দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত পার্থ গোপাল বণিককে জামিন দিয়েছিল ঢাকার বিশেষ জজ ইকবাল হোসেন। ওই জামিনাদেশ প্রকাশ্যে আদালতে ঘোষিত হয়নি। এমনকি আদেশটি অতি গোপনে পাঠানো হয়েছিল কারাগারে। যদিও আইনে রয়েছে যেকোনো রায় বা আদেশ ঘোষণা করতে হবে প্রকাশ্য আদালতে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় জামিনাদেশ ঘোষণা করা হয়েছে তাতে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়ে বিচার বিভাগকে ওই বিচারক বিতর্কিত করেছেন মর্মে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট।
পার্থ গোপাল বণিকের জামিন বাতিলের রায়ে এই পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।
একইসঙ্গে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেনকে সর্বোচ্চ সতর্ক করে হাইকোর্ট বলেছে, উনি যেন ভবিষ্যতে মামলা পরিচালনা ও উচ্চ আদালতের আদেশ প্রতিপালনে আরও সতর্ক ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সতর্কতার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বিচারকের ডসিয়ারে সংরক্ষণ করতে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
একইসঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে জামিনসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্বর্তী আদেশ ও রায় প্রকাশ্য আদালতে সংশ্লিষ্ট পক্ষগণ বা তাদের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে ঘোষণা করতে নিম্ন আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দেওয়া হলো।
হাইকোর্টের বেধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বিচার শেষ না করে ৮০ লাখ টাকা অর্থ পাচার মামলার আসামি বরখাস্তকৃত ডিআইজি প্রিজন্স পার্থ গোপাল বণিককে গত ১৭ জুন জামিন দেয় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ইকবাল হোসেন। এ নিয়ে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একইসঙ্গে দুদক বিশেষ আদালতের জামিন আদেশ বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ইতিপূর্বে দুই দফায় হাইকোর্টে জামিন চান পার্থ গোপাল। উচ্চ আদালত জামিন দিয়ে মামলার বিচার ছয় মাস এবং আরেক আদেশে এক বছরের মধ্যে শেষ করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের এই আদেশ লঙ্ঘন করে পার্থ গোপালকে জামিন দেয় ইকবাল হোসেন। পরে হাইকোর্ট ওই জামিন বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করে। একইসঙ্গে বিশেষ আদালতের বিচারকের কাছে ব্যাখ্যা চায়। ব্যাখ্যায় বিচারক তার ভুলের জন্য হাইকোর্টে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
এই ক্ষমার আবেদন গ্রহণ না করে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, আমাদের (বিচারপতিদ্বয়) বলতে দ্বিধা নেই যে, জেলা জজ পর্যায়ের একজন বিচারকের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ ও কর্ম প্রত্যাশিত নয়। তার এ ধরনের আদেশ উচ্চ আদালতের প্রতি অবজ্ঞা এবং যা আদালত অবমাননার সামিল। হাইকোর্ট বিভাগ ইতিপূর্বে আসামির জামিন নাকচ করে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু বিচারক ইকবাল হোসেন আসামিকে জামিন প্রদান করে হাইকোর্টের আদেশকে অবজ্ঞা করেছেন।
হাইকোর্ট বলেছে, জামিন আবেদন শুনানির পর বিচারক তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ্য আদালতে কোনো আদেশ প্রদান করেননি। আদেশটি অতি গোপনে কারা কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ করা হয়, যা সংশ্লিষ্ট পক্ষের আইনজীবীরাও জ্ঞাত ছিলেন না। এ ধরনের ঘটনা হতাশা ও লজ্জাজনক এবং আইনের সঙ্গে সংগতিহীন। জামিন আদেশ প্রদানের প্রক্রিয়া নানান প্রশ্নের সুযোগ করে দিয়ে বিচার বিভাগকেও বিতর্কিত করা হয়েছে। সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় জামিন আদেশটি বহাল রাখার আইন ও যুক্তি সংগত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। জামিন আদেশটি বাতিল করা হলো। আসামিকে সংশ্লিষ্ট আদালতে ২০ সেপ্টেম্বরের পূর্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হলো। একইসঙ্গে ন্যায় বিচারের স্বার্থে বর্তমান মামলাটি বিশেষ আদালত-৫ হতে বিশেষ আদালত-৪ এ বদলি করা হলো। এই আদালতের বিচারককে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারির পূর্বে মামলার বিচার শেষ করে হাইকোর্টকে অবহিত করতে নির্দেশ দেওয়া হলো।
প্রসঙ্গত ২০১৯ সালের ২৮ জুলাই সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দুদকের সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় পার্থ গোপাল বণিককে। ঘুষ ও দুর্নীতির কয়েক লাখ নগদ টাকা তার বাসায় রয়েছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে ওইদিন বিকালে তার বাসায় অভিযান চালানো হয়। অভিযানে ৮০ লাখ টাকা জব্দ করা হয় এবং তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসা হয়। পরে দুর্নীতির মামলা করে দুদক।