জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালির জাতীয় জীবনের জ্যোতির্ময় আলোকবর্তিকা বলে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। তিনি বলেছেন, মহাবিজয়ের এ মহানায়ক ছিলেন এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাকে কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করে শেষ করা যাবে না। আজ বিশ্বের যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম, সেখানেই অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট প্রকাশিত মুজিব স্মারকগ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু অ্যান্ড দ্য জুডিশিয়ারি’ এবং মুজিববর্ষ স্মরণিকা ‘ন্যায় কণ্ঠ’র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেলে সভাপতির বক্তব্যে তিনি কথা বলেন। সুপ্রিম কোর্ট জাজেজ স্পোর্টস কমপ্লেক্সে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা দিক তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি।
অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। এছাড়া সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের (আপিল ও হাইকোর্ট) বিচারপতিরা, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন সংক্রান্ত স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকা বিষয়ক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জাজেস উপ-কমিটির আহ্বায়ক এবং আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান উপস্থিত ছিলেন।
বক্তব্যের শুরুতে উপস্থিত সকলকে হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ও বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। স্মরণ করছি ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা-বোনকে, যাদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। স্মরণ করছি কারা অন্তরালে নিহত জাতীয় চার নেতাকে এবং ১৫ আগস্ট ঘাতকদের গুলিতে নিহত বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব এবং মুজিব পরিবারের সদস্যদের। এই ক্ষণে কোভিড-১৯ মহামারিতে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
তিনি বলেন, শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রধানমন্ত্রী আজকের এ অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠানকে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত করেছেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা জানান প্রধান বিচারপতি।
এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে অন্যতম মুজিববর্ষ স্মারক ‘বঙ্গবন্ধু ও বিচার বিভাগ’ এবং মুজিববর্ষ স্মরণিকা ‘ন্যায় কণ্ঠ’ প্রকাশনা দু’টির কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারায় পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন তিনি।
সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, মহাবিজয়ের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাকে কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করে শেষ করা যাবে না। ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’, ‘জয় বাংলা’, ‘মুক্তির সংগ্রাম’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ’, ‘ছয়দফা আন্দোলন’, ‘বাঙালির স্বাধিকার’, ‘বাঙালির স্বাধীনতা’- যাই বলি না কেন- এ শব্দগুলোর অপর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ বিশ্বের যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম, সেখানেই অনুপ্রেরণা বঙ্গবন্ধু। তাই বলা যায়, এ মহান নেতা আমাদের জাতীয় জীবনে এক জ্যোর্তিময় আলোকবর্তিকা। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িত, একটিকে বাদ দিয়ে অপরটি কল্পনা করা যায় না। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ ব্যক্তিত্বের জীবন ছিল কণ্টকাকীর্ণ ও দুঃসহ।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের মূল্যবান সময়ের অনেকটাই কেটেছে অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠে। আইন-আদালত, কোর্ট-কাচারি, মামলা-মোকদ্দমা এসব তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিল। বিজয়ের মূলমন্ত্র সম্বলিত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে বহু আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাঙালি জাতি অর্জন করেছে মহান স্বাধীনতা ও চূড়ান্ত বিজয়। শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি শোষিত-নির্যাতিত বিশ্বমানব সমাজের সকল আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ও অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রাতঃস্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন।
প্রধান বিচারপতি বলেন, মুজিববর্ষ স্মারকগ্রন্থ এবং মুজিববর্ষ স্মরণিকাটি সুপ্রিম কোর্টের উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা হিসেবে বিবেচিত হবে। এই মহৎ কর্মে শরিক হতে পেরে নিজকে ধন্য মনে করছি। নিঃসন্দেহে এটি আমার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জীবনের সাথে আদালতের তথা বিচার বিভাগের সম্পৃক্ততা ও মিথস্ক্রিয়ার বিষয়টি এক সুবিশাল ক্যানভাসে চিত্রায়িত হয়েছে স্মারকগ্রন্থে। প্রধানমন্ত্রীর লেখাটি নিঃসন্দেহে স্মারকগ্রন্থের শ্রেষ্ঠ সংযোজন হিসেবে স্বমহিমায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রীর লেখায় বর্ণনার প্রাঞ্জলতায়, উপলব্ধির প্রগাঢ়তায় এবং স্মৃতিচারণের বিশিষ্টতায় স্মারকগ্রন্থে স্নেহাদ্র পিতার সঙ্গে কন্যার সম্পর্কে গভীরতম অনুভূতির মর্মস্পর্শী উপাখ্যানের পাশাপাশি অঙ্কিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও নিয়ত সংগ্রামের নানা গুরুত্বপূর্ণ দিক, যা প্রতিটি পাঠকের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করবে।
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনে মামলা, আদালত, নির্যাতনমূলক গ্রেফতার তথা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক আরোপিত আইনি অভিঘাতের ওপর বিশ্লেষণী উল্লেখযোগ্য আলাদা কোনো সংকলন প্রকাশনা ছিল না। এই গ্রন্থ সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও দূর করতে সক্ষম হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বহুমাত্রিক গবেষণার যে বলিষ্ঠ ধারা সূচিত হয়েছে, তা সাচ্ছন্দ্য গতিতে চলমান থাকবে বলে আমি একান্ত চিত্তে প্রত্যাশা করি। বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও জীবনাদর্শ আমাদের চিরন্তন প্রেরণার উৎস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উর্বর ক্ষেত্র বঙ্গবন্ধু প্রস্তুত করেছিলেন, তার প্রধান মাধ্যম ছিল বাংলা ভাষা। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করা। স্মারকগ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক ঘটনাবহুল জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উচ্চ আদালতের মোট নয়টি রায় বাংলায় অনূদিত হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়টির বঙ্গানুবাদও এই স্মারকগ্রন্থে সংযোজন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত রায়সমূহের বাংলা অনুবাদ তার স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ উদ্যোগ এবং সর্বোচ্চ আন্তরিকতার ফসল হচ্ছে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ তথা আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০। যা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভার্চুয়াল কোর্ট শুরুর সময়কালে আপিল বিভাগে মামলা বিচারাধীন ছিল ২৪ হাজার ৩৫৬টি, বর্তমানে বিচারাধীন ১৫ হাজার ৫৫৬টি। হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কনফার্মের বিরুদ্ধে দায়ের করা ১২৫টি আপিল ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে আপিল বিভাগ নিষ্পত্তি করে, যা থেকে ভার্চুয়াল কোর্টের সাফল্য সহজে অনুমেয়। আমি বিশ্বাস করি ভার্চুয়াল এবং ফিজিক্যাল কোর্টের মাধ্যমে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব। বিচার বিভাগকে ডিজিটালাইজেশন করার নিমিত্তে গৃহীত Mission Digital Judiciary, 2021 এবং e-Judiciary প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মাননীয় আইনমন্ত্রী, মাননীয় আইসিটি উপদেষ্টা এবং তথ্য ও যোগাযোগ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর নিরন্তর প্রচেষ্টা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বিচার বিভাগে যুগান্তকারী সংস্কার সাধিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
বক্তব্যের শেষ দিকে প্রধান বিচারপতি বলেন, জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন বিষয়ক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট জাজেজ কমিটি এবং স্মারকগ্রন্থ এবং স্মরণিকা বিষয়ক জাজেজ উপ-কমিটির সদস্য বিচারপতিগণের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। স্মারকগ্রন্থ ও স্মারনিকা প্রণয়নে যারা কন্ট্রিবিউট (contribute) করেছেন, তাঁদের জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। এই আয়জনের সহিত সম্পৃক্ত সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। মাননীয় প্রধান অতিথিকে আবারো ধন্যবাদ, সকলকে অসংখ্য ধন্যবাদ। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।