এ এম আমিন উদ্দিন:
বছর ঘুরে আবার এলো ২৭ সেপ্টেম্বর। ঠিক এক বৎসর পূর্বে এই দিনে জনাব মাহবুবে আলম, সাবেক এটর্নী জেনারেল আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার উপস্থিতি আমাদের মাঝে বিরাজমান। আমরা তার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা উপলব্দি করি প্রতি মুহুর্তে। আইন পেশায় তাঁর একাগ্র সাধনা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে অগ্রগন্যের তালিকায়। দীর্ঘ জীবনপথের অভিজ্ঞতা তিনি তুলে দিয়ে গেছেন আমাদের উত্তর প্রজন্মের হাতে।
তাঁর সাথে জুনিয়র আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করি ১৯৮৮ সালে। তিনি তখন থাকতেন কলেজ গেটে তার নিজ বাসভবনে। আমার বাবা আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর কাছে। তাঁকে দেখার, জানার এবং তাঁর সাথে কাজ করার আগ পর্যন্ত আইন পেশায় নিজেকে সম্পূর্নরূপে সম্পৃক্ত করার প্রতি আমার ছিল ভীষন অনাগ্রহ। কিন্তু তাঁর সাথে কাজ আরম্ভ করার পর নিকট আত্বীয়ের মতো, অভিভাকের মতো, পরম বন্ধুর মতো স্বস্নেহে এমন পরিবেশ তৈরি করেছিলেন তিনি যার দরুন আমি এই পেশায় আত্মনিবেদনে ভীষণভাবে আগ্রহী হয়ে উঠি।
তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মামলা ও মক্কেলের প্রতি তাঁর কী অসীম আত্মনিবেদন ও দায়িত্ববোধ। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ সমর্থক এই মানুষটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মম ও জঘন্য হত্যাযজ্ঞের মামলায় অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানীর প্রস্তুতিতে তাঁকে সহায়তা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সে সময় এই জঘন্য হত্যাকান্ডের বিচার সুনিশ্চিত করতে তাঁর দৃঢ় অবস্থান, অধ্যাবসায় এবং নিরলস পরিশ্রম প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ছাড়াও তিনি সংবিধানের পঞ্চম, সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা, পিলখানা হত্যাকান্ড মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলায় রাষ্ট্রকে প্রতিনিধিত্ব করেন। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার কাজ শুরু হলে তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনজীবীদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, দেলোয়ার হোসেন সাইদী, আবদুল কাদের মোল্লা, কামরুজ্জামান, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং সৈয়দ কায়সারসহ সকল মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনা করেন।
এ তো গেলো তার পেশাগত নিষ্ঠার কথা। মানবিক মাহবুবে আলমের প্রতি আলোকপাত না করলে তাঁকে একেবারেই চেনা যাবেনা। সহৃদয় এই মানুষটি সহকর্মীদের প্রতি স্নেহ ও দায়িত্বশীলতাকে হৃদয়ে ধারণ করতেন। মনে আছে তাঁর সাথে কাজ শুরু করার কয়েক মাস পর আমার জন্মদিনের কথা জানতে পেরে ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে আচমকা উপস্থিত হয়েছিলেন আমার বাসায়। অনুজ সহকর্মীর প্রতি এই যে স্নেহ ও মনোযোগ তা কিছুতেই ভুলবার নয়। তিনি আমার ও পরিবারের সকলের অত্যন্ত আপনজন ছিলেন, আমার ছেলেদের তিনি অত্যন্ত প্রিয় চাচু।
আর একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়। ২০০১/২০০২ সালের দিকে একবার তাঁর সাথে নরসিংদিতে একটি মামলা করতে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তো মামলা শেষ করে আমরা দুপুরে খেতে বসেছি। এ সময় কেউ বিশেষ একজন আইনজীবীর নাম উল্লেখ করে জানিয়েছিলেন যে তিনি অসুস্থ। মাহবুবে আলম তাৎক্ষনিক খাওয়া রেখে চলে গেলেন তাকে দেখতে। পরে জানলাম নরসিংদির মামলা থেকে প্রাপ্ত ফি’র পুরোটাই তিনি ঐ আইনজীবীকে দিয়ে এসেছেন। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় কতো বড় মনের অধিকারী ছিলেন তিনি।
তার সাথে যতোবার দেশের বাইরে গিয়েছি মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তিনি বাইরে গেলে নতুন নতুন খাবার খেতে ও নতুন জায়গায় ঘুরতে উৎসাহিত করতেন। বলতেন -যা খাচ্ছো আর যা দেখছো সেই অভিজ্ঞতা আর আনন্দটুকুই শুধু তোমার, বাকিগুলো তোমার নয়।
এক বছর হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, অসাম্প্রদায়িক, মানবদরদী, কর্মনিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান এই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন, এটাই রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু তিনি তার প্রজ্ঞা, সাহস আর অঙ্গীকার নিয়ে মানুষ আর রাষ্ট্রের জন্য যে নিরলস কাজ তিনি করে গেছেন তা বাংলাদেশের আইনাঙ্গনসহ সাধারন মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। আমি তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত স্থান দান করেন এই দোয়া করি।
লেখক- বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি।