মো. শহীদুল্লাহ মানসুর: মানব জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শৈশব। আপাত-দৃষ্টিতে শিশু পরনির্ভরশীল বিবেচিত হলেও একটি দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে শিশুদের উপরেই। তাই পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব শিশুদের অধিকার রক্ষা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা কিন্তু বাস্তবতা হল দেশের কয়েক লাখ শিশু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফের প্রতিবেদন বলেছে, কোভিড-১৯ সংকটের ফলে আরও কয়েক লাখ শিশুকে শিশু শ্রমের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এরই মধ্যে শ্রমে থাকা শিশুদের কর্মঘণ্টা বেড়েছে, তুলনামূলক খারাপ পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে যা শিশুদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকির কারণ হবে। গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে শিশুদের নির্যাতনের খবর আমরা হরহামেশাই পেয়ে থাকি।
শিশু ও শিশু শ্রম
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, আঠারো (১৮) বছরের কম বয়সী যেকোন ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ২(৬৩) ধারা অনুযায়ী, ১৪ বছরের নিচে যে কোন ব্যক্তিকে শিশু ও ২(৮) ধারা অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে সকল ব্যক্তিকে কিশোর বলে বিবেচনা করা হবে। শিশু আইন, ২০১৩ এর ৪ ধারা অনুযায়ী, অন্য আইনে যাই বলা থাকুক, ১৮ বছরের নিচে সকল ব্যক্তিকে শিশু বলা হবে।
সাধারণত যখন কোন শিশু বেচে থাকার তাগিদে বা পারিবারিক চাপে কোনো কর্মে নিযুক্ত হয় তখন তাকে শিশু শ্রম বলা হয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ও জাতিসংঘ শিশু সনদে অনুযায়ী- ‘কোনো শ্রম বা কর্মপরিবেশ কোন শিশুর স্বাস্থ্য বা দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক ও ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায় তখন তা শিশু শ্রম হিসেবে বিবেচিত হবে।’ অন্যভাবে শিশুশ্রম বলতে শিশুদের পড়াশোনার সময় তাঁকে দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন কাজ এবং পরোক্ষভাবে গার্হস্থ্য শ্রমে নিযুক্ত করাকে বোঝায়। সারা বিশ্বে ১২ই জুন “বিশ্ব শিশু শ্রম প্রতিরোধ” দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলাদেশের আইনে শিশু শ্রমকে নিষিদ্ধ করা হলেও গ্রাম ও শহরে সমান তালে শিশুশ্রম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ সরকার নানানভাবে শিশুশ্রম বন্ধের চেষ্টা করলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়েই পরিবারের আর্থিক সংকটের কারণে শিশুরা শ্রমে যুক্ত হলেও বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই শ্রমে যুক্ত হতে হচ্ছে।
শিশু অধিকার ও আইন
শিশুর অধিকারকে সাধারণত দুই ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়,
দেশীয় আইনে অধিকার
১. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকদের সাথে শিশুদেরও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদে দেশের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে। সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্র সকল নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। ১৭ অনুচ্ছেদে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা নিশ্চিত করছে। এছাড়াও ৩৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, জবরদস্তি শ্রমে নিযুক্ত করা যাবে না। যদি করা হয় তবে তা ফৌজদারী অপরাধ হবে। আরো বলা যায় যে, শিশুরা দেশের নাগরিক হিসাবে ১৮, ১৯, ২০, ২৯, ৩১, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ অনুচ্ছেদ গুলোয় উল্লেখিত সকল মৌলিক অধিকার সমানভাবে ভোগ করতে পারবে।
২. বাংলাদেশে শিশু অধিকার সংরক্ষণে সর্বপ্রথম ১৯৭৪ সালে আইন পাশ হলেও তাতে সংশোধনী এনে “শিশু আইন, ২০১৩” নামে সময় উপযোগী বিধানাবলী যুক্ত করে নতুনভাবে প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের নবম অধ্যায়ে (৭০-৮৩ ধারা) শিশু সংক্রান্ত বিশেষ অপরাধের জন্যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আইনে শিশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা, শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োগ, শিশুর দায়িত্বে থাকাকালে নেশা গ্রস্ত হলে, শিশুকে নেশাগ্রস্তকারীমাদকদ্রব্য কিংবা বিপজ্জনক ঔষধ প্রদান করলে, মাদক দ্রব্য কিংবা বিপজ্জনক ঔষধ বিক্রয়ের স্থানসমূহে প্রবেশের অনুমতি দিলে, শিশুকে যৌনপল্লীতেথাকিবার অনুমতি দিলে, শিশুকে পলায়নে সহায়তা দেয়াসহ অন্যন্য কাজ করলে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। একই আইনের ৮৯ ধারায় উল্লেখিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা ৮৫ ধারায় প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যার অধিকারী হবে।
আন্তর্জাতিক আইনে অধিকার
একাধিক আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইনে শিশুর অধিকার নিশ্চিত করতে সদস্য দেশগুলো সম্মত ও চুক্তি সাক্ষর করেছে। UNCRC, ILO, the worst forms of child labour,1999, IHL, UN charter সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক আইনে শিশুর শিক্ষা, বাসস্থান, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসহ শিশুর অন্যান্য মৌলিক অধিকারের কথা উল্লেখ করে সদস্য দেশগুলোকে তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শিশুশ্রম ও আইন
১. বাংলাদেশ শ্রম আইন,২০০৬ এর ৩৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোন শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। তবে কিশোর হলে শর্ত সাপেক্ষে কাজের অনুমতি দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে সরকার চাইলে যেকোন মুহূর্তে কিশোর নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে পারবে। এই আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী, কোন অভিভাবক শিশুকে কাজে নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি দিয়ে চুক্তি করতে পারবে না, করলেও সেটি অবৈধ চুক্তি বলে বিবেচিত হবে। যদি কোন ব্যক্তি ৩৪ ধারা অমান্য করে শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ দিলে বা অনুমতি দিলে ঐ ব্যক্তিকে পাঁচ হাজার টাকা এবং ৩৫ ধারার বিধান লঙ্ঘনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের দন্ডিত করা যাবে।
২. বাংলাদেশ শ্রম আইন,২০০৬ এর ৩৯ ও ৪০ ধারা অনুযায়ী, সরকার কতৃক ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে কিশোর নিয়োগ করা যাবে না অর্থাৎকোন চলমান যন্ত্র পরিষ্কার করা বা তেল প্রদান বা অন্য কোন কাজে নিযুক্ত করা যাবে না তবে ৪০ ধারা অনুযায়ী, কোন কিশোরকে কোন যন্ত্র সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সম্ভাব্য বিপদ ও সতর্কতা সম্পর্কে জানিয়ে কাজ করার অনুমতি দেওয়া যাবে।
কিশোরের কর্মঘণ্টা
বাংলাদেশ শ্রম আইন,২০০৬ এর ৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানে কিশোর শ্রমিক কর্মরত থাকলে সেখানে ৪১ ধারায় উল্লেখিত কিশোরের কর্ম ঘন্টা, নির্দিষ্ট সময় উল্লেখপূর্বক নোটিশ প্রদর্শন করতে হবে।
বাংলাদেশ শ্রম আইন,২০০৬ এর ৪১ অনুযায়ী, কোন কিশোরকে কোন কারখানায় বা খনিতে দৈনিক পাঁচ ঘন্টা এবং সপ্তাহে ত্রিশ ঘন্টার বেশি বা অন্য কোন ধরণের প্রতিষ্ঠানে দৈনিক সাত ঘন্টা এবং সপ্তাহে বিয়াল্লিশ ঘন্টার বেশি সময় কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কোন প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা ৭-০০ টা হতে সকাল ৭-০০ টার মধ্যবর্তী সময়ে কোন কাজ করতে দেওয়া যাবে না। কাজের সময়কে দুইটি পালায় সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, প্রতিটি পালার সময়সীমা সাড়ে সাত ঘন্টার বেশী হবে না এবং একই দিনে একাধিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবে না।
মন্তব্য
বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই শিশু শ্রম সময়ের সাথে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দারিদ্যতাকে ভিত্তি করে শিশু শ্রম বৃদ্ধি পেলেও শুধু শিশু শ্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। অর্থের লোভ দেখিয়ে শিশু পাচার করে তাদের দিয়ে অনৈতিক ও অপরাধমূলক কাজ করানো হচ্ছে। সাধারণত শিশুরা অর্ধেক মজুরিতে কাজ করে তাই শিশু শ্রমের চাহিদা অনেক বেশি। যদিও সুস্থ ও স্বাভাবিক শৈশবের নিশ্চয়তা সকল শিশুর জন্মগত অধিকার তথাপি পরিবারের দারিদ্রতা ও পরিস্থিতির শিকার হয়ে অনেক শিশুই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিশুর সুন্দর শৈশব নিশ্চিত করতে দেশে একাধিকবার জাতীয় শিশু শ্রম নিরসন নীতি গ্রহণ করে কিছুটা কমানো গেছে। দেশের মানুষকে সচেতন করার জন্যে নানান ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। চলমান আইনে পরিবর্তন এনে কিশোরদের তুলনামূলক কোন ঝুকিপুর্ন কাজে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে কিশোররা পরিবারের পাশে দাড়াচ্ছে সাথে ঝুঁকিও কিছুটা কমেছে।
National plan of action to eliminate child labour (2021-2025) এর তথ্য অনুসারে, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে ৫-১৭ বছর বয়সী শিশু শ্রম ৭৬ লাখে থেকে ৩৫ লাখে নেমে আসে যা ২০১৮ সালে এসে আরো অনেক কমে যায় যদিও ২০১৯ এর শেষ থেকে করোনার প্রভাবে আবারো দ্রুত শিশু শ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বোপরিশিশু শ্রম নিরসনে দলমতভেদাভেদ বন্ধ করে সবাই মিলে কাজ করতে হবে তবেই শিশুকে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ উপহার দেওয়া সম্ভব হবে।
লেখক: শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জজ কোর্ট, ঢাকা।