পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া ইশতিয়াক হোসেন জনি (বায়ে)। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত তিন পুলিশ সদস্য (ডানে)
পুলিশ হেফাজতে মারা যাওয়া ইশতিয়াক হোসেন জনি (বায়ে)। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত তিন পুলিশ সদস্য (ডানে)

জনি হত্যার ৮ বছর: পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও রায় দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি

পুলিশ হেফাজতে ইশতিয়াক হোসেন জনির হত্যার ০৮ বছর পূর্তি হয়েছে আজ। জনির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও দ্রুত রায় বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)।

আজ বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) এ দাবি জানিয়েছে মানবাধিকার ও আইন সহায়তা প্রদানকারী সংস্থাটি।

একইসঙ্গে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি এবং তাদের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের দাবি জানানো হয়েছে।

আদালতের রায় ও মামলার বর্তমান অবস্থা

২০১৪ সালের আজকের দিনে (৯ ফেব্রুয়ারি) পুলিশি হেফাজতে মীরপুরের বাসিন্দা দুই সন্তানের জনক ইশতিয়াক হোসেন জনির (৩২) মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় মহানগর দায়রা জজ আদালতে নির্যাতন ও হেফাজতে মুত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর অধীনে দায়েরকৃত মামলার রায় ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়।

রায়ে পুলিশের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড ও এক লক্ষ টাকা করে অর্থদন্ড এবং অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদন্ড প্রদানের নির্দেশ দেন আদালত। পাশাপাশি প্রত্যেককে দুই লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ দেন।

এছাড়া পুলিশের সোর্স দু’জনের বিরুদ্ধে অপরাধে সহায়তা করার প্রমাণ পাওয়ায় আদালত তাদেরকে সাত বছর করে কারাদন্ড ও বিশ হাজার টাকা অর্থদন্ড এবং অনাদায়ে তিন মাসের কারাদন্ডের আদেশ দেন।

যাবজ্জীবন প্রাপ্ত আসামিরা হলেন- পল্লবী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহিদুর রহমান জাহিদ, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) রাশেদুল, এএসআই) কামরুজ্জামান। সাত বছর দণ্ডপ্রাপ্ত ২ জন হলেন- পুলিশের সোর্স সুমন ও রাশেদ।

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর আওতায় দেশে এটাই ছিল প্রথম কোনো মামলায় রায়। রায়ের পর্যবেক্ষণে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ উল্লেখ করেছিলেন নির্মম এই হত্যাকান্ডে শুধু আইনের লঙ্ঘনই ঘটেনি বরং মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়েছে।

২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কর্তৃক রায় প্রদান করা হলেও, যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা পরবর্তীতে হাইকোর্টে আপীল দায়ের করলে, হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায়ের উপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। অন্যদিকে সাজাপ্রাপ্ত ৫ জন আসামীর মধ্যে ২ জন এখনো পলাতক। বর্তমানে এই আপীলগুলো হাইকোর্টে শুনানীর জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।

এ প্রেক্ষিতে ব্লাস্ট হেফাজতে নির্যাতনের শিকার সকল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের জন্য সরকারি ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের জোর জানায়। পাশাপাশি পুলিশ হেফাজতে নিহত জনির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান ও সাজাপ্রাপ্ত দুই পলাতক আসামীকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি ব্লাস্টের।

পরিবার ও আইনজীবীদের বক্তব্য

এই প্রসঙ্গে নিহত জনির ভাই এবং মামলার একজন বাদী ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেন, “অনেক কষ্টের বিনিময়ে এই রায়টা পেয়েছি কিন্তু অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে ইতোমধ্যে। তাই এই রায় দ্রুত বাস্তবায়নের জোর দাবী জানাচ্ছি। আমার ভাইয়ের দুই সন্তানের দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় ভাবে নেয়া, যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং যে সব আসামী পলাতক রয়েছে তাদের দ্রুত গ্রেফতারের জোর দাবী জানাচ্ছি।”

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এবং ব্লাস্টের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ এর সদস্য এডভোকেট জেড আই খান পান্না বলেন,“যে কোন মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে পরিবারের যে ভোগান্তির শিকার হয় তা হতে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট নীতিমালা ও মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির পদক্ষেপ থাকা প্রয়োজন। যে কোন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা তার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য কল্যাণ তহবিল থাকা প্রয়োজন।”

“উচ্চ আদালতে চলমান ০৩ টি ক্রিমিনাল আপীল মামলার শুনানী দ্রুত সম্পন্ন হয়ে জনি হত্যা মামলায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে”- মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. বদিউজ্জামান তফাদার।

ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এড. এস. এম. রেজাউল করিম আশাব্যক্ত করেন যে, “উচ্চ আদালতে শুনানীর জন্য অপেক্ষামান ক্রিমিনাল আপীল মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে অধস্তন আদালতের রায় বহাল থাকবে এবং পলাতক আসামীদের ধৃত/গ্রেফতার করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা হবে।”

প্রেক্ষাপট

গত ২০১৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে রাজধানীর মিরপুর নিবাসী গাড়ি চালক মো: ইশতিয়াক হোসেন জনি বন্ধুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে পুলিশের কথিত সোর্স এর অশালীন আচরণের প্রতিবাদ করলে পল্লবী থানার তখনকার কর্তব্যরত এস আই জাহিদ, জনি ও তার ভাই রকিসহ ৫ জনকে থানায় নিয়ে যায়। গুরুতর অবস্থায় ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক জনিকে মৃত ঘোষণা করেন।