বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রের পক্ষে আঞ্চলিক পর্যায়ে আওয়াজ তুলতে হবে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে।
এর প্রতিবাদে দেশভেদে মানবাধিকারকর্মীদের সোচ্চার হতে হবে। বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনবিষয়ক ঘটনায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার প্রতিবেদন নিয়মিত প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে সরকার।
রাজধানীর লেকশোর হোটেলে সোমবার (১৫ নভেম্বর) বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এবং এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টস (ফোরাম-এশিয়া) আয়োজিত এক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি কনসালটেশন ফর দ্য এসটাবলিশমেন্ট অব হিউম্যান রাইটস মেকানিজম’ (মানবাধিকারবিষয়ক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় কৌশল-পরামর্শ) শিরোনামের সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে আঞ্চলিক মানবাধিকার রক্ষায় সমন্বিত উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া হয়।
এর গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়, এ ধরনের একটি উদ্যোগ থাকলে জাতীয় পর্যায়ে মানবাধিকার নীতি প্রতিপালনে ঘাটতি দেখা গেলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার উদ্যোগগুলো ওই দেশের মানবাধিকারের পথে বাধা ও চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। আঞ্চলিক উদ্যোগ সে ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার রক্ষার পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সেতুর মতো কাজ করতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। অমানবিক নির্যাতন, গুম, ক্রসফায়ার, নানাভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার মাধ্যমে মানুষের জীবনযাপনের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়। বাংলাদেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, লিঙ্গবৈষম্যের ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সম্মানীয় নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। আর বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত সেসব প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে, অভিযোগ অস্বীকার করে।
তিনি বলেন, একটি উদ্যোগ বা ফোরাম থাকা উচিত, যাঁরা জানাবেন বাংলাদেশে আসলে কী ঘটছে। যে আঞ্চলিক উদ্যোগ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়টিও আসা উচিত। আমাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা অনুপস্থিত এবং এই অনুপস্থিতির প্রভাবও পড়ছে চারপাশে।
ব্যারিস্টার সারা বলেন, এই অঞ্চলের দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের সমান অধিকারের বিষয়টি চ্যালেঞ্জের মুখে। দেশে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়েও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ ব্যাপারে সমাধানের উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে।
পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে মানবাধিকারকর্মীদের সম্মিলিতভাবে সোচ্চার হতে হবে। মাঠ ছাড়া যাবে না। নির্বাচন নিয়ে যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তা থেকে বোঝা যায় ভোটের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি ‘একক মডেল’ তৈরি করেছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, একটি আঞ্চলিক উদ্যোগ তৈরি হলে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের অধিকার অর্জনে তা কিছু প্রভাব ফেলতে পারবে। নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষার আইনগুলো বাস্তবায়নে গুরুতর সংকট রয়েছে।
তিনি বলেন, আইনগতভাবে যখনই নারীর অধিকারের বিষয়টি আসে, তখনই তা ব্যাপকভাবে প্রতিহত করা হয়। নারীর প্রতি সমাজ ও পরিবারের নেতিবাচক মনোভাব যত দিন না পাল্টাবে, তত দিন লক্ষ্য থেকে অনেক দূরেই থাকবে বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম সারওয়ার।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০২০–এর তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় আংশিক স্বাধীনতা আছে এবং আফগানিস্তানে স্বাধীনতা নেই। বাংলাদেশ নয়টি মৌলিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির মধ্যে আটটিতে এবং চারটি ঐচ্ছিক প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে।
তবে বিভিন্ন প্রতিবেদন বলছে, গুম, নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। কোভিড-১৯–এর সময়ে সাংবাদিকেরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং দুটি গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, এক বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ২৩৩ সাংবাদিক প্রাণনাশের হুমকি, নির্যাতন, আটক, হয়রানি এবং সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
গত বছর ২০০–এর মতো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে মৃত্যু হয়েছে ৪৫ বাংলাদেশির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ১০ বছরের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের হিসাব রয়েছে। এসব আর গোপন করার কিছু নেই। জাতীয় অধিকার এবং মানবাধিকার দুটো আলাদা ইস্যু। এটাতে এখন আমলাতন্ত্র জেঁকে বসেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হামিদা হোসেন বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, সীমান্তবর্তী ইস্যু ইত্যাদি বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে একই ধরনের যেসব সমস্যা আছে, সেগুলোর সমাধানের উপায় খুঁজতে হবে। এই অঞ্চলে শরণার্থীবিষয়ক সমস্যাও রয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাসিমা বেগম বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মানবাধিকার কমিশন যেন নিজস্ব উদ্যোগে তদন্ত করতে পারে এবং ব্যবস্থা নিতে পারে, সেই লক্ষ্যে কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। শুধু সমালোচনা না করে সবাইকে মানবাধিকার ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
সম্মেলনে সূচনা বক্তব্য এবং শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামাল। অনলাইনে সম্মেলনে যুক্ত হন ফোরাম-এশিয়ার নির্বাহী পরিচালক শামিনি দার্শনি কালিয়েমুথু এবং একই সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক দেবেন্দ্র অধিকারী।
এ ছাড়া সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে আরও বক্তব্য দেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ফস্টিনা পেরেইরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্ক ও বিমসটেক শাখার অতিরিক্ত সচিব মো. শামসুল হক। সূত্র: প্রথম আলো