জনস্বার্থের মামলা যেন অর্থ আয়ের উদ্দেশ্যে করা না হয় বলে মন্তব্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। এ সময় তিনি ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স টেনে বলেন, “পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন কখনো পাবলিসিটি ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা প্যায়সা ইনকাম লিটিগেশন বা পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট লিটিগেশন হওয়া উচিত না।”
তরুণ আইনজীবীদের ক্যারিয়ার ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করা ডি জুরি একাডেমি আয়োজিত এক ক্যারিয়ার আড্ডায় অংশ নিয়ে রোববার (১৪ নভেম্বর) তিনি এমন মন্তব্য করেন।
সামাজিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা, আইন পেশায় দক্ষতা ও জনস্বার্থে দায়ের করা মামলায় সফলতার জন্য ২০১৯ সালে ‘গ্লোবাল প্রোগাম ফর উইমেনস লিডারশিপে’র ফেলো মনোনীত এই আইনজীবী বলেন,
“পাবলিক ইন্টাররেস্ট লিটিগেশনের মাধ্যমে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি, ল রিফর্ম করার সুযোগ রয়েছে এখানে। তবে অনেকেই অল্প সময়ে পাবলিসিটি বাড়ানোর জন্য বা পয়সা ইন কামের জন্য পিআইএল করেন।”
এছাড়া উক্ত ক্যারিয়ার আড্ডায় আইনের ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং তরুণ স্বপ্নবাজ আইনজীবীদের আইন পেশার বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করবার সুযোগ নিয়ে কথা বলেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।
একই সাথে নিজের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়ন, বিশ্বের সর্ববৃহৎ ল ফার্ম বেকার এন্ড ম্যাকেঞ্জিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন সবার সাথে। সেই সাথে যারা ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চান এবং সেই শিক্ষাটুকু দেশের কল্যাণে কিভাবে কাজে লাগাতে পারেন সে সম্পর্কেও কথা বলেন।
ডি জুরি একাডেমির জুম প্লাটফর্মে একটি প্রাণবন্ত আড্ডা জমে ওঠেছিল। ব্যারিস্টার সাদিয়া আফরোজের সঞ্চালনায় আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আইনের ছাত্র, গ্র্যাজুয়েট এবং তরুণ আইনজীবীদের আইন পেশায় ক্যারিয়ার সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবও দেন তিনি।
অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার সাদিয়া আফরোজ জানতে চান, বাংলাদেশের কেউ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চাইলে তার কি করা উচিত?
জবাবে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম জানান,
“অক্সফোর্ডে পড়তে হলে এডুকেশন কোয়ালিফিকেশন প্রয়োজন হয় মিনিমাম ফাস্ট ক্লাস। শুধু ফার্স্টক্লাস থাকাই যথেষ্ট নয়, ছাত্রজীবনের কোন কাজের অভিজ্ঞতা থাকা যেমন ডিবেটিং, ইন্টার ইউনিভার্সিটি মুটিং, স্টুডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটেটিভ থাকার বিষয়গুলো সিভিতে থাকলে সিভি অনেক বেশি সলিড হয়।”
তিনি আরো বলেন, “আমি এলএলবি করার পর এলএলএম করি ইউনিভার্সিটি অব বাকিংহামে। তারপর আড়াই বছর কোর্ট প্রাকটিস। প্র্যাকটিসের অভিজ্ঞতাগুলো সিভিতে লিখেছি। অক্সফোর্ডে আবেদন করতে হবে নির্ভুলভাবে, এমন কি সামান্য বানান ভুলও থাকা চলবেনা। এতে করে খারাপ ইম্প্রিশেন তৈরি হয়।”
এজন্য, বড় বড় ইউনিভার্সিটিতে বা চাকরিতে আবেদন করার সময় সিভি এবং অ্যাপ্লিকেশন গুলো খুব যত্নসহকারে তৈরি করার পরামর্শ দেন তিনি।
নবীন আইনজীবীদের উদ্দেশে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন, “অনেকে ধারণা করেন, আমি বার কাউন্সিল পরীক্ষায় এনরোল্ড হয়ে গেছি। ব্যস, আমার সব জানা হয়ে গেছে! এটা ঠিক নয়। প্রতিযোগিতামূলক আইন পেশায় টিকে থাকতে আমাদের স্কিল বাড়াতে হবে। একাডেমিক নলেজ এবং ল প্র্যাকটিসের মধ্যে বড় একটি গ্যাপ রয়ে গেছে।”
এশিয়া প্যাসিফিক ২০১৮-এর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এই আইনজীবী বলেন,
“নবীন আইনজীবীরা ডিগ্রি নিয়ে যখন প্রাকটিসে আসে, তারা বুঝতেই পারেনা কি করবে। ডি জুরি একাডেমি একাডেমিক নলেজ এবং প্রাক্টিক্যাল প্র্যাকটিসের মধ্যে একটি সংযোগ তৈরি করে নবীন আইনজীবীদের স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছে, যে কালচারটি এখনো আমাদের দেশে সৃষ্টি হয়নি। এসব ক্ষেত্রে ডিজুরি একাডেমির মতো যদি আরো একাডেমি এগিয়ে আসে তাহলে এ গ্যাপটা পূরণ হবে।”
বাংলাদেশের নবীন আইনজীবীদের জন্য সিভিল এবং ক্রিমিনাল প্র্যাকটিসের পাশাপাশি কর্পোরেট ও কমার্সিয়াল ল নিয়ে কাজ করার সুযোগ কেমন, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম বলেন,
“কোর্ট প্রাকটিস ছাড়াও আমরা চেম্বারে বসেও প্রাকটিস করতে পারি, যেখানে এডভাইস করা, লিগ্যাল অপিনিয়ন দেয়া, ইন হাউজ কাউন্সিলার হওয়া যায়।”
তিনি বলেন, “ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, ইউনিলিভার এর মত বড় বড় কোম্পানিগুলোতে একটি লিগ্যাল টিম থাকে, একইভাবে ব্যাংকিং সেক্টরেও ইন হাউজ প্রাকটিস করা যায়। এনজিও গুলোতেও লিগ্যাল টিম আছে যেমন, ব্র্যাক, ব্লাস্ট।”
তিনি আরো বলেন,
“যারা খুব বেশি স্যালারি চায়না, কিন্তু মানেুষের জন্য কাজ করতে চায়, তারা নন প্রফিটেবল এনজিও গুলোতে জয়েন করতে পারেন। সেই সাথে আইনের শিক্ষক হিসেবেও ক্যারিয়ার দাঁড় করানো যেতে পারে। তবে আমরা যাই করিনা কেন, কোর্ট প্রাকটিসটা সবার আগে করা উচিত, এরপর কোন সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়বো সেটা ভিন্ন বিষয়।”
আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি জানান, রোড এক্সিডেন্ট এর রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ফিরিয়ে দেয়া নিয়ে ব্লাস্টের পক্ষ থেকে একটি জনস্বার্থমূলক মামলা করেন তিনি।
তিনি বলেন, “কোনো আইনে স্পষ্ট করে বলা নাই, একজন রোড এক্সিডেন্ট করলে তাকে বাধ্যতামূলক জরুরী সেবা দিতে হবে। এ কারণে বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগী ফিরিয়ে দিয়ে বলে, আগে পুলিশ রিপোর্ট করে আসেন।”
জনস্বার্থের ওই মামলায় জরুরী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্ট থেকে একটি নীতিমালা চাওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “আড়াই বছর চেষ্টা করে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয় এবং পরবর্তীতে হাইকোর্ট এ নীতিমালাকে আইনের মযার্দা দেয়। মহামান্য হাইকোর্ট বলে দেন, যতদিন এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন না হয়, ততদিন নীতিমালা এ গ্যাপটা পূরণ করবে।”
আলোচনার এ পর্যায়ে অনেকে জনস্বার্থের মামলা ব্যক্তিগত প্রচারের উদ্দেশ্যে করেন উল্লেখ করে তিনি বলেন,
“পাবলিক ইন্টাররেস্ট লিটিগেশনের মাধ্যমে একটা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ অনেক বেশি, ল রিফর্ম করার সুযোগ রয়েছে এখানে। তবে অনেকেই অল্প সময়ে পাবলিসিটি বাড়ানোর জন্য বা পয়সা ইন কামের জন্য পিআইএল করেন।”
এ সময় তিনি ইন্ডিয়ান সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্স টেনে তিনি বলেন, “পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন কখনো পাবলিসিটি ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা প্যায়সা ইনকাম লিটিগেশন বা পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট লিটিগেশন হওয়া উচিত না।”
অনুষ্ঠানে নারী আইনজীবীদের আইন পেশায় বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়েও তিনি কথা বলেন। রাশনা ইমাম বলেন,
“বাংলাদেশের কোন কোর্টই নারী বান্ধব না। কোর্ট ভবনে পর্যাপ্ত টয়লেট নাই, নারীদের এক ভবন থেকে আরেক ভবনে গিয়ে ওয়াশরুম ইউজ করতে হয়, যা অসম্ভব। এমন অনেক নারী আইনজীবী আছেন, যারা কাজ শেষ করে বাড়িতে গিয়ে ওয়াশরুম ব্যবহার করেন। হাইকোর্টে কিছুদিন আগেও ব্রেস্টফিডিং কর্নার ছিলনা। এ সুযোগ গুলো না থাকলে একজন নারী আইনজীবীর পক্ষে কাজ করা কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, “প্রথম জীবনে নারী আইনজীবীদের একটি মামলা পেতে খুব কাঠখড় পোড়াতে হয়। পুরুষ আইনজীবীর মতো নারী আইনজীবীরা এগ্রেসিভলি কোর্টে প্রসিড করতে পারে না, এ ধারণা থেকে ক্লায়েন্টরা পুরুষ আইনজীবীকে বেছে নেয়।”
নারী আইনজীবীদের জন্য অপরচুনিটিও অনেক কম উল্লেখ করে তিনি নারী আইনজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন,
“যদি কোন মিনিমাম অপরচুনিটি পাওয়া যায়, সেখানে নারী আইনজীবীদের উচিত হবে হানড্রেড পার্সেন্ট ডেডিকেশন দেওয়া, নিজের যোগ্যতা ও স্কিল প্রমাণ করা।”
আবার অনেক সময় ক্লায়েন্টরা ঠিকমতো নারী আইনজীবীকে ফিস দিতে চায়না মন্তব্য করেন এই আইনজীবী বলেন, “ক্লায়েন্টের ধারণা নারীদেরকে কম টাকা দিয়ে পার পাওয়া যাবে। এসব ক্ষেত্রে নারীকে স্ট্রেইটকাট ডিসিশান জানিয়ে দিতে হবে।” তিনি বলেন, “দেয়ার ইজ নো সেইম ইন সেলফ প্রমোশন”। এভাবে নারী আইনজীবীদের এগিয়ে যেতে পরামর্শ দেন তিনি।
সঞ্চালক ব্যারিস্টার সাদিয়া আফরোজের সাথে এ পর্যন্ত আলোচনা শেষে ডিজুরি একাডেমির জুমপ্লাট ফর্মের ফ্লোর সকল পার্টিসিপেন্টদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জুম সেশনে যুক্ত হয়ে আইনের ছাত্র, ল গ্র্যাজুয়েট এবং তরুণ আইনজীবীরা ব্যারিস্টার রাশনা ইমামের সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পান।
এ পর্যায়ে তাদের ক্যারিয়ার বিষয়ক সকল জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর বাস্তবতা এবং বিচক্ষণতার সাথে দেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম। সবশেষে তরুন আইনজীবীদের উজ্জল ভবিষ্যৎ গঠনে ডি জুরি একাডেমির ক্যারিয়ার ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে আড্ডার পরিসমাপ্তি করেন ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম।
প্রসঙ্গত, ব্যারিস্টার রাশনা ইমাম অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব সিভিল ল (বিসিএল) সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে তিনি আখতার ইমাম এন্ড এসোসিয়েটস এর ম্যানেজিং পার্টনার হিসেবে কর্মরত আছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি রাজনীতিবিদ ও শিক্ষক ববি হাজ্জাজের স্ত্রী।