প্রায় এক যুগ আগে আলোচিত একটি হত্যা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন করাদণ্ডপ্রাপ্ত হন আসামি সোহাগ। নিজেকে রক্ষা করতে টাকার বিনিময়ে একজনকে সোহাগ বানিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ এবং জামিন আবেদন করান। কিন্তু জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত ‘নকল সোহাগ’কে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে শেষরক্ষা হয়নি আসল সোহাগের। বিদেশে পালানোর জন্য করোনা টিকা নিতে এসে অবশেষে র্যাবের হাতে ধরা পড়লেন।
রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকা থেকে আজ রোববার (৩০ জানুয়ারি) আসল সোহাগকে গ্রেফতার করা হয়। র্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি আ ন ম ইমরান খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আসল আসামির নাম সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ (৩৪)। আর টাকার বিনিময়ে আসল সোহাগের পরিবর্তে সাজা ভোগ করা নকল সোহাগের নাম মো. হোসেন।
র্যাব জানায়, ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর দুপুরে ঢাকার কদমতলী থানাধীন আউটার সার্কুলার রোডে নোয়াখালী পট্টিতে নান্নু জেনারেল স্টোরের সামনে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে হুমায়ুন কবির ওরফে টিটু নামের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলি টিটুর মাথার ডান পাশে লাগে। টিটুকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় টিটুর পরিবার বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলায় আসামিরা হলেন- কদমতলী থানাধীন মুরাদপুরের বিড়ি ফ্যাক্টরী গলির গিয়াস উদ্দিন কাঙ্গালের ছেলে সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ, খালপাড়ের (নোয়াখালী পট্টি) আলাউদ্দিন শেখের ছেলে মামুন (৩৩), মুরাদপুর হাই স্কুল রোডের শফু মিয়ার ছেলে সোহাগ ওরফে ছোট সোহাগ (৩০) এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৩-৪ জন।
তাদের মধ্যে সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ মামলার মূল আসামি। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর তাকে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে ২০১৪ সালের ১৬ মে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান সোহাগ। জামিনের মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই পলাতক রয়েছেন তিনি। পরে ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর পলাতক সোহাগ ওরফে বড় সোহাগের অনুপস্থিতিতে আদালত রায় প্রকাশ করেন। সোহাগ ওরফে বড় সোহাগের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
এদিকে আদালতের রায় প্রকাশের পর দণ্ডপ্রাপ্ত সোহাগ ওরফে বড় সোহাগ তার পরিকল্পনা মোতাবেক তার ফুফাতো ভাইকে (মৃত হাসান উদ্দিন ছেলে মো. হোসেন) ‘সোহাগ’ বানিয়ে ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি তাকে আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়ে জামিন আবেদন করে। আদালত জামিন নামঞ্জুর করে নকল সোহাগকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী, মাদকাসক্ত হোসেন ওরফে নকল সোহাগ প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে জেলহাজতে যায়।
র্যাব জানায়, মো. হোসেন ওরফে নকল সোহাগ (৩৫) মাদকাসক্ত হওয়ায় বাল্যকাল থেকেই আসল সোহাগের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। আসল সোহাগ নকল সোহাগকে (মো. হোসেন) জেলহাজতে পাঠানোর আগে ২-৩ মাসের মধ্যে বের করে নিয়ে আসবে বলে আশ্বস্ত করে।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে টিটু হত্যা মামলায় একজনের পরিবর্তে অন্যজন জেলা খাটার বিষয়টি এক সাংবাদিক আদালতের নজরে নিয়ে আসলে আদালত কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন চায়। পরে কারা কর্তৃপক্ষের দাখিল করা প্রতিবেদনে ২০১০ সালে গ্রেফতার আসামি সোহাগ আর বর্তমানে হাজতে থাকা নকল সোহাগের অমিলের বিষয়টি উঠে আসে। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের রিপোর্টে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে ২০২১ সালের আগস্ট মাস থেকে র্যাব-১০ এর অপারেশন টিম ও র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা টিম কাজ করে আসছিল। এরই মধ্যে বিশেষ দায়রা আদালত ও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ প্রকৃত আসামির (সোহাগ) বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
এদিকে আসল সোহাগ ঘটনা প্রকাশের বিষয়টি বুঝতে পেরে সুকৌশলে দেশত্যাগের চেষ্টা শুরু করেন। এর জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র পরিবর্তন করে পাসপোর্ট তৈরি করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভিসা সংগ্রহ করেন তিনি। দেশত্যাগের ক্ষেত্রে করোনার টিকা বাধ্যতামূলক হওয়ায় গতকাল (২৯ জানুয়ারি) করোনার দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল মিডফোর্ড হাসপাতাল আসেন।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-১০ এর অপারেশন টিম র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার সহযোগিতায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে রাত ৮টায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল মিডফোর্ড হাসপাতাল এলাকা থেকে টিটু হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সশ্রম সাজাপ্রাপ্ত প্রকৃত আসামি সোহাগ ওরফে বড় সোহাগকে গ্রেফতার করে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতার প্রকৃত আসামি সোহাগের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ২টি হত্যা মামলা, ২টি অস্ত্র মামলা ও ৬টি মাদক মামলাসহ সর্বমোট ১০টি মামলা রয়েছে। তাকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তরের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানায় র্যাব।