এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারাটি ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায়। লড়াইয়ের শুরুতেই হেরে যেতে হয় নারীকে, যখন আইনি কাঠামোতেই ভিকটিমকে ‘চরিত্রহীন’ কিংবা ‘যৌন সম্পর্কে সক্রিয়’ হিসেবে চিত্রায়িত করা হয় আদালতে। ১৬ নভেম্বর মহামান্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রিট শুনানী শেষে এ ধারা বাতিলের পক্ষে মতও দিয়েছেন। কোনোমতে নারীর ‘চরিত্র ভালো না’ প্রমাণ করা গেলেই জিতে যাচ্ছে ধর্ষক।
বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণ মামলার বিচার শেষে সম্প্রতি সব আসামির খালাসের রায় দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার। পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, অভিযোগকারী তরুণী ‘স্বেচ্ছায়’ রেইনট্রি হোটেলে গিয়ে আসামির সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন, সেখানে ‘ধর্ষণ ঘটেনি’। সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে চরিত্র, পেশা, পোশাক ইত্যাদি নিয়ে পুলিশ, আইনজীবী ও বিচারকের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। অর্থাৎ ধর্ষণের মামলায় জেরা করার সময় ধর্ষণের শিকার নারীকে অনেক সময় অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত, অপ্রাসঙ্গিক, রুচিহীন ও আপত্তিকর প্রশ্নের মাধ্যমে চরিত্র হনন করা হয়। এ কারণে ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন।
সাক্ষ্য আইনের ধারা- ১৫৫ (৪)- এ বলা হয়েছে, কোনো লোক যখন বলাৎকার কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে সোপর্দ হয়, তখন দেখানো যেতে পারে যে, অভিযোগকারিণী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রসম্পন্ন রমণী। এছাড়া সাক্ষ্য আইনের ১৪৬ ধারা উপধারা ৩ এ বলা হয়েছে, সাক্ষীর চরিত্র নিয়েও প্রশ্ন করা যেতে পারে, যাতে সে এমন তথ্য দেয় যা দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করতে সহায়ক হবে। এ জন্যই এ দুটি ধারা বাতিল চেয়ে মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ে করা হয়েছে।
আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ (১) ধারায় ধর্ষনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ছাড়া ষোল বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে অথবা ষোল বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষন করেছেন বলে গন্য হবেন।
ধর্ষণের সংজ্ঞা থেকে আমরা যা পাই তা হলো (১) ভিকটিমের বয়স ১৬ বছরের নিচে হতে হবে (২) তার যৌনকর্মে সম্মতি থাকলেও ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে (৩) যিনি ওই ভিকটিমের সঙ্গে যৌনকর্ম করেছেন তিনি ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং এজন্য তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবেন।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট হানিফ সেখ বনাম আছিয়া বেগম মামলা, যা ৫১ ডিএলআরের ১২৯ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, ১৬ বছরের অধিক কোনো মেয়েকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ের প্রলোভন দিয়ে যৌনকর্ম করে তা হলে তা ধর্ষণের নামান্তর হবে না।
আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সোহেল রানা বনাম রাষ্ট্র মামলায়, যা ৫৭ ডিএলআরের ৫৯১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যে, যৌনকর্মের সময় যদি ভিকটিম কোনরূপ বাঁধা না দেয় অথবা বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করে অথবা কোনো চিৎকার না দেয় তাহলে ধর্ষণ হয়েছে বলে মনে করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যৌনকর্মে ভিকটিমের সম্মতি আছে বলে ধরে নিতে হবে।
আমাদের দণ্ডবিধি আইনের ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণ সম্পর্কে পঞ্চম পয়েন্টে বয়স সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৪ বছরের কম হয়। ব্যতিক্রম:-১৩ বছরের কম নয় এমন স্ত্রীর সাথে স্বামী যৌন সঙ্গম করলে ধর্ষণ বলে গণ্য হবে না।
বাংলাদেশের উচ্চ আদালতগুলোতে ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ প্রমাণ হিসেবে কতটা ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ফলাফলগুলো কী ছিল তার কয়েকটি উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবদুল মজিদ বনাম রাষ্ট্র মামলা, যা ১৩ বিএলসি ২০০৮ মামলায় একজন তালাকপ্রাপ্ত মা, যিনি তার শিশুসহ তার কুঁড়েঘরে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। পালিয়ে যাওয়ার সময় অভিযুক্ত ধর্ষক গ্রামবাসীর কাছে ধরা পড়েন এবং অপরাধ স্বীকার করেন। আদালতে অভিযোগকারিণীর বৈবাহিক অবস্থা এবং যৌনসম্পর্কের ইতিহাসকে তার ‘চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য’ বিবেচনায় তাকে ‘যৌন কার্যকলাপে অভ্যস্ত’ বলে উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় ‘ধর্ষিতা একজন হালকা নৈতিক চরিত্রের অধিকারিণী এবং তিনি অসামাজিক ও অনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত রয়েছেন।’
রাষ্ট্র বনাম শাহীন এবং অন্যান্য যা ২৮ বিএলডি, ২০০৮ মামলায় ধর্ষণের অভিযোগকারীর দুবার বিয়ে হয়েছিল। তাকে তার নানির কাছ থেকে ছিনিয়ে একটি হোটেলের কক্ষে সদলবলে ধর্ষণ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও আদালতের রায়ে বলা হয় যে ‘এটি এমন একজন নারীর ধর্ষণের মামলা, যার আগে দুবার বিয়ে হয়েছিল এবং এই মামলাটি এমন একটি উদাহরণ, যেখানে উল্লিখিত কারণে বাদিনীর একার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না।’
শ্রী দিনটা পাল বনাম রাষ্ট্রের মামলায় যা ৩০ বিএলডি (এডি) ২০১০ দেখা যায় যে, আদালত অভিযোগকারিণীর গাছ বেয়ে ওঠাকেই তার ‘খারাপ চরিত্র বা দুশ্চরিত্র’ হিসেবে প্রমাণ করেন এবং তার সাক্ষ্যকে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরে নেন। অভিযোগকারিণী ছিলেন একজন অল্পবয়সী গৃহপরিচারিকা, যিনি তার নিয়োগকর্তার হাতে ধর্ষিত হন। আদালত এ ক্ষেত্রে মন্তব্য করেন যে, যেহেতু অভিযোগকারিণী অভিযুক্তের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ থাকার সময় একটি পেঁপেগাছ বেয়ে উঠে প্রবেশ করেছিলেন, এতে প্রমাণ হয় যে বাদিনী একজন হালকা সম্ভ্রমের নারী। তাই তার দেয়া প্রমাণ বিশ্বাসযোগ্য হবে না, যতক্ষণ না আরো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হবে।
অবশ্য আদালতের এমন রায়ও রয়েছে যেখানে একজন ধর্ষিতার সৎ চরিত্রের প্রমাণকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। ফাতেমা বেগম বনাম আমিনুর রহমান যা ২৫ বিএলডি (এডি) ২০০৫, মামলায় আদালত সিদ্ধান্ত দেয় যে, ‘বিজ্ঞ উকিল উপস্থাপন করেছেন যে মামলার বাদিনী একটি সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারের একজন অবিবাহিতা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্নই ওঠে না যে বাদিনীর চরিত্র সন্দেহজনক হতে পারে।’
১৮ ডিএলআর, ৯১ পৃষ্ঠায় মুডির মেডিক্যাল জুরিসপ্রুডেন্সে ধর্ষণ সংক্রান্ত ব্যাপারে বলা হয়েছে, দেহ, বিশেষ করে মুখমন্ডলে, দুধে, বুকে, পেটের নিম্নাংশে, অঙ্গ প্রত্যঙ্গে এবং পিছনে বল প্রয়োগের চিহ্ন যাহা নখের আচড় এবং থেতলানো ফলে যাহা যন্ত্রণার সৃষ্টি হইয়াছে, এই ধরণের চিহ্ন বাধা প্রদান করিতে সক্ষম একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলার শরীরে পাওয়া যাইবে।
গোলাম আহমদ বনাম রাষ্ট্র, ৬৪ ডিএলআর (এইচসিডি) ৯৩, মামলায় বলা হয়েছে যে, তারা স্বামী-স্ত্রী রূপে এক সাথে ছয় বছর বসবাস করেছেন। ভিকটিমের সম্মতি প্রতারণার মাধ্যমে গৃহীত হয়নি। যৌনসঙ্গম কেবল একদিনের কর্ম ছিল না বরং এটা ছিল ছয় বছর যাবত। এ রকম কাজ ধর্ষণের অপরাধ সংঘটন করে না।
উল্লিখিত মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে এটার মধ্যে যথেষ্ট ঔপনিবেশিক আচরণেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কাজেই সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারার কার্যপ্রক্রিয়াটি স্বাধীন বাংলাদেশের আদর্শের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আমাদের প্রতিষ্ঠিত আইনী নীতি যে, যদি ধর্ষিতা খারাপ চরিত্রের অধিকারীও হয়ে থাকেন এবং এমনকি যদি বেশ্যাও হয়ে থাকেন, তার গোপনতার অধিকার কোন ব্যক্তি কর্তৃক খর্ব হতে পারে না এবং নির্যাতিতার চরিত্র নির্বিশেষে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই ধর্ষণ অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হয়। কাজেই আমাদের সাক্ষ্য আইনের ১৮৭২ এর ধারা ১৫৫ এর ৪ উপধারাটি ব্যাপকভাবে ধর্ষণের মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও এই দেশে আছে। কাজেই ১৫৫ এর ৪ এর বিধান বাদ দেয়া যুক্তিযুক্ত নয় কি?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইন গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com