মোহাম্মদ সেলিম মিয়া: পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সরকার ‘পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০’ রহিত করে ২০১০ সালে ‘পরিবেশ আদালত আইন’ নামে সম্পূর্ণ নতুন আইন প্রণয়ন করেন। বর্তমান আইনে প্রত্যেক জেলায় একজন যুগ্ম-জেলা জজকে দিয়ে এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত স্থাপনের কথা বলা থাকলেও বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামে শুধু ২টি পরিবেশ আদালত আছে। এছাড়া রয়েছে ১টি পরিবেশ আপীল আদালত, যা ঢাকায় অবস্থিত।
এই আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে সরকার, সরকারী গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা, প্রত্যেক জেলায় এক বা একাধিক স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা আছে এবং পরিবেশ আইনে বর্ণিত সকল অপরাধের মামলা বিচারের জন্য সরকার, সুপ্রীম কোর্টের সাথে পরামর্শক্রমে, কোন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বা ১ম শ্রেণীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে কোন নির্দিষ্ট এলাকার জন্য এককভাবে বা তাঁর সাধারণ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটরূপে নিয়োগ করার কথা বলা আছে।
এই স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত হলো পরিবেশ বিষয়ক অপরাধের মামলার ফাইলিং আদালত। আইনে বর্ণিত সকল অপরাধের বিচারের জন্য স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সরাসরি মামলা দায়ের করতে হয় অথবা ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে থানায় এজাহার দায়ের করতে হয়। থানার মামলার ক্ষেত্রে অন্যান্য জিআর মামলার মতো পরিবেশ আদালতে বদলি পর্যন্ত উক্ত ম্যাজিস্ট্রেট আদালতই মামলা দেখভাল করেন আর পরিবেশ সংশ্লিষ্ট যে অপরাধগুলো বিচার করার ক্ষমতা উক্ত ম্যাজিস্ট্রেটের রয়েছে সেগুলোর বিচারও উক্ত স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেই হয়। এই আদালতের যে কোন আদেশ, রায়ের বিপরীতে মিস আপীল/রিভিশন হয় পরিবেশ আপীল আদালতে। মোটকথা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত পরিবেশ বিষয়ক অপরাধ দমনের জন্য প্রাণভোমরা। কারণ কেউ মামলা করতে চাইলে প্রথমে অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ জানাতে হয় তখন প্রতিকার না পেলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেই মামলা করতে পারেন।
ঢাকার পরিবেশ আদালতে নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি পরিবেশ সংশ্লিষ্ট মামলা খুবই কম। শুধু নামেই পরিবেশ আদালত আছে, অন্য মামলাই বিচার করেন বেশি। এর পিছনে অবশ্য কিছু কারণও আছে।
প্রথমত আইনজীবী এবং ম্যাজিস্ট্রেটদের মধ্যে আইনের প্রয়োগ নিয়ে জ্ঞানের অভাব আছে। বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট অপরাধের মামলা পরিবেশ আদালতে করতে হয় অথচ ফাইলিং আদালত হলো স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। পরিবেশ আদালতে কেবল ক্ষতিপূরণ মামলা অর্থাৎ দেওয়ানী মামলা করা যায়।
আরেকটি কারণ হলো, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষ করে তবেই এ আদালতে মামলা করা যায়। ফলে মামলার রায় পেতে পেতে অনেক সময় পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাটসহ পরিবেশ ধ্বংসকারী অনেক কাজ শেষ হয়ে যায়।
পরিবেশ আদালত আইনে যদিও জনগণকে সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার দেওয়া হয়নি তথাপি পরিদর্শক কোন অপরাধের অভিযোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি এর ভিত্তিতে পরবর্তী ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ না করেন অথবা উক্ত অভিযোগ গ্রহণের যৌক্তিকতা আছে, তাহলে সংশ্লিষ্ট পরিদর্শক বা মহা-পরিচালককে শুনানীর যুক্তিসংগত সুযোগ দিয়ে কোন লিখিত রিপোর্ট ব্যতিরেকেই সরাসরি উক্ত অভিযোগ এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধ স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট বিচারার্থ গ্রহণ করতে বা যথাযথ মনে করিলে অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের জন্য উক্ত পরিদর্শককে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করতে পারেন। তবে পরিবেশ আপীল আদালত অভিভাবক হিসাবে দেশের সকল জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের আরও সক্রিয় করে পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধ দমনে আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
এই আইনের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি দিক তা হলো জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক অর্থাৎ স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা। আইনের ১২(১১) ধারা অনুযায়ী, স্পেশাল ম্যাজিষ্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট অনুষ্ঠানকালে পরিদর্শক বা এতদুদ্দেশ্যে মহা-পরিচালকের নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা এতদুদ্দেশ্যে সরকারের নিকট হতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, এই ধারায় বর্ণিত আনুষ্ঠানিকতা ব্যতিরেকে অর্থাৎ অনুসন্ধান তদন্ত ছাড়াই পরিবেশ আইনে উল্লিখিত কোন অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে অভিযোগ সরাসরি স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দায়ের করতে পারবেন এবং এর ভিত্তিতে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট সংশ্লিষ্ট অপরাধ আমলে নিতে ও এর বিচার করতে অথবা ক্ষেত্রমত, বিচারার্থ প্রেরণ করতে পারবেন।
অর্থাৎ ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮ আওতায় জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় ক্ষমতাবান। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের বিচার শাখা-৩ থেকে প্রকাশিত বিগত ১৯/০৩/২০০৮ ইং তারিখের প্রজ্ঞাপনে পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধের বিষয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করেছে।
পাশাপাশি নির্বাহী হাকিমগণ (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন (মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯) এর অধীনে গঠিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পরিবেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের অধীনে কিছু অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে নিয়ে দণ্ডারোপ করে থাকেন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্টের কিছু পার্থক্যও আছে। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয় ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী পক্ষান্তরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয় মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ অনুযায়ী। জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্টে কোন ফাইন (জরিমানা/অর্থদণ্ড) তৎক্ষনাৎ না দিতে পারলে অভিযুক্ত পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ফৌজদারী কার্যবিধি ৩৮৮ ধারা অনুযায়ী তা পরিশোধ করতে পারেন, যা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্টে সম্ভব নয়। যা অনেকের জন্য হার্ডশিভ বা অনেকক্ষেত্রে অমানবিক বা অসাংবিধানিকও বটে।
পরিবেশ আইনে বর্ণিত সকল অপরাধের বিচারের জন্য যেহেতু স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটই ক্ষমতাবান, তাছাড়া এসংক্রান্ত মামলা পরিচালনায় তাঁর একটা এক্সপার্টিস তৈরি হয় এবং মোবাইল কোর্ট করারও এখতিয়ার বটে সেকারণে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে দিয়েই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করানো যেতে পারে। সেটা আরও বেশি কার্যকর হবে বলে আশা করি। সেক্ষেত্রে ঢাকা বা বিভাগীয় শহর থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার জন্য বসে থাকা লাগবে না। প্রত্যেক জেলার স্ব স্ব জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদেরকে মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করা যেতে পারে এবং উভয় ডিপার্টমেন্টের স্বার্থে স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটগণ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের যোগাযোগ বাড়াতে পারে। ইতিমধ্যে নারায়ণগঞ্জ, ফেনী, হবিগঞ্জ এবং পটুয়াখালীতে পরিবেশ অপরাধ দমনে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছেন।
তবে পরিবেশ আইনে বর্ণিত সকল অপরাধের বিচারের জন্য যেহেতু পরিবেশ অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেহেতু তাদের জনবল বৃদ্ধি ছাড়া কোন কার্যক্রমই সফলতার মুখ দেখবে না।
পরিবেশ বিষয়ক আইন দেখে মনে হয় এটি তৈরি করা হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের জন্য, জনগণ বা ভুক্তভোগীদের জন্য নয়। পরিবেশ আদালত বিশেষায়িত বিচারিক আদালত, আইনানুযায়ী পরিবেশ-সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ত্বরান্বিত করাই যার একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু পরিবেশ আদালত বিদ্যমান ফৌজদারি ও দেওয়ানি কার্যবিধি এবং সাক্ষ্য আইন অনুসারে বিচারকাজ পরিচালনা করে, এর জন্য পৃথক কোনো কার্যপ্রণালী বিধিও তৈরি করা হয়নি। পরিবেশ আদালতের এখতিয়ারও স্পষ্ট ও সরলসোজা নয় বরং অহেতুক জটিল। বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনসমূহের মধ্যে পরিবেশের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত আইনের সংখ্যা প্রায় দুইশ’ (২০০)।
পরিবেশ আদালত শুধু ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫’ এবং ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ এর অধীন অপরাধসমূহের বিচার এবং ক্ষতিপূরণের দাবি বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারে। তবে আইনের উদ্দেশ্যপূরণকল্পে সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নির্ধারিত অন্য কোন আইন, এবং এই সকল আইনের অধীন প্রণীত বিধিমালাও অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে বলা হলেও আজ পর্যন্ত অন্য কোন আইন অন্তর্ভুক্ত হয়নি। কিন্তু দেশের বন ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, মৎস্য-সম্পদ, পানিসম্পদ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে মামলা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট বা পরিবেশ আদালতে মামলা করা যায় না। অর্থাৎ পরিবেশের সার্বিক বিষয়ে মামলা গ্রহণ করার এখতিয়ার উক্ত আদালতের নেই। যদিও দেশের সর্বোচ্চ আদালতে রিট আবেদনের সুযোগ রয়েছে।
আশা করি খুব দ্রুত পরিবেশ সংক্রান্ত অপরাধ সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হবে।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।