আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী:
অগ্রিম ৩৩৯ কোটি টাকার হদিস নেই, মামলার সুপারিশ ইভ্যালির বিরুদ্ধে- এটি আজকে এক দৈনিকের শিরোনাম। চারিদিকে করোনার ভয়াবহ প্রকোপ। এই অবস্থায়ও ঠকবাজরা থেমে নেই…
অদ্ভুত এক সমাজে আমাদের বসবাস। একটা দৃশ্যপট আমরা এখানে হরহামেশাই দেখি। কোন একটা ভূঁইফোর সংস্থার ১০০০ টাকায় ৫০০ টাকা লাভের কিংবা দ্বিগুণ বা তিনগুণ মোনাফার অথবা ৫০% সুদের অফারে দেশের সরল!! জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তারপর সংস্থাটি তল্পিতল্পাসহ চম্পট। সাংবাদিকসহ ইলেকট্রনিক বা প্রিন্টিং মিডিয়ার আগমন। ভুক্তভোগীদের কান্না। তারপর মামলা ও সরকারকে দোষারোপ…
কোন একজন প্রতারক ধরা পড়ল। তার কাছে বিভিন্ন ধরনের সিল, ভিজিটিং কার্ড ও নানা সরঞ্জাম পাওয়া গেল। মামলা হলো। বিভিন্ন লোকজন ছুটে আসল। তারা সবাই অবাক পাওনাদার। কেউ চাকুরির জন্য, কেউবা কোন তদবীরের জন্য আসামীকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়েছে। দেখা যায়, সবাই তখন কান্না জড়ানো কন্ঠে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে….
জ্বীনের বাদশা সংক্রান্ত মামলার সাক্ষী নিচ্ছিলাম।একজন শিক্ষিত সচেতন ধনাঢ্য বয়স্ক ব্যক্তি ডকে দন্ডায়মান। সাক্ষীর বক্তব্য শুনে কলম ছেড়ে দিলাম। এও কি সম্ভব?? লোকটা বলে চলছে- জ্বীনের বাদশাকে বিকাশে এবং পরবর্তীতে কোন নির্দিষ্ট স্থানে টাকা পাঠানো হচ্ছে, কারন জ্বীনের বাদশা তাকে একটা স্বর্নের ডেকছি দিবে। পরে সে ডেকছি পেলেও তাতে সামান্য স্বর্নের অস্তিত্বও খোঁজে পেলনা। জ্বীনের বাদশা গায়েব। মামলা হলো। লোকটির আক্ষেপ, পুলিশ বা প্রশাসন তার জন্য কিছুই করেনি…
এগুলো হলো এই অবাক দেশের অবাক কিছু গল্প। একটা অন্যায় পথ বা অবৈধ লাভ জেনেও কেন এতে সম্পৃক্ত হলেন তা এসকল মানুষগুলোকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনা। এদের কারনেই এদেশে শাহেদ, সাবরীনা, পাপিয়া, ডেসটিনি, ইউনি-পে টু, ই-ভ্যালীসহ এরুপ অনেক মানুষ বা সংগঠনের সৃষ্টি হয়। সামনেও হবে। এরা সবাই অসৎ ক্ষমতাবানদের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে এবং নগদ লাভের জন্য তাদের স্তুতি করে। এরাই হলো আমজনতা। এরা সমস্ত অন্যায় অবিচারের সহযোগী, নিয়ামক। সুযোগের অভাবে সৎ। সুযোগ পেলেই এরাই আবার সততার সবক দেয়। লোভে সব হারিয়ে এরা জেনে শুনে সরকার বা সরকারি কর্মকর্তাদের দোষারুপ করে, বার বার বিচার প্রার্থনা করে। এই আমজনতাই ঘুষ দেন। আবার অভিযোগ করে যে, অমুক কর্মকর্তা তা পেয়েও কাজ করছেনা। আবার ঘুষ দিয়ে কাজ হাসিল করে এই আমজনতাই অহংকার করে তা প্রকাশ করে চরম আত্মতুষ্টি লাভ করে। আশ্চর্য এক সমীকরণ….
এবার দীর্ঘদিন ধরে জন্ম নেয়া ও লালন করা এদেশের জনগনের এক ব্যতিক্রমী ব্যাধির কথা বলি। এ সমাজের না পাওয়া মানুষগুলো ভদ্র, শিক্ষিত মানুষের অপমান, কষ্ট দেখলে আনন্দ পায়। এ যেন কঠিন এক মানসিক ব্যাধি। এই গ্যারাকলে সবচেয়ে বেশী বিপর্যস্ত হলো সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবি সমাজ। তাদের ধারণা- সরকারি কর্মকর্তার বেতন বাড়লেই যেন এই সমাজ রসাতলে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়ার এত কদর্য ও অন্যায় ব্যবহার পৃথিবীর অন্য কোথাও আছে কিনা জানিনা। ফেইসবুক বা ইউটিউবে কোন একজন সরকারী কর্মকর্তা বা শিক্ষক, ডাক্তার বা রাজনীতিবিদের প্রতি অপমানজনক পোস্টে হাজার জনের রেসপন্স। সাথে কান্নাজনিত আবেদন থাকলে তো কথাই নাই।সুস্থ সুন্দর একটি স্ট্যাটাসের সমর্থক পাওয়া যায়না সহজে। মিডিয়া ট্রায়াল ও পপুলার জাস্টিসের জয় জয়কার। একটা ক্যামেরা আর কিছু বক্তব্যই যথেষ্ট। জনগন ফেইসবুকেই বিচারের রায় ঘোষণা করে বেচারা অভিযুক্তকে ফাঁসি কাস্টে ঝুলিয়ে দিচ্ছে। এই সকল আম জনতাকে নিয়েই আমাদের ঘর সংসার…
ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বরাত দিয়ে একটি পরিসংখ্যান সবার সামনে এসেছে যে, বাংলাদেশের ৯৬% জমির মালিক পুরুষ। যে সমাজে ভাই বোনকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দেয়না সে সমাজের মানুষরা আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায়। পাওনা টাকা সঠিক সময়ে পাওনাদার ফেরত দিয়েছে- সেটি বিরল ঘটনা। কারো মোবাইল বা মানিব্যাগ হারিয়ে গেলে ফেরত পাবার পরিসংখ্যান নগন্য। আমি নিজের জন্য ন্যায়বিচার চাই কিন্তু পরের ক্ষেত্রে শত নীতিশাস্ত্র। এরাই আম জনতা, এদের জয় জয়কার…
সমালোচনা করার সুযোগ দিলে সাধারণ আমজনতা একটা স্বর্গীয় সুখ পায়। অথচ তাকে ঐ কাজ বা পদ দিলে তার চরিত্র বের হয়ে আসতো। কোন মানুষ কিংবা অফিসার সৎ হতে পারে তা কেউ মেনে নিতে চায়না, মেনে নিতে পারেনা। খালি এর বিপরীত যুক্তি বের করে। আমার স্টাফরা অন্য অফিসের হয়রানীর বিষয় বললে আমি বলি যে, আপনি কি সার্ভিস দেন?? এই আমজনতা খালি পিছনের দরজার সমাধান খুঁজে, সুযোগ সন্ধানীদের খোঁজ করে। সাহসের কথা বলে, নিজে সাহসী হয়না। অন্যের মাধ্যমে সাহস দেখাতে চায়। এজন্য বলা হয়- সবাই বাঘের প্রশংসা করে কিন্তু পছন্দ করে ভেড়াকে…
আমার দেশে ‘ভাল’ এর সংজ্ঞা নারী ও মদ ও ধর্মচর্চা কেন্দ্রীক। অথচ ভাল এর সংজ্ঞার পরিধি বিশাল। কোভিড আসার পর মানুষ ভাল হবে ভেবেছিল অনেকেই , তাও হয় নাই… অবস্থান ও অর্থ বিত্ত বিচার করে মানুষ অন্যকে মূল্যায়ন করে। কিন্তু সফলতার মাধ্যম কি তা যাচাই করেনা। তাই এখানে কোটিপতিদের অনেক কদর..তাদের সব পাপকে কোমলভাবে দেখা হয়…
আমাদের প্রজন্মের একটি বৃহৎ অংশ চাটুকার শ্রেণী হিসেবে গড়ে উঠছে। এই শ্রেণীর নিজস্ব কোন মতামত নেই, নেই কোন স্বকীয়তা । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এই চাটুকারদের জয় জয়কার। এতে সাফল্য শতভাগ। যারা এটি পারেনা তাদেরও অভিনয় করতে হয়। সবচেয়ে ভয়ংকর যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটা হল প্রভাব আছে এমন ব্যক্তির সকল বক্তব্যের পক্ষপাত সমর্থন।
আমাদের সমাজ দর্শন হলোঃ নেতা, বিচারক, শিক্ষক, পন্ডিত, হুজুর, পাদ্রী চিরকুমার থাকবে। এদেশে এসকল আদর্শ সংশ্লিষ্ট চাকুরি বা পেশার লোকগুলো আছে সবচেয়ে কষ্টে, বড় গ্যারাকলে। সমাজ চায়- এরা সুদ, ঘুষ, হারাম থেকে দূরে থাকবে। মদ খাবে না, সাহসী বীরপুরুষ হবে। সৎ, নীতিবান, উন্নত চারিত্রিক, ন্যায়বিচারক হবেন। জামা সবসময় পরিপাটি হবে। কোন দাগ থাকবে না বা লাগবে না। দুনিয়ার প্রতি কোন মোহ থাকবে না। থাকবে না লোভ, ভয়, হিংসা, অহংকার, রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্খা ইত্যাদি। তাদের সামান্য বিচ্যুতি অকল্পনীয়। আর আমজনতা হবে– অসৎ। এসবের পুরো উল্টো। ফ্রী লাইসেন্সধারী। পাশাপাশি কঠিন সমালোচক।
এ সমাজ এগুলো থেকে মুক্ত হোক। দুষিত চিন্তা থেকে বের হয়ে আসুক। কোভিডের ভয়ে হলেও মানুষের মধ্যে পবিত্রতা আসুক। তা নাহলে ভাল মানুষগুলো কোন কাজ করতে পারেনা, তাদের ভালটুকু কারো কাজে লাগেনা। এই ভাল মানুষগুলোও অন্যায় থেকে নিজেকে বাচাঁতে পারেনা। অনিচ্ছায় অবিচার করতে হয়। তাদের জন্য একরাশ সমবেদনা ছাড়া সমাজের আর কিছুই দেয়ার থাকেনা…(সামান্য অংশ সংগৃহীত)
আলমগীর মুহাম্মদ ফারুকী: অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, নোয়াখালী।