ড. উত্তম কুমার দাস

আইনি-পর্যালোচনা: সরকারি কর্মচারী- শিক্ষানবিসকালে চাকরির অবসান

ড. উত্তম কুমার দাস:

দিন কয়েক আগে কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে ফোন করেন। সেই সুবাদে সপ্তাহখানেক ধরে ঘাঁটাঘাঁটি করলাম। বিষয়টি হ’ল- শিক্ষানবিসকাল বা প্রবেশন পিরিয়ডে সরকারি কর্মচারীদের চাকরির অবসান নিয়ে। এনিয়ে বিদ্যমান আইনকানুন, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং অন্যান্য দেশের সুপ্রীম কোর্ট ও বিভিন্ন হাইকোর্টের বেশ কিছু রায় পড়লাম এবং পর্যালোচনা করলাম।

দেশে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সরকারি কর্মচারীদের চাকরির ক্ষেত্রে এখন প্রযোজ্য আইন হ’ল- সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এবং সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮।

বিভিন্ন স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কিংবা অধিদপ্তরের চাকরি বিধিমালায় এমন বিধান থাকে যে শিক্ষানবিসকালে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর আচরণ ও কাজ সন্তোষজনক না হলে তার চাকরির অবসান ঘটানো যাবে। এর বরাতে কোন কর্মচারীকে তার প্রবেশনকালে অনায়াসে চাকরিচ্যুত (চাকরির অবসান বা টার্মিনেশন) করা যায়। তবে এখানে দেখার বিষয় হ’ল অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালায় কোন নিরপেক্ষ মানদণ্ড বা প্রক্রিয়া থাকেনা কিংবা যথাযথ আইনানুগ ও ন্যায় বিচারের নীতি অনুসরণ করা হয়না। উল্লেখিত বিধিমালায় উল্লেখ থাকেনা কিসের ভিত্তিতে উক্ত আচরণ ও কাজের সন্তোষজনকতা নির্ধারিত হবে। এতে করে বে-আইনি প্রক্রিয়ায় ও ক্ষমতা বহির্ভূতভাবেও অনেক সময় চাকরির অবসান ঘটতে পারে। উক্ত চাকরির অবসান বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন নোটিশ সময় কিংবা তার পরিবর্তে নোটিশ-পে’র বিধান না থাকলে সেই বিধি আইনসিদ্ধ হবেনা বলে আমরা মনে করি।

সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে অসামরিক পদে নিযুক্ত কোন ব্যক্তির চাকরি অবসানের প্রক্রিয়া হিসেবে বরখাস্ত এবং অপসারণের কথা উল্লেখ রয়েছে। অন্য কোন প্রক্রিয়ার কথা সংবিধানে উল্লেখ নেই। সংবিধান নির্দেশিত আরেকটি শাস্তি হ’ল- পদাবনতি।

তবে কতিপয় বিশেষক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ব্যতিত উপরোক্ত সকল শাস্তির ক্ষেত্রে কারণ দর্শানোর যুক্তিসংগত সুযোগদানের নিশ্চয়তা রয়েছে সংবিধানে। সংবিধানে “চাকরির অবসান” নামে (যা মূলতঃ চাকরিচ্যুতি বা টার্মিনেশন) স্বতন্ত্র কোন প্রক্রিয়ার উল্লেখ নেই। একই কথা প্রযোজ্য সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ক্ষেত্রে; সেখানেও চাকরির অবসান অথবা চাকরিচ্যুতি বা টার্মিনেশন নামে কোন বিধান নেই।

তবে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩ এবং ৪(৭) একত্রে পড়লে দেখা যায় সেখানে চাকরি অবসানের একটি প্রক্রিয়া হ’ল অব্যাহতি। উক্ত বিধান অনুসারে, কর্তৃপক্ষের মতে যে কোন সরকারি কর্মচারী যদি “পলায়নের দায়ে দোষী হন”, অথবা “দুর্নীতি পরায়ন হন” সেইক্ষেত্রে “… শিক্ষানবিশ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হইয়া তাহার মেয়াদ চলাকালে বা তাহার প্রতি প্রযোজ্য শিক্ষানবিশকাল”- বিদ্যমান এমন কোন ব্যক্তির চাকরি থেকে অব্যাহতি (Discharge) “চাকুরী হইতে অপসারণ” ও “চাকুরী হইতে বরখাস্তকরণ” অভিব্যক্তি অর্থে অন্তর্ভুক্ত হবেনা।

উক্ত বিধিমালায় বিষয়টিকে জটিলভাবে বলা হলেও এর মানে হ’ল- শিক্ষানবিসকালে কোন কর্মচারী পলায়নের দায়ে দোষী হলে অথবা দুর্নীতিতে সংশ্লিষ্ট হলে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে। এইক্ষেত্রে বরখাস্ত কিংবা অপসারণ করার ক্ষেত্রে যে সকল শর্ত পালনীয় তা পালন করতে হবেনা বলে বিধান দেওয়া হয়েছে। এই অব্যাহতি হ’ল বরখাস্ত কিংবা অপসারণ ব্যতিত অন্যভাবে চাকরির অবসান বা টার্মিনেশন। তবে লক্ষণীয় হ’ল সংবিধান (১৩৫ অনুচ্ছেদ) কিংবা ২০১৮ সনের আইন- কোথাও কিন্তু “চাকরির অবসান” অথবা টার্মিনেশন নামে সরকারি কর্মচারীর চাকরি-অবসানের আলাদা কোন বিধান নেই।

এখানে দেখার বিষয় হ’ল- যিনি শিক্ষানবিস কর্মচারী তাকে কিন্তু কোন স্থায়ী পদের বিপরীতে নিয়োগ করা হয়। শিক্ষানবিস পদে কেউ নিয়োগ পাননা; নিয়োগ দেওয়া হয় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে। চাকরির প্রাথমিক পর্যায়ে এক থেকে দু’ বছর থাকে শিক্ষানবিসকাল।

মাননীয় আপীল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগ বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক মামলার রায়ে বিধান দিয়েছেন যে শিক্ষানবিসকালে বা প্রবেশন পিরিয়ডে কাউকে “সিম্পল টার্মিনেশনের” আদেশ দিলে তা বৈধ বলে গন্য হবে। তবে সংশ্লিষ্ট আদেশে কোন প্রকার দোষারোপ করলে (Imposing stigma) তা অবৈধ হবে। আর কোন শিক্ষানবিস বা প্রবেশনারকে টার্মিনেশনের (Termination simpliciter) ক্ষেত্রে কোন কারণ-দর্শানো নোটিশ কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই বলে মাননীয় আদালতের মত।

আমাদের এখানে লক্ষণীয় হ’ল অনেক ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে অনেক সময় উপযুক্ত আদালতের দারস্থ হননা। তাই অনেক বে-আইনি আদেশও পাড় পেয়ে যায়; চ্যালেঞ্জ হয়না।

এইক্ষেত্রে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট এবং সেখানকার বিভিন্ন হাইকোর্টের অসংখ্য মামলার রায় রয়েছে। সেখানকার আদালতের মত হ’ল- একজন শিক্ষানবিস বা প্রবেশনারও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। তিনিও পূর্ণ সাংবিধানিক সুরক্ষা পাবেন। কোন কর্মচারী শিক্ষানবিস বলে তার বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবেনা। তাই টার্মিনেশন বা অপসারণের মাধ্যমে কোন শিক্ষানবিসের চাকরির অবসান করতে চাইলে তাকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের যথাযথ সুযোগ দিতে হবে। অর্থাৎ যথাযথ প্রক্রিয়া এবং ন্যায় বিচারের নীতি অনুসরণ করতে হবে।

ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের মত হ’ল প্রজাতন্ত্রের কোন কর্মচারীর কোন টার্মিনেশন-আদেশের নেপথ্য কারণ আইনগত পর্যালোচনার (Judicial review) আওতায় মাননীয় আদালত খতিয়ে দেখতে পারেন। এইক্ষেত্রে দেখার বিষয় হ’ল- সংশ্লিষ্ট টার্মিনেশন-আদেশ এবং তার ভাষা ও প্রকরণ আপাতঃদৃষ্টিতে নিষ্পাপ ও সরল মনে হতে পারে; তবে এইক্ষেত্রে দেখতে হবে যে এর নেপথ্যে কোন “মোটিভ” এবং “ফাউন্ডেশন” রয়েছে কি-না। ভারতীয় আদালতে এটি এক প্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়া।

এমনি এক রীট মামলার বিচারে বোম্বে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট টার্মিনেশন-আদেশকে (যা আপাতঃ সরল ছিল) বাতিল ঘোষণা করেছেন। নেপথ্য-কারণ ছিল- সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পৃথক পৃথক বিষয়ে পর পর তিনবার সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে কারণ-দর্শাতে বলেন। উক্ত কর্মচারী আনীত অভিযোগ খণ্ডন করে এবং নিজকে নির্দোষ দাবি করে তিনবারই জবাব দাখিল করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে কোন প্রকার বিবেচনা না করে এবং প্রযোজ্য আইন মোতাবেক অভিযোগের কোন প্রকার সুরাহা করেনি; বরং টার্মিনেশন-আদেশ জারী করেছিল (সুত্রঃ Sanjay Rane vs. State of Goa and Others, Decided on 12 March 2021)।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের মাননীয় আপীল বিভাগ এক সিভিল আপীলের রায়ে বলেছেন, এটি বলা যাবেনা যে রীট পিটিশনারকে তার চাকরি থেকে টার্মিনেট করা হয়েছে; প্রকৃতপক্ষে তাদেরকে টার্মিনেশনের আড়ালে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের টার্মিনেশন আদেশ সরল নয়; বরং এতে অবৈধ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। এখানকার প্রতিপক্ষসহ অন্যদের বিরুদ্ধে প্রথমে কারণ-দর্শানো নোটিশ জারী করা হয়। তারা এর প্রেক্ষিতে জবাব দাখিল করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আনীত অভিযোগের কোন সুরাহা না করে পরবর্তীতে তাদের লিখিত আদেশ দিয়ে টার্মিনেট করেন। এর প্রেক্ষিতে সংক্ষুব্ধ কর্মচারীরা রীট করলে মাননীয় হাইকোর্ট বিভাগ রুল ইস্যু করেন, যা শুনানী শেষে চূড়ান্ত হয়। এরপর কারখানা কর্তৃপক্ষ সিভিল আপীল করলে উক্ত রায় আসে [Ashuganj Fertilizer and Chemical Company Ltd. vs. Md. Abu Sufian Bhuiyan, 71 DLR (AD) 35] ।

অনেক সময় দেখা যায়, কোন কর্মচারীকে (বিশেষতঃ শিক্ষানবিস বা প্রবেশনারকে) কোন অসদাচরণে অভিযুক্ত করে কারণ-দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়। জবাব পেলেও তার কোন প্রকার সুরাহা করা হয়না এবং উক্ত প্রক্রিয়া স্থগিত কিংবা চূড়ান্ত না করেই টার্মিনেশন-আদেশ জারী করা হয়। উপরোক্ত রায়ের প্রেক্ষিতে এহেন টার্মিনেশন-আদেশ অবৈধ বলে গণ্য হতে পারে।

অনেকে প্রশ্ন করেন এহেন বে-আইনি বা ক্ষমতা বহির্ভূত আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার কি এবং তা কোথায়?

এর জবাব হ’ল- চাকরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শর্তাবলী লঙ্ঘন করে চাকরির অবসান বা টার্মিনেশন করা হলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে হবে। আর সংশ্লিষ্ট আইনের বৈধতা (Ultra vires) কিংবা টার্মিনেশন-আদেশের মাধ্যমে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকে প্রামাণিক করার সুযোগ থাকলে রীট করা যেতে পারে (Bangladesh and Others vs. Sontosh Kumar Shaha and Others, 6 SCOB (2016) AD)। এমনও দেখা যায় বিদ্যমান চাকরি বিধিমালার বিধান সাংবিধানিক বিধান কিংবা ২০১৮ সনের চাকরি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

তবে আগে বিভাগীয় আপীল করতে হবে। আর তা করতে হবে সংশ্লিষ্ট চাকরিবিধির নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে। যা সাধারণত ৩০ দিন বা এক মাস হয়ে থাকে। যদিও ২০১৮ সনের চাকরি বিধিমালা অনুসারে আপীল করার সময়সীমা হ’ল তিন মাস (বিধি ১৬ ও ১৭)।

(এটি কোন আইনি পরামর্শ নয়; সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রচারিত এবং আমাদের সামাজিক কাজের অংশ। আপনাদের কোন প্রশ্ন কিংবা মতামত থাকলে আমাদেরকে ই-মেইল করতে পারেনঃ servicemattersbd@gmail.com)

লেখক- অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং শ্রম ও চাকরিসংক্রান্ত আইনের প্র্যাকটিশনার।