে কালা রকিব কখনোই মিস রাখিকে তার থিয়েটারে গান পরিবেশন করতে বাধ্য করতে পারবে না। তবে মিস রাখীকে অন্যত্র গান পরিবেশনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে।
যে সকল ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করা যায় না-
১৮৭৭ সালের সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের ধারা-৫৬ অনুসারে ১১টি ক্ষেত্রে আদালতে নিষেধাজ্ঞা প্রার্থনা করা যায় না।
ক) বিচার বিভাগের কার্যধারা স্থগিত চেয়ে। তবে বিচারিক কার্যক্রমের পুনঃপৌনিকতা রোধ করার জন্য আবেদন করা যায়।
খ) আধীনস্ত নহে এমন আদালতের কার্যধারা স্থগিত চেয়ে।
গ) কোন ব্যক্তিকে আইন প্রণয়নকারী দলের কাছে আবেদন করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করলে।
ঘ) যদি কোন সরকারের কাজের উপর বা কোন সার্বভৌম রাষ্ট্রের কাজের উপর স্থগিতাদেশ চেয়ে।
ঙ) ফৌজদারি কার্যধারা স্থগিত চেয়ে।
চ) কার্যসম্পাদন যোগ্য নয়ে এমন চুক্তিভঙ্গ নিরোধ চেয়ে।
ছ) উপদ্রবের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন যেখানে উপদ্রবের বিষয়টি স্পষ্ট নয়।
জ) আবেদনকারীর মৌন সম্মতি রয়েছে এমন ক্রমাগত লঙ্ঘন নিরোধ চেয়ে আবেদন।
ঝ) ট্রাস্ট ভঙ্গ ছাড়া অন্য যেকোন বিষয়, যেখানে স্থগিতাদেশ বাদে অন্য কোন ভাবে যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
ঞ) আবেদনকারীর বা তার প্রতিনিধির ব্যবহার বা কাজ বা আচরণ সৎ না হলে।
ট) যিনি স্থগিতাদেশ প্রার্থনা করছেন মামলায় যদি তার ব্যক্তিগত স্বার্থ না থাকলে।
এই সকল ক্ষেত্রে আদালত কখনো ‘নিষেধাজ্ঞা’ বা ‘ইনজাংশন’ মঞ্জুর করবে না। যা আদালতের জন্য বাধ্যতামূলক।
ফৌজদারী নিষেধাজ্ঞা–
সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ফৌজদারী নিষেধাজ্ঞার বিধান প্রয়োগ করা যায়। ফৌজদারী কার্যবিধির চতুর্থ ভাগে PREVENTION OF OFFENCES শিরোনামে বিভিন্ন প্রকার আদেশের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিধান বর্ণনা করা আছে। কোন স্থানে গণ-উপদ্রব, দাঙ্গা, হামলা, মারামারির আশংকা থাকলে উক্ত আশংকা দূর করার জন্য ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৪৪ ধারার ক্ষমতা প্রয়োগ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতা প্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নির্দিষ্ট কোন এলাকার জন্য চলাচল, মিছিল, মিটিং, জমায়েত সহ ইত্যাদি বিষয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন। এই নিষেধাজ্ঞা কোন স্থানে ঘনঘন যাতায়াত বা গমনকারী বা আগমনকারী সর্বসাধারণের প্রতিও নির্দেশিত হতে পারে। উক্ত ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা দন্ড বিধির ১৮৮ ধারার অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। দন্ডবিধি’র ১৮৮ ধারায় বলা আছে কেউ যদি Disobedience to order duly promulgated by public servant অনুসারে দোষী সাব্যস্ত হয় তবে তিনি ১ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২০০/- টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং কেউ যদি উক্ত আদেশ অমান্য করে গণ-উপদ্রব, দাঙ্গা, হামলা, মারামারির আশংকা সৃষ্টি করে তবে সেই ব্যক্তি ৬ মাস পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা ১০০০/- টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অনেকের মতে চলাচল, মিছিল, মিটিং, জমায়েত বা কোন স্থানে গমন ভ্রমণ ইত্যাদি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’এর তৃতীয় ভাগে বর্ণনা করা মৌলিক অধিকারের অংশ। সে জন্য ১৪৪ ধারার আদেশ এবং এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি। এই কঠিন আইনি প্রশ্নে উচ্চ আদালত একাধিক মামলায় সিদ্ধান্ত প্রদান করেন যে, কিছু বিপদ্গামী মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার হুমকির মুখে থাকতে পারে না অর্থাৎ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষার জন্যই ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৪ ধারা প্রয়োগ করা হয়। ১৪৪ ধারার আদেশ মৌলিক অধিকার হরণ নয় বরং রক্ষা করা। সে জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের ১৪৪ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা রয়েছে। তবে মহানগরী এলাকায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ১৪৪ ধারার আদেশ প্রযোজ্য হয় না। মহানগর এলাকায় ১৪৪ ধারার অনুরূপ পুলিশ আইনের আওতায় আদেশ দিতে পারে ক্ষমতা প্রাপ্ত মহানগর পুলিশ কমিশনার।
আবার স্থাবর সম্পত্তি দখল এবং বেদখল কেন্দ্র করে যদি জনশান্তি বিঘ্ন হবার আশংকা তৈরি হয় অর্থাৎ দাঙ্গা, হামলা, মারামারির, খুন, জখমের সম্ভাবনা দেখা দিলে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৪৫ ধারা অনুসারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- আমাদের গল্পের কালা রকিব যদি খায়রুল সাহেবের জায়গা বাড়ি দলবল নিয়ে দখল করে খায়রুল সাহেব কে উচ্ছেদ করে। পরবর্তীতে খায়রুল সাহেব প্রতিবাদ করতে গেলে রক্তারক্তি, খুন, জখমের সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেই ক্ষেত্রে খায়রুল সাহেবকে উচ্ছেদ হবার ২ মাসের মাঝে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। Prima facie case প্রমাণ সাপেক্ষ ফৌজাদারি কার্যবিধির ১৪৫ ধারার ক্ষমতা বলে ম্যাজিস্ট্রেট খায়রুল সাহেবের দখল উদ্ধার সহ কালা রকিবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা মঞ্জুর করতে পারেন।
২০০৭ সালে মাসদার হোসেন মামলায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর থেকে ১৪৫ ধারার মামলা দায়ের ও বিচারের কর্মকান্ড নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এর উপর অর্পণ করা হয়েছে। তাৎক্ষনিক প্রতিকার পাওয়া যায় বিধায় ১৮৯৮ সালের ফৌজাদারী কার্যবিধির ধারা-১৪৪ এবং ধারা-১৪৫ আমাদের সমাজে বহুল ব্যবহৃত।
আলোচনার শেষে বলা যায়, দেওয়ানী এবং ফৌজদারী সকল প্রকার নিষেধাজ্ঞাই মানুষের কল্যাণের জন্য মানুষের অধিকারকে রক্ষা করার জন্য। নিষেধাজ্ঞার আভিধানিক অর্থ যদি হয় নিষিদ্ধ করা তবে তা মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধিকার হরণকে নিষিদ্ধ করে।
লেখক- লিগ্যাল রিসার্চার, স্কুল অব লিগ্যাল রাইটস।
তথ্যসূত্রঃ
১। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান।
২। সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭।
৩। দেওয়ানী কার্যবিধি, ১৯০৮।
৪। ফৌজদারী কার্যবিধি, ১৮৯৮।
৫। দন্ডবিধি, ১৮৬০।
৬। Masdar Hossain v Secretary, ministry of Finance 20 BLD 2000(AD)104.