শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান: আইন প্রায়োগিক বিষয়। আইনের শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ, উপানুচ্ছেদ, ধারা, উপাধারা, দফা, বিধি ইত্যাদি বিস্তৃত ও বিশেষ অর্থে গ্রহণ করতে হয়, পড়তে এবং বুঝতে হয়। অন্য যে কোনো বিষয়ের চেয়ে আইনের ভাষা ও বাক্য একটু আলাদা এবং জটিল। কোনো নির্দিষ্ট আইনের পূর্বাপর ইতিহাস, ঐ আইনের পরম্পরা জানা থাকলে ঐ আইনটি বুঝতে সহজতর হয়। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ আলোচনার পূর্বে এই প্রতিষ্ঠানের আইনি কাঠামো ইতিহাস সম্বন্ধে সাধারণভাবে দু’একটি কথা আলোচনা করা প্রয়োজন। কেননা, প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও কার্যাবলি আইনের মধ্যে সাধারণত বিধৃত থাকে। সুতরাং বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা উপস্থাপনের আগে এই প্রতিষ্ঠানের আইন সম্বন্ধে দুটিকথা তুলে ধরার প্রয়াস করেছি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্মারক বাংলা একাডেমি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির গবেষণায় নিয়োজিত এক অনন্য জাতীয় ঐতিহ্যিক এবং ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি বাঙালি জতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক।
বাংলা একাডেমির জন্ম ও বিকাশ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে বিজড়িত। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫)-এর নেতৃত্বে ‘১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে [জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের] মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত করা। এই প্রতিষ্ঠা অর্জনের নেপথ্যে ভাষা আন্দোলন বাঙালির জাতিসত্তা নির্মাণ, নিজস্ব রাষ্ট্রগঠন ও জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে অনুপ্রেরণা এবং আদর্শের প্রতীকরূপে কাজ করেছিল। আর এ ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল বাংলা একাডেমি।
ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। সুতরাং বাংলা একাডেমি নিছক কয়েকটি উঁচু উঁচু দালানের সমন্বয়ে শুধু একাডেমি মাত্র নয়, এই প্রতিষ্ঠান একটি জাতি তৈরি, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য অংশরূপে কাজ করেছিল এবং এই কাজ অব্যাহতভাবে করছে। এজন্যই বলা হয়Ñ ভাষা আন্দোলন ও বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ এই প্রত্যয়গুলো অবিচ্ছিন্ন সত্তা, একটি ছাড়া অপরটি খ-িত ও অসম্পূর্ণ। এ জন্যই বাংলা একাডেমি বাঙালির এক অনন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গঠন প্রক্রিয়ার সাথে ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরায় এমন গভীর একাত্মতা বাংলাদেশের আর কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই।
বাংলা একাডেমি এই দেশে একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা মানুষের বুকের তাজা রক্ত থেকে সরাসরি উঠে এসেছে। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বাংলা একাডেমি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠার তারিখের অনেক আগে অনানুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল; অতঃপর, বেশ পরে এই প্রতিষ্ঠানের আইনি কাঠামো জারি করা হয়। এই প্রতিষ্ঠানকে একটি আইন দিয়ে কাঠামো জারি করা হলেও অন্যসব আইন দিয়ে তৈরি প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা একাডেমির তাৎপর্য-মর্যাদা সম্পূর্ণভাবে আলাদা।
সাধারণত একটি আইন দিয়ে তৈরি প্রতিষ্ঠানকে আইন প্রণেতারা অন্য একটি আইন দিয়ে কোনো সময় তা তুলে দিতে পারেন। কিন্তু বাংলা একাডেমির গুরুত্ব-মর্যাদা তাৎপর্য ভিন্ন। এই প্রতিষ্ঠান আইন দিয়ে তৈরি হলেও আইন প্রণেতারা কখনও অন্য একটি আইন দিয়ে তা তুলে দিতে পারবেন না। বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা যতদিন পৃথিবীতে বহমান থাকবেÑ বাংলা একাডেমি বাঙালির বাতিঘর রূপে ততদিনই থাকবে।
বাংলা একাডেমি ১৯৫৫ সালের ৩রা ডিসেম্বর মোতাবেক ১৩৬২ বঙ্গাব্দের ১৭ই অগ্রহায়ণ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতল বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ জন্য ৩রা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করা হয়। বহুভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) বাংলা একাডেমির স্বপ্নদ্রষ্টা। উল্লেখ্য, আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার আগে পূর্ব বাংলা সরকার (পূর্ব পাকিস্তান সরকার) বাংলা একাডেমির আয়োজক সমিতি (প্রিপারেটরি কমিটি) গঠন করেন। পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) গভর্নরের (লাট সাহেব) আদেশে ১৯৫৫ সালের ২৬শে নভেম্বর এই কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং এ কমিটি কয়েক দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করেছিল। এই আয়োজক সমিতি গঠনের তারিখ থেকেই বাংলা একাডেমির অনানুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল। ১৯৫৫ সালের ২রা ডিসেম্বর পূর্ব বাংলা সরকারের আদেশে বাংলা একাডেমির জন্য একটি সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হয় এবং এই কাঠামোই ছিল একাডেমির প্রথম সাংগঠনিক কাঠামো। অতঃপর পারস্য প্রতিভার প্রখ্যাত লেখক ও সরকারি কর্মকর্তা মুহম্মদ বরকতউল্লাহ (১৮৯৮-১৯৭৪) বাংলা একাডেমির স্পেশাল অফিসার (প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা) নিযুক্ত হন। তিনিই একাডেমির প্রথম কর্মকর্তা, তাঁর মেয়াদকাল ০২.১২.১৯৫৫ থেকে ২৮.০২.১৯৫৭ তারিখ পর্যন্ত।
১৯৫৬ সালের ১লা ডিসেম্বর তারিখে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন বাংলা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক (১৯০২-১৯৮২) একাডেমির পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনিই একাডেমির প্রথম পরিচালক, তাঁর মেয়াদকাল ০১.১২.১৯৫৬ থেকে ১২.০৯.১৯৬০ তারিখ পর্যন্ত। তাঁর মেয়াদ কালেই বাংলা একাডেমির জন্য প্রথম আইন ইংরেজিতে রচিত The Bengali Academy Act, 1957 (East Pakistan Act xxv of 1957) পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে (পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা/পূর্ব পাকিস্তান সংসদ/পূর্ব পাকিস্তান বিধানসভা) ১৯৫৭ সালের ৩রা এপ্রিল তারিখে গৃহীত হয়। এটি ছিল বাংলা একাডেমির জন্য তাৎপর্যময় ঘটনা। একাডেমির প্রথম পরিচালক হিসেবে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক চরিত্র, দিকনির্দেশনা ও আইনি কাঠামো বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন।
দি বেঙ্গলি একাডেমি অ্যাক্ট, ১৯৫৭ এই আইন পাশ হওয়ার ফলে বাংলা একাডেমিকে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা প্রদান করা হয়। অতঃপর ১৯৫৭ সালের ১০ই আগস্ট বাংলা একাডেমির উক্ত আইন প্রবর্তিত হলে এই আইনের ধারা ৯-এর উপধারা ১, ২ অনুযায়ী উক্ত তারিখ থেকে আয়োজক সমিতি ‘কাউন্সিল’-এর নাম ও মর্যাদা লাভ করে। উক্ত ধারায় একাডেমি কাউন্সিল গঠনের বিধান ছিল। কাউন্সিলকে তখন বাংলায় বলা হতো কার্যকর সংসদ, কখনও কর্মপরিষদ। এই কাউন্সিলে বা পরিষদে পদাধিকার বলে ৪ জন, সরকার মনোনীত ৭জন এবং নির্বাচিত ৮জন সদস্যসহ মোট ১৯ জন সদস্য নিয়ে গঠনের বিধান ছিল। এভাবেই বাংলা একাডেমির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু হয়। একাডেমির কাউন্সিল ২৬.০৩.১৯৮৫ তারিখে প্রথম গঠিত হয়েছিল।
১৯৫৭ সালের বাংলা একাডেমির আইনের ৪ (১) (বি) ধারায় একাডেমির জন্য সভাপতি নিযুক্তির বিধান ছিল। এই আইনের ৬ (সি) ধারায় সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের বিধান ছিল। এখানে পুরস্কার বলতে পদক, খেতাব-পুরস্কার, পারিতোষিক, সম্মানি ইত্যাদি দেওয়ার কথা বলা আইনে উল্লেখ ছিল। ১৯৬০ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রদত্ত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্মানজনক বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করছে।
১৯৫৭ সালের আইনের ৪ (১) (বি) ধারায় বিধান ছিল পূর্ববাংলার (তখন পূর্ব পাকিস্তান কথাটিও বলা হতো) শিক্ষামন্ত্রী পদ বলে বাংলা একাডেমির সভাপতি হবেন।
আইনের ৪ (১) (সি) ধারানুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে একজন সহসভাপতি হবেন। তিনি বাংলা একাডেমি আইনের প্রদত্তসহ সভাপতির কার্যসাধন করবেন। তাঁরা বাংলা একাডেমির সাধারণ সভায় সভাপতিত্বের দায়িত্ব পালন করবেন।
আইনের ৪ (১) ধারা অনুযায়ী প্রধান পৃষ্ঠপোষক (গভর্নর), একাডেমির সভাপতি (পদবলে পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী), সহসভাপতি (নির্বাচনের মাধ্যমে), পৃষ্ঠপোষক-ফেলো, জীবনসদস্য ও সদস্যদের নিয়ে একাডেমি গঠিত হবে।
এই আইনের ধারা ১০-তে বিধান ছিল একাডেমির প্রশাসন কাউন্সিলের উপর ন্যস্ত, কাউন্সিল একাডেমির সকল কার্যনির্বাহ করবেন, বাজেট অনুমোদন প্রদান, একাডেরিম প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য একাডেমির পরিচালকের সুপারিশক্রমে পদসৃষ্টি, বিলোপ বা সমন্বয় করবেন। একাডেমির সকল সিদ্ধান্ত নির্বাহ করবেন; একাডেমির নির্বাহকৃত সিদ্ধান্তের কোনো অংশ লেখিতভাবে একাডেমির পরিচালকের উপর ন্যস্ত করতে পারবেন।
আইনের ধারা ১৩ অনুযায়ী বাংলা একাডেমির বার্ষিক সাধারণ সভার বিধান রাখা হয়েছিল। আইনের ধারা ৫-এর উপধারা ১ অনুযায়ী একাডেমির জন্য ছয়টি বিভাগ রাখার বিধান ছিল।
আইনের ধারা ৩-এর উপধারা ১ অনুযায়ী একাডেমির জন্য একটি অভিন্ন সিলমোহরের বিধান ছিল। বাংলা একাডেমির অভিন্ন সিলমোহর বা প্রতীক সময়ে সময়ে বানান ও ভাষা পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলা একাডেমির শুরুর প্রথম সিলমোহরটি ছিল ইংরেজিতে। ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমির জন্য গৃহীত প্রতীকটিতে ছিল পাকিস্তানি চরিত্রের।
বাংলা একাডেমি আইন, ১৯৫৭ পরবর্তীকালে পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের (লাট সাহেব) আদেশে একবার সংশোধিত হয়েছিল। এই সংশোধন হয় ১৯৬০ সালের ২৬শে জুলাই তারিখে। পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের আদেশে The Bengali Academy Act, 1957 (East Pakistan Act xxv of 1957) জারি করা হয়। এ অধ্যাদেশ প্রবর্তিত হলে সভাপতি নিয়োগসহ কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে কিছু সংশোধনী অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং বাংলা একাডেমি কার্যপ্রণালী পরিচালনার বিষয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও প্রত্যক্ষ ও জোরদার হয়।
১৯৬০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর তারিখে অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২) বাংলা একাডেমির পরিচালক পদে নিযুক্তি লাভ করেন। তাঁর মেয়াদ কাল ১৫.১২.১৯৬০ থেকে ১৪.০২.১৯৬৭ তারিখ পর্যন্ত। এ সময়কালে একাডেমির বর্ধমান হাউসের দ্বিতলা ভবনের ওপরে তৃতীয় তলা নির্মিত হয়েছিল এবং সেখানে একটি মঞ্চ ও মিলনায়তন প্রতিষ্ঠা করা হয়। এভাবে বাংলা একাডেমি আইন, ১৯৫৭ (সংশোধিত ১৯৬০) দিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ই মে পর্যন্ত একাডেমির কার্যপ্রণালী পরিচালিত হতে থাকে।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বাংলা একাডেমিকে একটি বৃহৎ পরিসরে গড়ে তোলার জন্য দেশের জাতীয় পুনর্গঠনের সাথে বাংলা একাডেমির পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধোত্তর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনে নিরন্তরভাবে চেতনা ও অনুপ্রেরণাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমির ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক মমত্ববোধ ছিল।
এ লক্ষ্যেই ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পরপরই বাংলা একাডেমির পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৭ই মে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি The Bengali Academy Act, 1957 (Amendment 1960) রদ করে The Bangla Academy Order, 1972 (President’s Order No 44 of 1972) জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে বাংলা একাডেমির কাঠামো ও কার্যপ্রণালীতে বিস্তৃত পরিসরে পরিবর্তিত হয়। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে The Bangla Academy Order, 1972 প্রবর্তিত হওয়ার ফলে ১৭ই মে ১৯৭২ তারিখে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড বাংলা একাডেমির সঙ্গে একীভূত হয়। উভয় প্রতিষ্ঠানের জনশক্তি এবং বিভাগসমূহ নতুন করে সমন্বিত হয়। ১৯৭২ সালের ১৭ই থেকে বাংলা একাডেমির পরিচালকের পদটি মহাপরিচালক পদে উন্নীত করা হয়। এ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান (এখন সভাপতি) অধ্যাপক মযহারুল ইসলাম (১৯২৮-২০০৩) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনিই বাংলা একাডেমির প্রথম মহাপরিচালক। তাঁর মেয়াদকাল ০২.০৬.১৯৭২ থেকে ১২.০৮.১৯৭৪ তারিখ পর্যন্ত। ১৯৭২ সালের প্রবর্তিত বাংলা একাডেমি আইনের অনুচ্ছেদ ছিল ২৬টি।
এই আইনের অনুচ্ছেদ ৩ (১০) অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডকে বাংলা একাডেমির সাথে সমন্বিত করা হয়। এতে করে দুই প্রতিষ্ঠানের জনশক্তি ও বিভাগসমূহ সমন্বিত হয়।
আইনের অনুচ্ছেদ ১১ অনুযায়ী একাডেমির নির্বাহী প্রধান হিসেবে মহাপরিচালকের পদ সৃষ্টি করা হয়।
এই আইনের অনুচ্ছেদ ৯ (১) অনুযায়ী বাংলা একাডেমির কাউন্সিলের নাম পরিবর্তন করে কার্যনির্বাহী পরিষদ করা হয়।
আইনের অনুচ্ছেদ ৬ (১) অনুযায়ী ডিপার্টমেন্টগুলোর নাম হয় ডিভিশন এবং ১৫ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ডিভিশনগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয় একাধিক পরিচালকদের। আইনে ১০টি বিভাগ সৃষ্টি করা হয় এবং প্রয়োজনে আরও বিভাগ সৃষ্টি করা যাবে। এই আইনের অনুচ্ছেদ ১০ অনুযায়ী একাডেমির সেক্রেটারির পদটি নামকরণ হয় সচিব।
আইনের অনুচ্ছেদ ৩ (১) অনুযায়ী একাডেমির জন্য একটি অভিন্ন সিলমোহরের বিধান ছিল। ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমির জন্য গৃহীত প্রতীকটিতে পাকিস্তানি আদর্শের ধ্যান-ধারাণা ছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর একাডেমির প্রতীক পরিবর্তনের চিন্তা করা হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতিকে প্রতিফলিত করার জন্যই বাংলা একাডেমির প্রতীক পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয়।
একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতীকের মর্যাদা অপরিসীম। ১৯৭৩ সালে গৃহীত বাংলা একাডেমির প্রতীকটি বর্তমানে প্রচলিত। এ প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমির নামের বানান নিয়ে কথা বলা আবশ্যক। বাংলা ও একাডেমি এ দুটি শব্দের বানান বাংলা একাডেমির শুরু থেকেই ছিল। ১৯৫৮ সালে গৃহীত বানান বাঙ্লা একাডেমী এবং ইংরেজিতে Bengali Academy, ১৯৭৩ সালে গৃহীত বানান বাংলা একাডেমী এবং ইংরেজিতে Bangla Academy; বর্তমানে বাংলা একাডেমি এবং ইংরেজিতে Bangla Academy ব্যবহৃত হচ্ছে।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে জারিকৃত উৎকৃষ্ট গণতান্ত্রিক আইনটি দিয়ে বাংলা একাডেমি পরিচালিত হতে ছিল। কিন্তু স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে (১৯২০-১৯৭৫) সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশের অগ্রগতি, জাতির অগ্রগতির চাকা উল্টো যাত্রা শুরু হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে বাংলা একাডেমির চারিত্রিক পরিবর্তনের সূচিত হয় এবং এই প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তার অস্তিত্বের বহুলাংশের বিলোপ ঘটানোর চেষ্টা হয়। একুশের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতি থেকে এ প্রতিষ্ঠানকে দূরে সরিয়ে রাখার অপচেষ্টা করা হয়। এসব বাধা বিঘেœর মধ্যেও বাংলা একাডেমি মাথা উঁচু করে কর্তব্যসাধন করেছে। এ সময়ই এদেশে বাংলাদেশি জাতি এই তত্ত্বের আমদানি করা হয়। অথচ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশি জাতি নামক কোনো জাতি পাওয়া যায় না; তবে বাঙালি জাতির, বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি অস্তিত্ব পাওয়া যায়। স্বাধীনতা-সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই আমরা সবাই বাংলাদেশি কিন্তু জাতিগত হিসেবে অবশ্যই বাঙালি।
এরই অনুবৃত্তিক্রমে ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট পরবর্তীকালে ১৯৭৮ সালের ৬ই জুন রাষ্ট্রপতি ‘The Bangla Academy Order, 1972’ (President’s Order No 44 of 1972) রদ করে ‘The Bangla Academy Ordinance, 1978’ (Ordinance No xix of 1978) জারি করেন। ১৯৭২ সালের বাংলা একাডেমি অর্ডার রদ হয়ে ১৯৭৮ সালে নতুন অর্ডিন্যান্স ‘দি বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮ প্রবর্তিত হলো। এই আইনে বাংলা একাডেমির কার্যপ্রণালী পরিবর্তন আনয়ন করা হয়।
আইনে বাংলা একাডেমির বিভাগসমূহের সংখ্যা অপরিবর্তিত রাখা হলেও একাডেমির কর্মবণ্টন ও কার্যসাধন বৃদ্ধি পায়নি। এই আইনের ধারা ২৩ অনুযায়ী বাংলা একাডেমিকে সরকারের পূর্ব অনুমতিক্রমে প্রবিধানমালা প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রবিধানমালা প্রণয়ন করা হলেও তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়নি। তবে এ আইনের বলে ১৯৮০ সালের ২০শে নভেম্বর তারিখে বাংলা একাডেমি কল্যাণ তহবিল প্রবর্তন সংক্রান্ত বিধিসমূহ কার্যনির্বাহী পরিষদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়। পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমির সাংগঠনিক কাঠামো এবং বাংলা একাডেমির আইনের পরিবর্তন করা হয়। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশে এই পরিবর্তন হয়েছিল।
১৯৮৩ সালের ২৫মে তারিখে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশক্রমে বাংলা একাডেমির বিভাগসমূহের সংখ্যা বিলুপ্তিপূর্বক সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমির বিভাগসমূহ বিলুপ্ত করে ৪টিতে গঠন করা হয় এবং গ্রন্থাগারকে পৃথক করা হয়। এই আদেশের ফলে বাংলা একাডেমির জনবল কমিয়ে দেওয়া হলো। ১৯৮৩ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশে ‘The Bangla Academy Ordinance, 1978 -এর কতিপয় ধারা সংশোধন করে করা হয়। এতে বাংলা একাডেমি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৮-এর ধারা ৯ (১), ৯ (৩), ১০ (৩), ১৬ (৫) এবং ১৬ (৬) সংশোধন যথাক্রমে বার্ষিক সাধারণ সভা, বার্ষিক সভার কোরাম, একাডেমির নির্বাচিত সদস্যদের কার্যকালের মেয়াদ, চেকের স্বাক্ষর সম্পর্কিত এবং স্থায়ী অগ্রিম ইত্যাদি প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে সংশোধন হয় বলে উক্ত সংশোধনে উল্লেখিত হয়।
অতঃপর ১৯৮৩ সালের ২৬শে ডিসেম্বর তারিখে বাংলা একাডেমিতে এনাম কমিটির রিপোর্ট কার্যকর হওয়ার ফলে বাংলা একাডেমির সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস করা হয়। ফলে বাংলা একাডেমিতে ৪ জন পরিচালকের নিয়ন্ত্রণাধীনে ৪টি বিভাগ, পরিচালকের সমমর্যাদা সম্পন্ন প্রধান গ্রন্থাগারিকের নিয়ন্ত্রণাধীন গ্রন্থাগার, মহাপরিচালকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীনে সমন্বয় ও জনসংযোগ উপবিভাগ এবং সচিবের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিষদ উপবিভাগ, হিসাবরক্ষণ ও বাজেট উপবিভাগ এবং বিপণন ও বিক্রয়োন্নয়ন উপবিভাগ করা হয়। এছাড়া উপপরিচালকের পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণাধীনে বাংলা একাডেমি প্রেসটি কারখানা আইন, ১৯৬৫-এর অনুরূপ নিয়মে পরিচিালিত হয়ে এসেছে। পরবর্তীকালে ১৯৯৪ সালে একাডেমির সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণ করার পর প্রেসটি একাডেমি নির্ধারিত বিধি অনুযায়ী পরিচালিত হয়।
১৯৭৮ সালের আইনের ধারা ২৩-এর ক্ষমতাবলে বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ ১৪ই আশ্বিন ১৩৯১ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১লা অক্টোবর ১৯৮৪ তারিখে বাংলা একাডেমি ‘চাকুরি (অবসরভাতা ও আনুতোষিক) বিধিমালা, ১৯৮৪ প্রণয়ন ও জারি হয়। উল্লেখ্য, এ সময় জানুয়ারি ১৯৮০ সালে বাংলা একাডেমির একটি শাখা চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে সরকারের ২৫.০৫.১৯৮৩ তারিখের ৬৫০১/৩ বি-একাডেমি এমএল-২ সংখ্যক নির্দেশের ৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে বাংলা একাডেমির চট্টগ্রাম শাখার বিলুপ্তি ঘটে। এরপর এই শাখাটি একাডেমি পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে পরিচালিত হয়।
একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের ২৩.০৮.১৯৯০ তারিখের সভায় দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় শহরে একাডেমির পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশ অনুসারে খুলনা ও কুষ্টিয়ায় পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সংস্কৃতি বিষয়াবলি সম্পর্কিত সরকারের স্থায়ী কমিটির ২নং সাব কমিটির ৩১.১১.১৯৯২ তারিখের অনুষ্ঠিত তৃতীয় বৈঠকে মাননীয় সংসদ সদস্যদের সুপারিশক্রমে বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে একাডেমির পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয় এবং এই বিক্রয়কেন্দ্রের সম্প্রসারণ হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও একটি পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র খোলা হয়। পরবর্তীকালে পর্যায়ক্রমে ঢাকার বাইরে বাংলা একাডেমির পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর বিলুপ্তি ঘটে।
এভাবে ১৯৭৮ সালের অডিন্যান্স অনুযায়ী বাংলা একাডেমি দীর্ঘদিন যাবৎ পরিচালিত হয়ে এসেছে। দীর্ঘ কয়েকদশক এ আইনে চলার পথে নানা অসুবিধা ছিল। এ আইনে একাডেমরি সদস্যভুক্তির কোনো সুষ্ঠু বিধান ছিল না। অথচ একাডেমির কার্য নির্বাহী পরিষদের একটি বড় অংশ সদস্যদের মধ্য থেকে আসতেন। বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে এই আইন যুগোপযোগী, সময়োপযোগী করার চেষ্টা অনেক দিন ধরে চলেছিল। এই অধ্যাদেশটি সংশোধনপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণীত হবার কথা বহুদিন ধরে চেষ্টা চলেছিল।
এ লক্ষ্যে একাডেমির জন্য নতুন খসড়া আইন প্রস্তুত করে সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন অনেক দিন ধরেই ছিল। বিভিন্ন সময়ে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বারবার উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আইনের ক্ষেত্রটি জটিলতর হওয়ায় আলোর মুখ দেখেনি। পূর্বাপর চেষ্টার ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান (১৯৪০-২০২১) ২৪শে মে ২০০৯ সালে মহাপরিচালক হয়ে এলে তাঁরই মেয়াদকালে দীর্ঘ ৩৫ বছর পর ৭ই আশ্বিন ১৪২০ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ২২শে সেপ্টেম্বর ‘The Bangla Academy Ordinance, 1978 রদ করে জাতীয় সংসদে বাংলা একাডেমির জন্য প্রথম বাংলায় রচিত বাংলা একাডেমি, বিল, ২০১৩ পাস হয়। আইনের কাজটি শামসুজ্জামান খানের নিখুত পরিকল্পনায় এসেছিল। তিনি একাজে প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
বাংলা একাডেমির ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬২ বছর পর বাংলায় বাংলা একাডেমির জন্য আইন জারি হলো। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ (২০১৩ সালের ৩৩নং আইন) প্রবর্তিত হওয়ার ফলে বাংলা একাডেমির দীর্ঘ দিনের দাবি পূরণ হয়।
এদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাণশক্তিই হলো জাতীয় সংসদ। জাতীয় সংসদ প্রণীত আইনে সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যগণ মতামত ব্যক্ত করেন এবং আইন কয়েকবার নিখুঁতভাবে পাঠপূর্বক পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়। এ কারণে অধ্যাদেশ আকারে প্রণীত আইনের চেয়ে সংসদ প্রণীত আইন কার্যকর ও যুগোপযোগী বেশি। অধ্যাদেশ আকারে প্রণীত আইন সংসদ প্রণীত আইনের মতো প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করা হয় না। একাডেমির ১৯৭৮ সালের আইনটি অধ্যাদেশ ছিল।
বর্তমান বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ একাডেমির জন্য কার্যকর ও সময়োপযোগী একটি আইন। বর্তমানে বিদ্যমান এই আইনটি অনুযায়ী বাংলা একাডেমি পরিচালিত হচ্ছে। এই পর্যায়ে বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এর সাধারণ আলোচনা করার প্রয়াস করেছি।
উল্লেখ্য বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এর আইনের বিভিন্ন দিককার সামগ্রিক আলোচনা, ব্যাখ্যা বা ভাষ্য বক্ষ্যমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ গাজী শামছুর রহমানের (১৯২১-১৯৯৮) বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে এ আলোচনা লেখার প্রেরণা লাভ করেছি।
এ আলোচনা অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে এবং একাডেমিক আলোচনা। বাংলা একাডেমির জন্য বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ হলো মৌলিক আইন। বাংলাদেশের সংবিধান ছাড়া একাডেমির বর্তমান আইনটি একাডেমির অন্য কোনো আইনের অধীনে নয়। বরং একাডেমির জন্য এ আইন বলে প্রণীত বা প্রণীতব্য অন্যসব আইন এই আইনের অধীন। ২০১৩ সালের ৩৩নং আইন হচ্ছে বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩। এই আইন প্রবর্তনের তারিখ ২২.০৯.২০১৩; এই আইনের পূর্বে একাডেমির জন্য যে আইন কার্যকর ছিল তা এ আইনের ৪৩ ধারা বর্ণিত হয়েছে। উক্ত আইন বর্তমান আইন প্রবর্তনের তারিখে রদ হয়ে গেছে।
বর্তমান এই আইনের ৪৩টি ধারা রয়েছে। নিম্নে তা ধারা অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হলো। এই আইনের ধারা ১-এর উপধারা ১ ও ২-এর মূলকথা হলো : এ আইনটি অবিলম্বে প্রবর্তিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ গেজেট প্রকাশের তারিখ থেকে এ আইন কার্যকরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা ক্ষমতা অর্জন হয়ে গেছে। ‘বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩’ শীর্ষক আইনটি ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ (০৭ই আশ্বিন, ১৪২০) তারিখে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং সেদিন থেকেই কার্যকর করা হবে। এই আইন একাডেমির মহাপরিচালক থেকে আরম্ভ করে অধীনস্ত সকলের জন্য প্রযোজ্য। এমনকি সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য। কারণ সেবা প্রত্যাশীদের এ আইন সম্পর্কে ধারণা না থাকলে তারা সেবা গ্রহণের জন্য কোথায়, কার কাছে যাবেন এবং সেবা কিভাবে নিবেন এ বিষয়গুলো আইনে ও প্রণীতব্য বিধানে থাকে। পৃথিবীজুড়ে রেওয়াজ যে, যেদিন আইন কার্যকর হয় ঐ দিন থেকে তা সকল নাগরিক জানেন বা জানতে হয়। সে জন্য সর্বসাধারণের অবগতির জন্য আইন গেজেটে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
এই আইনের ধারা ২-এর উপধারা ১ থেকে ১৪ পর্যন্ত এ আইনে ব্যবহৃত ১৪টি শব্দের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। এ শব্দগুলোর সংজ্ঞা এ আইনে নির্দিষ্ট করে দেওয়া আছে। প্রত্যেক আইনের এরকম সংজ্ঞা থাকে। ‘The Bangla Academy Ordinance, 1978)-এর অনুচ্ছেদ ১৫২-তে সংবিধানে ব্যবহৃত শব্দের ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে। The General Clauses Act, 1897 (Act No. x of 1897) সর্বতোভাবে একটি ব্যাখ্যার আইন (Interpretation Act); সুতরাং বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এর ধারা ২-এর উপধারা ১ থেকে ১৪ পর্যন্ত শব্দগুলো একাডেমির এ আইনের বিধানমতে যে ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে তা এখানে প্রযোজ্য হবে।
এ আইনের ধারা ৩-এর উপধারা ১ থেকে ২ তে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা, অভিন্ন সিলমোহর, সম্পত্তি অর্জন ও হস্তান্তর, মামলা রুজু করার অধিকার স্বীকৃত রয়েছে। বাংলা একাডেমি নামক সংবিধিবদ্ধ সংস্থার প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় হলো সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। একাডেমি এ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমির একটি অভিন্ন বা সাধারণ সিলমোহর বা প্রতীকের বিধান এ ধারায় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমি একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠান বা বিমূর্ত সংস্থা এবং প্রাণহীন ব্যক্তি।
একাডেমি সংস্থা একইসঙ্গে প্রাণহীন ব্যক্তি হওয়ার কারণে এ প্রতিষ্ঠান মামলা করতে পারে। একাডেমি কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। তদ্রুপ কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা একাডেমির বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। তবে উভয় ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি এই নামে মামলা দায়ের করতে হবে। এ ধরনের মামলা করার জন্য যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় তার বর্ণনা দেওয়ানী ও ফৌজদারি কার্যবিধি আইনে বর্ণিত আছে।
এ ধারার বিধান অনুসারে একাডেমি নির্বাহী কর্তৃত্বের বলে সম্পত্তি গ্রহণ, বিক্রয়, হস্তান্তর করতে পারবে। কেননা, আইনের দৃষ্টিতে একাডেমি একজন কৃত্রিম ব্যক্তি। সে হিসেবে এ অধিকার একাডেমির একান্ত ব্যক্তিগত অধিকার।
একাডেমির এ আইনে ধারা ৪-তে প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা দেওয়া আছে। এ প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় হবে এবং এ ধারা অনুযায়ী এ প্রতিষ্ঠানের কোনো শাখা খোলা সম্ভব নয়। তা করতে গেলে এ আইনের বিধানে তা সংশোধনসহ যুক্ত করতে হবে।
আইনের ধারা ৫-তে বাংলা একাডেমি তৈরি বা গঠন পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। একাডেমির সভাপতি, নির্বাহী পরিষদের সভাপতি, ফেলো ও সদস্য এরা সবাই মিলে বাংলা একাডেমি তৈরি বা গঠন করেন। এ ধারানুযায়ী গঠিত এ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে এক ব্যক্তি রয়েছেন, তিনি একাডেমির সভাপতি, তারপর নির্বাহী পরিষদের সভাপতি, তিনি একাডেমির মহাপরিচালক, অতঃপর ফেলো ও সদস্য। এ সমস্ত ব্যক্তিবর্গের যোগ্যতা, দায়িত্ব, অধিকার এবং কর্তব্য এই আইনে বর্ণনা করা হয়েছে।
আইনের ধারা ৬-এর উপধারা ১ থেকে ৬ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির সভাপতি নিয়োগ, মেয়াদ, দায়িত্ব কর্তব্য, পদত্যাগ, অপসারণ, ইত্যাদি বিধান বিধৃত। একাডেমির সভাপতির মর্যাদা অতুলনীয়। তাকে একাডেমির কিছু কিছু কাজ অনুমোদন করতে হয়। প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত, সাহিত্যিক অথবা স্বাধীনতাপদক বা একুশে পদকপ্রাপ্ত মেধাবী ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে রাষ্ট্রপতি সভাপতি নিয়োগ করবেন। সভাপতি তাঁর কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে ৩ বছর পর্যন্ত স্বীয় পদে থাকবেন। তবে উক্ত মেয়াদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি তাঁকে তাঁর পদ হতে অপসারণ করতে পারবেন।
একাডেমির সভাপতিও উক্ত মেয়াদের মধ্যে যে কোনো সময় পদত্যাগ করতে পারবেন। তবে তা রাষ্ট্রপতিকে সম্বোধন করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে হতে হবে। সভাপতির অপসারণ এই ধারায় বিবৃত হয়েছে। অপসারণ বলতে গুরুতর অভিযোগ, যা সভাপতির উপরই শুধু প্রযোজ্য। সভাপতির অপসারণ করতে হলে নিম্মবর্ণিত পদ্ধতি স্তরের পর স্তর নিখুঁতভাবে অবলম্বন করতে হবে।
ক) সভাপতি বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ লঙ্ঘন করেছেন। খ) গুরুত্বর অসদাচরণ করেছেন। এরূপ অভিযোগ থাকতে হবে। এরূপ অভিযোগ না থাকলে প্রস্তাবটি টিকিবেনা।
গ) সাধারণ পরিষদের মোট সদস্যের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের দ্বারা সমর্থিত অভিযোগের বিবরণ সম্বলিত প্রস্তাবের নোটিশ লিপিবদ্ধ করবেন। এতে তাঁরা স্বাক্ষর করবেন এবং তা নির্বাহী পরিষদের নিকট প্রদান করবেন। নির্বাহী পরিষদ উক্ত অভিযোগ রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরণ করবেন।
রাষ্ট্রপতি তার আচরণ বিবেচনা করবার জন্য উক্ত প্রস্তাব মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তা আদালতে বা নিজে নিষ্পত্তি করবেন। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। মহান, স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ, ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতি ইত্যাদি একাডেমির আর্দশ। সুতরাং আদর্শগত কারণে সভাপতির বিরুদ্ধে উপযুক্ত অভিযোগর প্রমাণ পাওয়া গেলে তিনি সভাপতির পদে থাকতে পারবেন না।
নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্তের আলোকে একজন ফেলো সভাপতির দায়িত্বপালন করবেন নিম্মবর্ণিত সময়ে :
ক) সভাপতির পদ শূন্য হলে, কিংবা (খ) সভাপিত অনুপস্থিত থাকলে, গ) সভাপতি অসুস্থ বা অন্য কারণে তিনি দায়িত্বভার প্রতিপালনে অসমর্থ হলে।
উল্লেখ্য, সভাপিত তার কার্যভার গ্রহণ করলে কিংবা ক্ষেত্রমত নব নিযুক্ত সভাপতি কার্যভার গ্রহণ করলে ফেলো এই দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাবেন।
আইনের ধারা ৭-এর উপধারা ১ থেকে ৫ পর্যন্ত একাডেমির ফেলোদের বিষয়ে বর্ণনা বিধৃত। একাডেমির ফেলোদের মর্যাদা উচ্চ। ফেলোশিপ চাঁদার বিনিময়ে প্রাপ্তযোগ্য নয়। বাংলাদেশের গুণী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনক্রমে প্রতিবছর ৭ জন ব্যক্তিকে সম্মানিক ফেলো করা যাবে।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তি নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনক্রমে ফেলো করা যাবে। তবে কোনো ব্যক্তিকে মরণোত্তর সম্মানিক ফেলো করা যাবে না। কোনো ফেলো একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে তার ফেলো হিসেবে ভোটাধিকার স্থগিত থাকবে। কোনো ফেলো একাডেমির সভাপতিকে সম্বোধন করে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রের মাধ্যমে পদত্যাগ করতে পারবেন।
ধারা ৮-এর উপধারা ১ থেকে ৩ পর্যন্ত জীবনসদস্য ও সদস্য হওয়ার যোগ্যতার বর্ণনা আছে। একাডেমি আইনের এ ধারায় দু’ধরনের সদস্যের কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় বিধানুসারে প্রতিবছর ২১ জন ব্যক্তিকে সদস্য করা যাবে। উল্লেখ্য, প্রতি ৩ বছরের সদস্যের সংখ্যা যা হবে উক্ত ৩ বছর কাল শুরুর পূর্বে মোট সদস্যর সংখ্যা যা ছিল তার ৫% বেশি সদস্য বৃদ্ধি করা যাবে না।
জীবন সদস্য ও সদস্য পদ লাভের যোগ্যতা অযোগ্যতা-
ক) ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সাংবাদিকতা, সামাজিক বিজ্ঞান অথবা জ্ঞানের বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান।
খ) তিনি বাংলাদেশের নাগরিক
গ) তিনি অন্যূন ৩০ বছর বা তদুর্ধ্ব বছর এই যোগ্যতাসমূহের অধিকারী নাগরিক নির্ধারিত পদ্ধতিতে একাডেমির সদস্যপদ লাভ বা অব্যাহতি গ্রহণ করতে পারবেন।
ঘ) কোনো সদস্যের তার সদস্যপদ বাতিল অথবা তিনি সদস্যপদ হতে অব্যাহতি বা পদত্যাগ করলে তিনি পুনর্বার সদস্যপদ পাবার অযোগ্য।
আইনের ধারা ৯-এর উপধারা ‘ক’ থেকে ‘গ’ পর্যন্ত সদস্যপদ বাতিল হওয়ার কারণ বর্ণনা আছে। নিম্নবর্ণিত কারণে সদস্য হওয়ার পরও একাডেমির কোনো সদস্যের সদস্য পদ বাতিল করতে পারে।
ক) নৈতিক স্খলনের অভিযোগে যার অন্যূন ৬ মাস কাল সাজা হয়েছে, তিনি সদস্য হওয়ার বা থাকবার অনুপযুক্ত, কেননা সদস্যগণ একাডেমি গঠনে ভূমিকা রাখেন, তাঁকে চোর, ডাকাত, গুন্ডা-বদমাইস, অসদাচারী, দুর্বৃত্ত হলে চলে না।
খ) রক্ষক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই সংগ্রামের আদর্শ, সংবিধানের মূলনীতি ইত্যাদি দেশের আদর্শ, বাংলা একাডেমির আদর্শ।
কেননা, বাংলা একাডেমির একটি আদর্শিক ও চেতনাগত দিক রয়েছে। মহান একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একাডেমি ধারণ করে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরোধীদের একাডেমির সদস্যপদে থাকবার বা হওয়ার অনুপুযুক্ত।
গ) কোনো সদস্য সদস্য পদ লাভের পরও নির্ধারিত যোগ্যতার সঙ্গে অসঙ্গতি দেখা দিলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে।
এ আইনের ধারা ১০-এর উপধারা ১ থেকে ২২ পর্যন্ত একাডেমির কার্যাবলি বিধৃত করা হয়েছে। ভাষা শহিদদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা একাডেমি। এদেশের মানুষের পরিচয় একাডেমি বহন করছে। বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের আপামর মানুষের প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্যের নিরিখে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির লালন পালনে অঙ্গীকারাবদ্ধ।
এদেশের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশ ঘটানোর একমাত্র প্রতিষ্ঠান। বাংলা একাডেমি বাঙালির হাজার বছরের বহুমাত্রিক এবং বহুতলবিস্তারী সংগ্রামের অবিনাশী ধারা ও মানবিক চৈতন্যে ভাস্বর এক অনন্য জাতীয় প্রতিষ্ঠান। বহুত্ববাদী চেতনায় দীপ্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরভিত্তিতে গঠিত জাতিসত্তায় ঋদ্ধ এই প্রতিষ্ঠান। একাডেমির কাছে এদেশের মানুষের গভীর প্রত্যাশা। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও বাঙালি মনীষার মানবমুখী সমন্বয়বাদী উৎসবের অনুসন্ধান এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এই প্রতিষ্ঠান নিয়ত কর্মরত।
বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা আপামর জনসাধারণের আশা পূরণ করবে। দক্ষ প্রতিভাবান ও প্রশিক্ষিত গবেষক, অনুবাদক এবং সংস্কৃতিমনস্ক জাতি গড়ে তোলবে। ভাষা সাহিত্য-সংস্তৃতি এবং লোকমানুষের উন্নতি মানসম্মত চর্চা, গবেষণা ও অনুবাদ এবং বাঙালি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস রচনা ও তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ বাংলা একাডেমির কাজ। একাডেমিকে যুগের চাহিদার নিরিখে সময়োপযোগী সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, আধুনিকতা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে উন্নত মানসম্পন্ন গবেষণা কার্যক্রমের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন করবে।
এই আইনের ধারা ১১-এর বিধানুযায়ী বাংলা ভাষার উৎকর্ষ, লালন, পালনের মুখ্য প্রতিষ্ঠান একাডেমি। বাংলা ভাষার-বানান প্রমিতকরণ উৎকর্ষসাধন এবং বাংলা ভাষার অভিধান প্রণয়নের বিষয়ে এ ধারায় আইনগতভাবেই একমাত্র প্রতিষ্ঠানরূপে অভিহিত করা হয়েছে।
অভিধান একটি জাতিকে মননের দৃঢ়তা দেয়। অভিধান নিয়ে একাডেমির কাজের বড় একটা দিক। বাংলা একাডেমি এককভাবে এ দায়িত্ব পালন করছে। আইনের এ ধারা অনুযায়ী বাংলা বানান, প্রমিতকরণ, ইত্যাদি প্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে বাংলা একাডেমি অথরিটি প্রাপ্ত।
ধারা-১২-এর উপধারা ১ থেকে ৩ পর্যন্ত একাডেমির ৮টি বিভাগ এবং এ বিভাগগুলোর পুনর্গঠনের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ৮টি বিভাগ নিম্নরূপ : (ক) গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ (খ) অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ (গ) জনসংসযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ (ঘ) বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ (ঙ) সংস্কৃতি, পত্রিকা ও মিলনায়তন (চ) গ্রন্থাগার (ছ) ফোকলোর, জাদুঘর ও মহাফেজখানা (জ) প্রশাসন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও পরিকল্পনা বিভাগ।
এই আইনের অধীন এ ধারার আলোকে প্রয়োজনে নির্বাহী পরিষদ সরকারের পূর্বানুমোদন নিয়ে অতিরিক্ত বিভাগ গঠন ও পুনর্বিন্যাস করতে পারবে। আইনে এ ধারা নির্বাহী পরিষদকে এক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। একাডেমির প্রত্যেক বিভাগের দায়িত্ব ও কার্যাবলি প্রবিধান দ্বারা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
ধারা ১৩-তে গবেষণা কেন্দ্র বা ইনস্টিটিউট স্থাপনের বিষয়ে বিধৃত হয়েছে। বাংলা একাডেমির গবেষণা সম্পর্কিত কার্যাবলি ব্যাপক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত পরিচিতি আছে। আন্তর্জাতিক মানের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা কেন্দ্র বা ইনস্টিটিউট থাকা প্রয়োজন। বাংলা একাডেমিকে কেন্দ্র করে একটি ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা দীর্ঘ দিনের। আইনের এ ধারানুযায়ী এটি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে।
একাডেমিতে গবেষণা কেন্দ্র বা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হলে জ্ঞানের কোনো বিশেষ বিষয়ে মৌলিক গবেষণা সহায়ক হবে এবং ইহার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে এম.ফিল এবং পি.এইচ.ডি ডিগ্রিসহ পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি প্রদান করা যাবে। একাডেমির আইনের এ ধারানুসারে অনুবাদ গবেষণা কেন্দ্র বা ফোকলোর ইনস্টিটিউট, অনুবাদ কেন্দ্র ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা যাবে।
আইনের ধারা ১৪-তে একাডেমির মুদ্রণালয়ের বিষয়ে বিধৃত হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা প্রকাশের জন্য মুদ্রণালয় প্রয়োজন। একাডেমির মুদ্রণালয় হবে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর। মুদ্রাণালয়ের কম্পিউটার শাখা, বাইন্ডিং শাখা হবে আধুনিক। এ ধারার আলোকে বাংলা একাডেমি প্রেস বা মুদ্রণালয় কথাটির সাথে সাথে এ মুদ্রণালয় পরিচালনার প্রসঙ্গটিও আসবে।
আইনের ১৫ ধারার বিধান অনুযায়ী বাংলা একাডেমি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা প্রকাশের সহায়তা গ্রহণ ইত্যাদি করতে পারবে। এই ধারাটি একাডেমির আইনের ১০ ধারার সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করতে হবে। ধারা ১০-এ একাডেমির কার্যাবলি সম্পর্কে বিধৃত আছে। বাংলা একাডেমি এই বিধির আলোকে কার্যক্রম গ্রহণ করার পূর্বে সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিতে হবে।
ধারা ১৬-এর উপধারা ১ ও ২ বিধানানুযায়ী বাংলা একাডেমি চেয়ার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমমর্যাদাসম্পন্ন হয়। বাংলা একাডেমি দেশে-বিদেশে সুপরিচিত একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। একাডেমিতে চেয়ার প্রতিষ্ঠা করার যুগোপোযুগী বিধান। তবে এই চেয়ার প্রতিষ্ঠা করা যাবে শর্ত সাপেক্ষেÑ
ক) নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত হতে হবে।
খ) প্রণীত বা প্রণিতব্য প্রবিধানমালায় বা বিধিসমূহে উল্লেখ থাকবে।
গ) চেয়ার নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হবে,
ঘ) বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এ চেয়ারে নিয়োগ প্রদান করা যাবে।
আইনের ধারা ১৭-এর বিধান অনুযায়ী বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও সম্মাননা প্রদান করতে পারবে। এ ধারাটি এই আইনের ধারা ১০-এর উপধারা ১৬-এর সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে হবে। এখানে পুরস্কার ও সম্মাননা বিষয়টি বিস্তৃত এবং বিশেষ অর্থে বুঝার প্রয়োজন। পুরস্কার ও সম্মাননা বলতে পদক, খেতাব, ইত্যাদিকেও বুঝাবে।
একাডেমির প্রচলিত বিধি, প্রণীতব্য বিধি অনুযায়ী বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি ও বাংলা ভাষার জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য বিখ্যাত লেখক, প-িত ভাষাবিদকে পুরস্কার এবং সম্মাননা প্রদান করা যাবে।
বিদেশিকে পুরস্কার ও সম্মাননা শর্তসাপেক্ষে প্রদান করা যাবে। তবে এই শর্ত হবেÑ
ক) সরকারের পূর্ব অনুমোদন
খ) আইনের আলোকে প্রণীত প্রচলিত বিধি বা প্রণীতব্য বিধিতে এ সংক্রান্ত বিধান উল্লেখ করতে হবে।
আইনের ধারা ১৮-এর বিধান অনুযায়ী বিদেশি লেখক ও গবেষককে বাংলাদেশে আগমনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো যাবে। তবে এই কাজ শর্তসাপেক্ষে, (ক) নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত (খ) সরকারের পূর্বানুমোদন।
একাডেমিতে অনেক বিদেশি গবেষক এসেছেন এবং আসবেন। তাঁরা সবাই একাডেমিকে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রশংসা করছেন। সুতরাং একাডেমির আইনে ধারাটি সময়োপযোগী ও অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
আইনের ধারা ১৯-এর বিধান অনুযায়ী একাডেমির একটি সাধারণ পরিষদ গঠনের পদ্ধতি বিধৃত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে হবে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেতনাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমিও ইহার ব্যতিক্রম নয়। সাধারণ পরিষদ নিম্নবর্ণিত ব্যক্তিগণের সমন্বয়ে গঠন হবে-
ক) একাডেমির সভাপতি
খ) মহাপরিচালক
গ) ফেলো এবং
ঘ) সদস্য
উল্লেখ্য, সদস্য বলতে এখানে জীবনসদস্য ও সদস্যকে বুঝাবে।
এ আইনের ধারা ২০-এর ১ ও ২ উপধারায় সাধারণ পরিষদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সম্পর্কে বর্ণনা আছে। সাধারণ পরিষদ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন পরিষদ। এ পরিষদের ক্ষমতা ও দায়িত্ব পরিমাণে ব্যাপক। একাডেমির আইন এবং আইনের বলে প্রণীতব্য প্রবিধান ও বিধি আইনে এই পরিষদকে দায়িত্ব এবং ক্ষমতা দিয়েছে। সাধারণ পরিষদের দায়িত্ব দুই রকমÑ ক) একাডেমির কার্যাবলি তদারকি ও পর্যালোচনা এবং নির্বাহী পরিষদকে প্রয়োজনীয় দিক্-নির্দেশনা প্রদান করা। তদারকি, পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনা এই শব্দগুলোর ব্যবহার দ্বারা এ আইনে সাধারণ পরিষদকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে।
আইনের ধারা ২১-এর ১ থেকে ৭ উপধারায় সাধারণ পরিষদের সভা বিষয়ে বিধৃত হয়েছে। সাধারণ পরিষদের সভার কার্যাবলি নিম্নরূপ-
ক) সাধারণ পরিষদের সকল সভা একাডেমির প্রাঙ্গণে হবে। সভার তারিখ ও সময় মহাপরিচালক নির্বাহী পরিষদের সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হবে।
খ) প্রতি বছর সাধারণ পরিষদের কমপক্ষে একটি বার্ষিক সভা হবে। এই সভা একাডেমির প্রাঙ্গণে হবে। বার্ষিক সভা একাডেমির সাধারণ পরিষদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা। এ সভায় সদস্যগণ মন খোলে কথা বলেন।
গ) একাডেমির সভাপতি সাধারণ পরিষদের সকল সময় সভাপতিত্ব করবেন এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্তক্রমে একজন ফেলো সভাপতিত্ব করবেন।
ঘ) সাধারণ পরিষদের সভার বৈধতার জন্য কোরাম (Quorum) পূরণ করতে হবে। এ পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমপক্ষে এক-পঞ্চমাংশ সদস্যের উপস্থিতির প্রয়োজন। কোরামের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য উপস্থিত না থাকলে সাধারণ পরিষদের সভার কার্যক্রম চলতে পারে না।
ঙ) সাধারণ পরিষদের আলোচনাসূচি, বিষয়, ইত্যাদি মহাপরিচালক, নির্বাহী পরিষদের সাথে আলোচনা করে নির্ধারণ করবেন।
চ) সাধারণ পরিষদের প্রত্যেক সদস্যের একটি করে ভোট থাকবে। উপস্থিত ও ভোটদানকারীর সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তবে সমসংখ্যক ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী ব্যক্তির এ ধারার বিধানুযায়ী দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক একটি ভোট প্রদান করতে পারবে।
আইনের ধারা ২২-এর ১ থেকে ৫ উপধারায় তলবি সভার বিষয়ে বিধৃত হয়েছে। তলবি সভা বিশেষ কোনো পরিস্থিতি বা বিশেষ কোনো প্রয়োজনীয় কারণে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য হঠাৎ করে এসভা আহ্বান করা হয়। এ ধারার বিধান অনুযায়ী তলবি সভা হবে নিম্নরূপ শর্তসাপেক্ষে, ক) সাধারণ পরিষদের অন্যূন এক তৃতীয়াংশ কোনো বিষয়ে লিখিতভাবে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখপূর্বক স্বাক্ষর করে মহাপরিচালক বরাবর পত্রের মাধ্যমে তলবি সভা আহ্বান করার জন্য অনুরোধ করতে হবে।
মহাপরিচালক নির্বাহী পরিষদের সাথে আলোচনা করে, কমপক্ষে ১৫ দিনের মধ্যে তলবি সভার তারিখ ও সময় নির্ধারণ করবেন।
খ) উক্ত সময়ের মধ্যে মহাপরিচালক তলবি সভা আহ্বান করতে ব্যর্থ হলে তলবি আহ্বানকারী সদস্যগণ পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে সভা আয়োজন করতে পারবেন। তবে এ সময়ের মধ্যে সভা অনুষ্ঠিত না হলে তা বাতিল হবে।
গ) তলবি সভা আহ্বানের অন্যূন ৭ দিনে আগে সভার আলোচ্য সূচি যুক্ত করে লিখিত পত্র মারফত বা নোটিশ করে বা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সাধারণ পরিষদের সকল সদস্যকে জানাতে হবে।
ঘ) তলবি সভার বৈধতার জন্য কোরাম পূরণ নীতি প্রযোজ্য না। এজন্য অন্যূন অর্ধেক সদস্যের উপস্থিতির প্রয়োজন। অসাধারণ অতি বিশেষ বিষয়-আশয়ের ক্ষেত্রে তলবি সভা হয়।
ঙ) তলবি সভায় উপস্থিত ও ভোটদানকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। তবে সমসংখ্যক ভোটের ক্ষেত্রে তলবি সভার সভাপতির দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোটের ক্ষমতা থাকবে।
উল্লেখ্য, তলবি সভায় তলবি সভার জন্য প্রদত্ত তলবি পত্রের আলোচ্যসূচির বিষয় ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা করা যায় না।
আইনের ধারা ২৩-এর ১ থেকে ৭ উপধারার নির্বাহী পরিষদ ও এ পরিষদের নির্বাচন বিষয় বর্ণিত হয়েছে। উল্লেখ্য, নির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা ১৯জন হবে। তন্মধ্যে ৭ জন হবেন নির্বাচিত এবং ১২ জন হবেন মনোনীত। নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৭টি আসনের মধ্যে কেবল ২টি আসন মহিলা সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। এ ধারার বিধানুযায়ী একাডেমিতে বুদ্ধিবৃত্তিক গণতন্ত্র চর্চার পথ সুগম হয়েছে। নি¤েœ নির্বাহী পরিষদের সদস্য সংখ্যা উল্লেখ করা হলো-
ক) ফেলোগণ কর্তৃক ভোটে নির্বাচিত ৩ জন, তন্মধ্যে ১টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
খ) সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ভোটে নির্বাচিত ৪ জন, তন্মধ্যে ১টি আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।
গ) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা, ভাষাতত্ত্ব ও ইংরেজি বিভাগ এবং বিজ্ঞান অনুষদ হতে সরকার মনোনীত সদস্য একজন করে মোট ৪ জন।
ঘ) বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও বিশিষ্ট তথ্যপ্রযুক্তিবিদ হতে সরকার মনোনীত একজন করে মোট ২ জন
ঙ) বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী হতে নির্বাহী পরিষদ মনোনীত একজন করে মোট ২ জন
চ) সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, মনোনীত প্রতিনিধি অন্যূন যুগ্নসচিব পদমর্যাদার একজন করে মোট ২ জন
ছ) বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক সভাপতি হিসেবে ১ জন
জ) বাংলা একাডেমির সচিব, সদস্যসচিব হিসেবে ১জন
উল্লেখ্য, ফেলোগণ ও সাধারণ পরিষদের ভোটে নির্বাচিত সদস্যগণ নির্বাচিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত নির্বাহী পরিষদের প্রথম সভার তারিখ থেকে ৩ বছর মেয়াদের জন্য সদস্য হবেন এবং তাঁরা ২ মেয়াদের অধিকবার সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে পারবেন না। নির্বাহী পরিষদের কোনো সদস্য নির্বাহী পরিষদের সভাপতির বরাবরে সম্বোধন করে স্বাক্ষরযুক্ত লিখিত পত্রের মাধ্যমে পদত্যাগ করতে পারবেন।
নির্বাহী পরিষদের নির্বাচিত কোনো সদস্যের পদ, পদত্যাগ বা অন্য কোনো কারণে শূন্য হলে, উক্ত শূন্য পদ হবার ৩০ দিনের মধ্যে উক্ত পদে পূরণের জন্য নির্বাচন হবে এবং উক্ত পদে নির্বাচিত সদস্য অবশিষ্ট মেয়াদ পূরণ করবেন। তবে শূন্য পদের অবশিষ্ট মেয়াদ ৯০ দিন বা তার কম হলে ঐ শূন্য পদে নির্বাচন হবে না।
নির্বাহী পরিষদের মনোনীত সদস্যগণ সাধারণ পরিষদের সদস্য না হয়ে থাকলে, তারা নির্বাহী পরিষদের সদস্য থাকার সময়কাল সাধারণ পরিষদের সদস্য থাকবেন। একাডেমির সাধারণ পরিষদের সদস্য এবং নির্বাচিত প্রতিনিধি, সরকার মনোনীত বিশেষজ্ঞ ও প্রতিনিধিদের সমন্বয়েই গঠিত হয়েছে নির্বাহী পরিষদ। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি হলে নির্বাচিত প্রতিনিধি সদস্যগণ প্রতিনিধিত্ব করেন।
আইনের ধারা ২৪ এর ১ থেকে ২ উপধারা নির্বাহী পরিষদের কার্যাবলি বিধৃত আছে। একাডেমির নির্বাহী পরিষদের কাজ পরিমাণে ব্যাপক। একাডেমির আইনের বর্ণিত বিভিন্ন কার্যসাধনের জন্য একাডেমিকে প্রয়োজনীয় দিক্নির্দেশনা ও পরামর্শ প্রদান, একাডেমির বিভিন্ন সিদ্ধান্তগ্রহণ ও নীতি নির্ধারণ কার্যসাধনে সহযোগিতা প্রদান এবং সাহিত্য, সংস্কৃতি, গবেষণা ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
এছাড়া সাধারণ পরিষদে উপস্থাপনের জন্য একাডেমির বার্ষিক প্রতিবেদনটি নির্বাহী পরিষদকে অনুমোদন করতে হয়। সরকার কর্তৃক বা সাধারণ পরিষদ কর্তৃক প্রদত্ত কার্যসমূহ নির্বাহী পরিষদকে দায়িত্ব পালন করতে হয়।
নির্বাহী পরিষদ যৌথভাবে সাধারণ পরিষদের নিকট দায়ী থাকবেন। যে কোনো পরিষদ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবে এবং কারও না কারও নিকট দায়ী থাকতে হবে।
আইনের ধারা ২৫-এর ১ থেকে ৫ উপধারার বিষয়বস্তু হচ্ছে নির্বাহী পরিষদের সভা। এই সভার কাজ সিদ্ধান্ত গ্রহণ। নির্বাহী পরিষদের সভা এ পরিষদের সভাপতির অনুমোদন অনুযায়ী, সচিব নির্ধারিত পদ্ধতিতে নির্বাহী পরিষদের সভা আহ্বান করে থাকেন। নির্বাহী পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবার অধিকার নির্বাহী পরিষদের সভাপতির, তবে সভাপতিত্ব করবার অধিকার তিনি মনোনীত নির্বাহী পরিষদের কোনো সদস্যকে দিতে পারেন। এ সভায় দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে এবং যুক্তির আদান-প্রদান হতে পারে। নানা সিদ্ধান্ত হতে পারে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সেখানে প্রত্যেক সদস্যের ভোট একটি তবে সমসংখ্যক ভোটের ক্ষেত্রে সভাপতির নির্ণায়ক ভোটের ক্ষমতা আছে।
প্রতি বছর নির্বাহী পরিাষদের অন্যূন ৪টি সভা অনুষ্ঠিত হবে। সাধারণভাবে উপস্থিত নির্বাহী পরিষদের সদস্যের উপস্থিতিতে সভা হয়। অবশ্য এ পরিষদ সদস্যের এক-পঞ্চমাংশ সদস্য উপস্থিত না হলে কোরাম হয় না। কোরাম পূরণ না হলে এ পরিষদ সভায় কাজ চলতে পারে না।
আইনের ধারা ২৬ এর ১ থেকে ৩ উপধারায় মহাপরিচালক নিয়োগ, মেয়াদ, ইত্যাদি বিষয়ে বলা আছে। সরকার মহাপরিচালক নিয়োগ করবেন। মহাপরিচালক কার্যভার গ্রহণের তারিখ হতে ৩ বছর পর্যন্ত স্বীয়পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। একই ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি নিয়োগ লাভ করবেন না। তাঁর চাকরির শর্তের ভার সরকারের উপর নির্ভর করবে। মহাপরিচালকের যোগ্যতা নি¤œরূপÑ
ক) তিনি বাংলাদেশের নাগরিক হবেন,
খ) তিনি ফেলো হবার যোগ্য; অথবা প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ বা গবেষক হতে হবে।
মহাপরিচালক, সরকারের উদ্দেশ্যে পত্রযোগে পদত্যাগ করতে পারবেন। তবে পত্র হতে হবে তাঁর স্বাক্ষরযুক্ত এবং সরকারের উদ্দেশ্যে সম্বোধন করে লেখতে হবে। উল্লেখ্য, মহাপরিচালকের পদ যখন শূন্য বা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি তার কার্যভার সম্পাদনে অসমর্থ হবেন তখন সচিবকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক হিসেবে নবনিযুক্ত মহাপরিচালক কার্যভার গ্রহণ করা না পর্যন্ত কিংবা মহাপরিচালক পুনরায় কার্যভার গ্রহণ করা না পর্যন্ত কার্যসম্পাদন করবেন।
আইনের ধারা ২৭-এর ক থেকে জ উপধারায় মহাপরিচালকের দায়িত্ব সমূহের বর্ণনা বিধৃত আছে। মহাপরিচালক একাডেমির সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী বা প্রশাসনিক প্রধান। এ আইনে এ ধারাতে মহাপরিচালককে একাডেমির দায়িত্ব পালনে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করেছে। একাডেমির নির্বাহী কর্তৃত্ব মহাপরিচালকের উপর ন্যস্ত। সকল নির্বাহী ব্যবস্থা মহাপরিচালকের নামে গৃহীত হবে। তিনি একাডেমির কার্যাবলি সম্পাদনের জন্য দায়ী থাকবেন।
মহাপরিচালক নির্বাহী পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করবেন অথবা তিনি ঐ সকল সভায় মনোনীত কাউকে সভাপতিত্ব করতে বলতে পারবেন। তিনি একাডেমির উন্নয়ন সংক্রান্ত সকল বিষয় এবং প্রশাসনিক কার্যাবলির সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরিচালনা করেন। নির্বাহী পরিষদের সকল সিদ্ধান্ত বাস্তয়নের জন্য তিনি দায়ী থাকবেন। একাডেমির কার্যাবলি ও নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্তসমূহ তিনি সভাপতিকে জ্ঞাত করেন। প্রতিবছর একাডেমির কর্মকা-ের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করে তিনি তা নির্বাহী পরিষদের অনুমোদন করিয়ে নেন।
সাধারণ পরিষদ বা নির্বাহী পরিষদ যে সমস্ত বিষয়ে ক্ষমতা ও দায়িত্ব দেন সে সব কর্তব্য সম্পাদন করেন। তিনি এই আইন এবং এই আইন দ্বারা প্রণীত বিধি, প্রবিধানের বিধানাবলি নিশ্চিতরূপে প্রতিপালন করবেন।
আইনের ধারা ২৮-এর ১ থেকে ২ উপধারায় মহাপরিচালকের অপসারণের পদ্ধতি বিধৃত আছে। অপসারণ বলতে গুরুতর অভিযোগ, যা মহাপরিচালকের উপরই শুধু প্রযোজ্য হবে। অপসারণ করতে হলে নি¤œবর্ণিত পদ্ধতি স্তরের পর স্তর নিখুঁতভাবে অবলম্বন করতে হবে।
ক) মহাপরিচালক এই আইন লঙ্ঘন করেছেন,
খ) গুরুতর অসদাচরণ করেছেন। এরূপ অভিযোগ থাকতে হবে। এরূপ অভিযোগ না থাকলে প্রস্তাবটি টিকিবে না।
গ) নির্বাহী পরিষদের মোট সদস্যের অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ অভিযোগের বিবরণ স্বাক্ষর করবেন এবং তা সভাপতির নিকট প্রদান করবেন। সভাপতি উক্ত প্রস্তাব মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারকে অনুরোধ করবেন। সরকার তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ আদালতের মাধ্যমে বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে তাঁকে অপসারণ করবেন। এছাড়াও নিম্নবর্ণিত কারণে তাঁকে অপসারণ করা যাবে-
ক) কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দেউলিয়া হলে
খ) পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নিজ দায়িত্ব বহির্ভূত কোনো লাভজনক পদে থাকলে
গ) কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক অপ্রকৃতস্থ ঘোষিত হলে
ঘ) নৈতিক স্খলন জনিত ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে মহাপরিচালক পদ থেকে অপসারণ করা যাবে।
ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের আদর্শ, ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানের মূলনীতি, ইত্যাদি বাংলা একাডেমির আদর্শ। সুতরাং; এ আদর্শের কারণে উপর্যুক্ত অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে তিনি মহাপরিচালক পদে থাকতে পারেন না।
আইনের ধারা ২৯-এর ১ থেকে ৪ উপধারায় একাডেমির তহবিল বিষয়ে বিধৃত আছে। একাডেমি তহবিলের আয়ের উৎসসমূহ এধারায় বর্ণনা রয়েছে। এগুলো হলো সরকার কর্তৃক প্রাপ্ত অনুদান, সদস্য কর্তৃক প্রদত্ত চাঁদা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত অনুদান, সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশি সরকার বা সংস্থা কর্তৃক প্রাপ্ত অনুদান, একাডেমির নিজস্ব আয় এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রাপ্ত আয়, ইত্যাদি উৎস হতে প্রাপ্ত আয় তহবিলে জমা থাকবে।
তহবিলে জমাকৃত অর্থ এক বা একাধিক তফসিলি ব্যাংকে জমা রাখা যাবে এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে তহবিল পরিচালিত হবে। উল্লেখ্য, এ ধারার আলোচ্য তফসিলি ব্যাংক বলতে Bangladesh Bank Order, 1972 (P.O. No. 127 of 1972)-এর 2 (J) অনুচ্ছেদের বিধান প্রযোজ্য হবে। তহবিলের অর্থ হতে একাডেমির যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা যাবে এবং তহবিলের অর্থ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত খাতে বিনিয়োগ করা যাবে।
আইনের ধারা ৩০-এর ১ থেকে ৩ উপধারায় সচিব নিয়োগ, তাঁর চাকরির শর্তাবলি, তার দায়িত্বসমূহ, ইত্যাদি বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য সচিব নিযুক্ত হন এবং তিনি একাডেমির সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা।
এ ধারার বিধান অনুযায়ী সচিব, মহাপরিচালকের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও নির্দেশক্রমে সাধারণ পরিষদ এবং নির্বাহী পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দায়ী থাকবেন। তিনি সাধারণ পরিষদ ও নির্বাহী পরিষদের নির্দেশ মোতাবেক একাডেমির অন্যান্য কাজ করবেন।
নিম্নবর্ণিত সময়ে একাডেমির কোনো কর্মকর্তা, সচিবের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন-
ক) সচিবের পদ শূন্য হলে, বা
খ) সচিব অনুপস্থিত থাকলে
গ) তিনি অসুস্থ হলে, বা
ঘ) অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে।
সচিব তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করলে কিংবা ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করলে একাডেমির কর্মকর্তা এই দায়িত্ব হতে অব্যাহতি পাবেন।
আইনের ধারা ৩১-এর ১ থেকে ২ উপধারায় চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে বিধৃত আছে। এ বিষয়টি আলোচনার অপেক্ষা রাখে। চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগের ধারণা হলো কারিগরি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিকে নিয়োগ। এ ধারায় বিধান অনুযায়ী এই নিয়োগ নির্বাহী পরিষদের এখতিয়ারভুক্ত একটি বিশেষ ব্যবস্থা। তবে এ চুক্তির ব্যাপারেও আইনের নিয়ন্ত্রণ থাকে।
একাডেমিতে কোনো বিশেষায়িত পদে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন জনবল সংকট হলে উক্ত পদে নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনক্রমে বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা যাবে। এই নিয়োগের চাকরিটা সময়ভিত্তিক চাকরি, তাই এটাকে চুক্তিভিত্তিক বলা হয়। এটি সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য এবং সুনির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী হয়। এই চুক্তির মেয়াদ ২ বছর এবং কোনো ব্যক্তিকে ২ বারের বেশি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয় না।
আইনের ধারা ৩২-এর ১ থেকে ২ উপধারায় কর্মকর্তা, কর্মচারী-নিয়োগ, ইত্যাদি বিষয়ে প্রদত্ত হয়েছে। একাডেমির মহাপরিচালক ও সচিব সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং একাডেমির অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করেন একাডেমির কর্তৃপক্ষ। মহাপরিচালকের মেয়াদ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য।
একাডেমি আইন দিয়ে তৈরি করা একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানের আইনের ক্ষমতাবলে সরকার অনুমোদন সাপেক্ষে প্রণীত বা প্রণীতব্য বিধি, প্রবিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তবে কিছু কিছু কর্মকা-ের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব সরকারের আছে। একাডেমির কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ, ইত্যাদি একাডেমির আইনের বিধান অনুযায়ী সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সাংগঠনিক কাঠামো, প্রবিধান দ্বারা নির্ধারণ করা হবে।
আইনের ধারা ৩৩-এর বিধান অনুযায়ী একাডেমিকে চুক্তি সম্পাদন করবার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা ও সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং প্রতিনিধি প্রেরণ ইত্যাদি কার্য সাধনে চুক্তি সম্পাদন আবশ্যক। একাডেমি একাজ সম্পাদন করবে নির্বাহী কর্তৃত্বে। আইনের দৃষ্টিতে একাডেমি একটি প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে কৃত্রিম ব্যক্তি। চুক্তি শব্দটি ব্যাপক অর্থ বহন করে। গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানে দেশবিদেশের বিভিন্ন গবেষণামূলক, প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি ও নীতির উপর নির্ভর করে চুক্তি সম্পাদিত হবে।
চুক্তি সম্পাদন করবার জন্য যিনি বা যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত তিনিই চুক্তি সম্পাদন করবেন। চুক্তি কখনও মৌখিক নয়। চুক্তি অবশ্যই নির্দিষ্ট পদ্ধতি প্রণালীতে করতে হবে। কর্তৃত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত অন্য ব্যক্তি দ্বারা চুক্তি সম্পাদিত হবে না। একাডেমি আইনের এ ধারার বিধান অনুযায়ী শিক্ষা, গবেষণা, ইত্যাদি কর্মকাণ্ড সম্পাদনের জন্য সরকারের পূর্ব অনুমোদন সাপেক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে চুক্তি সম্পাদন করা যাবে।
আইনের ধারা ৩৪-এর প্রদত্ত বিধান অনুযায়ী একাডেমিকে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। তবে এ ঋণ গ্রহণ নির্দিষ্ট পদ্ধতিও প্রণালিতে গ্রহণ করতে হবে-
ক) সরকারের পূর্বানুমোদন
খ) পূর্বের বছরের অডিট রিপোর্ট বা হালনাগাদ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন উপস্থাপন; উল্লেখ্য, একাডেমি প্রয়োজনবোধে ঋণ গ্রহণ করলে অবশ্যই তা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।
আইনের ধারা ৩৫-এর ১ থেকে ২ উপধারায় ক্ষমতা অর্পণ বিষয়ে বিধান প্রদত্ত হয়েছে। ক্ষমতা অর্পণ করতে হয় আইনের দ্বারা, মৌখিকভাবে বা পত্রযোগে ইহা করা যায় না। আইনের উদ্দেশ্য জনগণের কল্যাণসাধন। ক্ষমতা অর্পণের দ্বারা আইনের উদ্দেশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনে। ক্ষমতা অর্পণের মাধ্যমে বিধি, প্রবিধান, ইত্যাদি প্রণয়ন করা যায়। আইনের এ ধারার বিধানুযায়ী নির্বাহী পরিষদের যে কোনো ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে প্রয়োজনে মহাপরিচালক বা সচিবকে অর্পণ করতে পারবেন।
মহাপরিচালক তাঁর যে কোনো ক্ষমতা নির্দিষ্ট শর্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনে সচিব বা একাডেমির যে কোনো কর্মকর্তাকে অর্পণ করতে পারবেন। উল্লেখ্য, ক্ষমতা অর্পণের দ্বারা অর্পণকারী তাঁর আপন ক্ষমতা হারান না এবং দায়িত্বমুক্তও হতে পারেন না।
আইনের ধারা ৩৬-এর ১ থেকে ২ উপধারায় বার্ষিক বাজেট বিবরণী বিষয়ে বিধৃত আছে। বাংলাদেশের সরকারের অর্থবছর ১২ মাস সময়কাল, ইহা প্রত্যেক প্রারম্ভিক বছরের ১লা জুলাই থেকে শুরু হয় এবং পরের বছরের ৩০শে জুন শেষ হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘অর্থবছর’ অর্থ জুলাই মাসের প্রথম দিবসে যে বছরের আরম্ভ। সরকারের বাজেটের অর্থ জনগণের অর্থ। সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া বাজেটের অর্থের খাত স্থানান্তর করা যায় না।
এ ধারায় বিধানুযায়ী একাডেমি প্রতি অর্থবছরের সম্ভাব্য আয় ও ব্যয় এবং উক্ত অর্থ বছরে সরকারের নিকট হতে কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা নির্ধারণ করে একটি বাজেট সরকারের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপিত হবে।
আইনের ধারা ৩৭-এর ১ থেকে ৪ উপধারায় হিসাবরক্ষণ ও নিরীক্ষা বিষয়ে আলোচনা প্রদত্ত হয়েছে। মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক বা তাঁর প্রতিনিধি বা চার্টার্ড একাউন্টস ফার্ম একাডেমির সকল হিসাব ও অন্যান্য নথিপত্র নিরীক্ষা করবেন এবং রিপোর্ট দিবেন। প্রতিবছর একাডেমির হিসাবগুলো নিরীক্ষা করা ও হিসাবের বার্ষিক বিবরণী প্রস্তুত করা হবে। এ কাজে সরকার বিধি-বিধান পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।
বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক বা তাঁর দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বা চার্টার্ড একাউন্টস ফার্ম একাডেমির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দখলভুক্ত সকল দলিল, নথি, নগদ অর্থ, রশিদ বা অন্য প্রকার সম্পত্তি পরীক্ষা করবেন। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব এবং ক্ষমতা একাডেমির এখতিয়ারের উপর ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত। এ কারণে Bangladesh chartered Accountants Order, 1973 (P.O. NO. of 1973) Article ২ (১) (ন)-এর মাধ্যমে যৌথ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে সংস্থাটি মানে চার্টার্ড একাউন্টস ফার্ম। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও হিসাব নিরীক্ষিত করা যাবে। এ সংস্থার নিরীক্ষাকারী ব্যক্তি বা যৌথ সংস্থা-এর কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনবোধে নির্বাহী পরিষদ বা একাডেমির কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।
আইনের ধারা ৩৮-এর ১ থেকে ২ উপধারায় বার্ষিক কর্মকান্ডের প্রতিবেদন বিষয়ে প্রদত্ত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য উপাদান জবাবদিহিতা। যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিবেদন উপস্থাপনের মাধ্যমে জবাবদিহিতা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রত্যেক অর্থ বছরের সমাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে মহাপরিচালক একাডেমির যাবতীয় কার্যাবলির ওপর এক বছরের প্রতিবেদন প্রস্তুত করবেন এবং তা নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপিত হবে।
উক্ত প্রতিবেদন নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনের পর মহাপরিচালক সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভায় পেশ করে তা অনুমোদন করিয়ে নেবেন।
উল্লেখ্য, আইনের বিধানুযায়ী একাডেমির নিজস্ব আইন থাকলেও সরকার যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ে নির্দেশ একাডেমিকে দিতে পারেন এবং একাডেমিকে তা পালন করতে হয়। তেমনিভাবে বার্ষিক প্রতিবেদন ছাড়াও যেকোনো সময়ে যে কোনো বিষয়ে প্রতিবেদন সরকার আহ্বান করলে একাডেমি তা সরকার দিতে বাধ্য।
আইনের ধারা ৩৯-এর ১ থেকে ২ উপধারায় তদন্তের ক্ষমতা বিষয়ে বিধৃত হয়েছে। এ ধারার আওতায় একাডেমির কর্মকা-ের বা কোনো বিশেষ বিষয়ে তদন্ত করবার জন্য সরকার তদন্ত কমিটি করতে পারবে। সরকার যে কোনো সময় যে কোনো বিষয়ে যে কোনো নিদের্শ দিতে পারবে এবং তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার বা কমিটিকে প্রদান করতে বাধ্য।
একাডেমি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে একাডেমির নিজস্ব আইনের বিধানুযায়ী নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। আবার একাডেমির কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণ করার কিছু কিছু দায়িত্ব সরকারের হাতে রয়েছে। একাডেমির কোনো কাজ আইনত না হলে সে সেক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের অধিকার আছে।
আইনের ৪০ ধারার প্রদত্ত ক্ষমতাবলে একাডেমি বিধি প্রণয়ন করতে পারবে। একটি আইনে পদ্ধতিগত নানা বিষয় বিষয় থাকলেও তার ব্যবহারিক নানা বিষয় সম্পর্কে ব্যাখ্যা, নমুনা, গাইড লাইন থাকে বিধিতে, যা আইনে থাকে না। বিধি প্রণয়ন ব্যতীত আইন প্রয়োগে জটিলতা তৈরি হয়। একাডেমির এ আইনটি প্রশাসনিক আইন, প্রশাসনিক আইন প্রধানত বিধিগত আইন। বিধি আইনের অধীনে প্রণীত হয়। প্রবিধানেও ইহার অন্তর্ভুক্ত। বিধি একাধিক হতে পারে। প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার জন্য বিধি অতীব প্রয়োজন। সংসদ প্রণীত আইনের মতো বিধিও নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিধি প্রণীত হয়।
বিধি এসআরও (SRO) হিসেবে জারি করা হয়। ইহা একাধিক রকমের হয়। যেমন- ভবিষ্যত তহবিল বিধি, পেনশন বিধি, সদস্য বিধি, পুরস্কার বিধি ইত্যাদি। উল্লেখ্য, এস আর ও (Statutory Regulation Order) গেজেটে প্রকাশিত হয় এবং কোনো সংস্থার জন্য প্রবর্তিত। বাংলা একাডেমি আইনের ২০১৩-এর অধীনে একাডেমি একাধিক বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন এবং তা গেজেটে প্রকাশ করতে হবে। একাডেমির আইনের অধীনে প্রণীত বিধি বা প্রবিধান একডেমির আইনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তা প্রয়োগযোগ্য হবে।
বর্তমান এ আইনের বিধানের অতিরিক্ত বা পরিপন্থি কোনো বিধান বিধিতে সন্নিবেশিত করা হলে তা বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। কিংবা প্রণীত বিধি দ্বারা পূর্বে প্রণীত কোনো আইন বা রদ হওয়ার কোনো আইনকে বলবৎ করা যাবে না। একাডেমির আইনে অধীনে প্রণীত বিধি, উক্ত আইনের সাথে বিধি অবশ্যই সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে।
একাডেমির আইনের অধীন বিধি হলে উক্ত একাডেমি আইন বিধির চেয়ে প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠতর পাবে।
আইনের ৪১ ধারার বিধান অনুযায়ী একাডেমিকে প্রবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের অনুমোদন ও গেজেটে প্রকাশ করতে হবে। প্রবিধানমালা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূলভিত্তি এবং গাইড লাইন্স; প্রবিধান এসআরও হিসেবে জারি করা হয়। মর্যাদা ও কার্যকতার দিক হতে সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইন এবং আদেশের পরই বিধি-প্রবিধানের স্থান। একাডেমির আইনের অধীনে প্রণীত প্রবিধান একাডেমির আইনের অংশ হিসেবে বিবেচিত এবং তদ্রুপভাবে প্রয়োগযোগ্য। একাডেমির আইনের বিধানের অতিরিক্ত বা পরিপন্থি কোনো বিধান প্রবিধানে সন্নিবেশিত করা হলে তা বৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে না। কিংবা প্রণীত প্রবিধান দ্বারা পূর্বে প্রণীত একাডেমির কোনো আইন যা রদ হয়ে গেছে তা বলবৎ করা যাবে না। যে আইনের অধীনে প্রবিধান প্রণীত, উক্ত আইনের সাথে তা অবশ্যই সংহতিপূর্ণ হতে হবে। উল্লেখ্য, একাডেমির আইনের অধীন কোনো প্রবিধানমালা প্রণীত হলে উক্ত প্রবিধানমালার চেয়ে একাডেমির আইন প্রাধান্য পাবে।
আইনের ধারা ৪২-এর ১ থেকে ২ উপধারায় ইংরেজি অনূদিত পাঠ প্রকাশ বিষয়ে প্রদত্ত হয়েছে। বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ বাংলা ভাষাতে গৃহীত হয়েছে। এই আইনের একটি নির্ভরযোগ্য ইংরেজি অনূদিত পাঠ রাখার বিধান একাডেমির এ আইনে আছে। ইংরেজিতে অনূদিত আইনের পাঠ এটিও সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করতে হবে। আইনের কিছু শব্দ থাকে যা অনুবাদ করা গেলেও অনূদিত শব্দ দ্বারা আইনের ভাব প্রকাশ করা যায় না। তবে ইংরেজিতে অনূদিত পাঠ কিন্তু আইন নয়। আইন যে ভাষায় জারি হয়েছে সেভাবেই গ্রহণ করা হবে। দেশের সার্বভৌম শক্তি সংসদ বা রাষ্ট্রপতি আইন প্রণয়ন করতে পারে এবং জারি করতে পারে। আইনের অনূদিত ইংরেজি পাঠ গৃহীত করতে হলে ইংরেজি পাঠও সংসদ হতে বা রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ আকারে প্রণয়ন ও জারি করতে হবে। উল্লেখ্য, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই গণপরিষদে গৃহীত হয়েছে। এটি দুই ভাষাতেই আইন হিসেবে গৃহীত হবে।
আন্তর্জাতিক আদলে আইনটি বুঝার জন্য বা উদ্ধৃতি করার জন্য ইংরেজিতে অনূদিত পাঠ থাকা একান্ত প্রয়োজন। এই কারণে আইন প্রণেতাগণ বাংলায় প্রণীত আইনের ইংরেজি পাঠ রাখার একটি বিধান সংশ্লিষ্ট আইনে রাখা হয়। উল্লেখ্য, এই আইনের কোনো অংশ রেফার হলে বাংলায় হবেÑ অনুদিত টেক্সটি রেফার হবে না।
আইনের ধারা ৪৩-এর ১ থেকে ২ উপধারায় রহিতকরণ ও হেফাজত বিষয়ে বিধৃত হয়েছে। এটি বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩-এর সর্বশেষ ধারা। এই আইনের এ ধারাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধারার বিধান বাতিল নয়, রদকরণের। এ আইনের ৪৩(১) ধারানুযায়ী Bangla Academy Ordinance, 1978 (Ordinance No. xix of 1978) জারিকৃত আইনটিকে রদ করা হয়েছে। এই আইন রদ করবার কারণ এই যে, যে সমস্ত বিষয়ে এই আইনে জারি করা হয়েছিল, সে সমস্ত বিষয় বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ (২০১৩ সালের ৩৩নং আইন)-তে বিধান করা হয়েছে। সুতরাং বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ প্রবর্তিত ও জারি হয়ে যাবার পর তা ঐ অধ্যাদেশ রহিত হয়ে পড়েছে। তবে একটি আইন দ্বারা আরেকটি আইন রহিত করা হলেও সেই আইনে (রহিত হওয়া আইন) পূর্বে যা কিছু করা হয়েছে, তা বেআইনি হবে না।
এ আইনে ৪৩। (২) ধারানুযায়ী রহিত হওয়া আইনের বলে যা কিছু করা হয়েছে তা হেফাজত করেছে। সুতরাং রহিত হওয়া আইনের আলোকে যা কিছু করা হয়েছে সেগুলোকে রক্ষা করেছে। এই বিধান আইনের ক্ষেত্রে অন্যতম তাৎপর্য বিষয়। উল্লেখ্য, রহিত হওয়া আইন রহিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কার্যকর। আর বাতিল হওয়া আইন শুরু থেকেই বাতিল। একটি আইন রদ করে আরেকটি আইন হলে রদকৃত আইনকে ঐ আইনের একটি ধারায় প্রোটেকশন দেওয়া হয়Ñ তা না হলে লিটিগেশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
এ আলোচনার সমাপ্তিতে বলা যায়, বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ বাংলা একাডেমির জন্য একটি যুগপোযুগী আইন। বাংলা একাডেমির জন্য আইন মাইলফলক। এই আইনে বিস্তৃতি পরিসরে অনেক কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তবে যে কোনো বৃহৎ কাজের মহৎ কাজের কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এই আইনেরও কয়েকটি সীমাবদ্ধতার কথা এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যায়। বাংলা একাডেমি একটি আইন দ্বারা সৃষ্টি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা ও বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান। একাডেমির আইনের একটি ধারায় সুনির্দিষ্টভাবে একাডেমিকে যে দায়িত্ব ও কার্যাবলি প্রদান করা হয়েছে; একাডেমির উক্ত দায়িত্ব ও কার্যাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালন করছে। মূলত বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষসাধনই একাডেমির মূল কাজ।
অমর একুশে বইমেলা আইনে একাডেমির কার্যাবলি ধারা (ধারা ১০) অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও একাডেমি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রতিবছর এ কাজটি করছে। এ মেলা বাঙালির জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। একাডেমির আইনে একাডেমির কার্যাবলি সংক্রান্ত ধারায় (ধারা ১০) বইমেলাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন। স্বাধীনতাত্তোর সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রথম অভিব্যক্তি ছিল বইমেলা যা একাডেমিতে শুরু হয়েছিল। তাই এ মেলাকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়ে একাডেমির আইনের ধারাতে যুক্ত করা প্রয়োজন।
একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এ আইনের বিভিন্ন ধারায় একাডেমি শব্দটি বহুবার আছে। ধারা ৩৭-এর ৪ উপধারায় অসতর্কতাবশত একাডেমি বানানটি একাডেমী হয়েছে। এটিও সংশোধন করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের মানুষের বা বাঙালিত্বের পরিচয়ের (Identity) উপাদান খোঁজতে অবশ্যই একাডেমিতে ফিরে যেতে হয়। বাংলা ভাষা এবং বাঙালিত্ব ও বাঙালি কৃষ্টি-সংস্কৃতি আমাদের একমাত্র পরিচয়। বিদগ্ধ প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে একাডেমিতে বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়েছে (ধারা ২৩। (১) (ছ) ও (জ)]। এই প্রতিনিধিত্ব আরও বাড়ানো প্রয়োজন। একাডেমিতে প্রতিবছর সদস্যভুক্তির সংখ্যা আইনে ২১জন নির্ধারণ করা হয়েছে (ধারা ৮(২)। এই সদস্যভুক্তির সংখ্যা ষোল কোটির অধিক মানুষের দেশে অপ্রতুল। আরও বাড়ানো প্রয়োজন। এ কারণে একাডেমির আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার বিষয়াবলি সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।
এছাড়া বিদ্যমান ৩৬ ধারায় চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। বিষয়টি পদ্ধতিগতভাবে বর্ণিত হয়েছে। আইনে এ সংক্রান্ত তফসিলে নমুনা প্রদত্ত হলে বুঝতে ও কার্যসম্পাদনে সহজ হতো। আইনে সদস্য ফরমের কোনো নমুনা দেওয়া হয়নি। এ আইনের উপর্যুক্ত এই বিষয়গুলি তফসিলে থাকা প্রয়োজন।
সর্বোপরি, বিদ্যমান বাংলা একাডেমি আইন, ২০১৩ আইনটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা, সাংবিধানিক আইন ও আইনের শাসন এবং মৌলিক মানবাধিকারকে সমুন্নত করেছে। এ আইনটি সর্বতোভাবে নিখুঁত এবং এ আইনের আলোকে বিরাট পরিসরে কাজ সম্পাদন করার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। তবে এ আইনের দু-একটি ধারার সীমাবদ্ধতা আলোচনা করে সংশোধন করা গেলে এ আইনটি একাডেমির জন্য ম্যাগনাম ওপাস বা ল্যান্ড মার্ক আইন বলে বিবেচিত হবে। এই আইন প্রবর্তিত হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলা একাডেমি একুশের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নিরিখে জাতির জাতীয় প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে নিয়ত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে যাবে।
লেখক : গবেষক