ড. ফরিদ আহমদ সোবহানী:
এক.
২০১৪ সাল। আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। সেখানে আমার শ্যালকের প্রিয় ব্যক্তি তথা রতন কান্তি নাথের বাসায় ক’দিন ছিলাম। রাতে খাবারের সময় রতনদা বললেন ‘আপনাদের জন্য হালাল শপ থেকে বাজার করেছি। খেতে কোন প্রকার সংকোচ করবেন না’। রতনদার মুখে হালাল শপের কথা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলাম।
ডিনার সেরে আড্ডার ফাঁকে রতনদা আমাদের বললেন, ‘আপনারা তো নামাজ পড়েবেন, তাই জায়নামাজের ব্যবস্থা করেছি’। কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন ‘আপনাদের রুমে একটি মূর্তি ছিল। সেটি এখন অন্য রুমে রাখা হয়েছে। আশা করি ধর্ম পালনে আপনাদের কোন সমস্যা হবে না’। যে ক’দিন ছিলাম, বুঝতে অসুবিধা হয়নি, সনাতন ধর্মের অনুসারী রতনদা অত্যন্ত ধার্মিক এবং তিনি অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল। রতনদার আতিথেয়তার কথা আমরা কোনদিন ভুলবো না। সম্প্রীতির সেই দিনগুলোর স্মৃতি এখনো মানসপটে ভাসে।
দুই.
২০০১ সাল। উচ্চশিক্ষার্থে তখন বেলজিয়ামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের সাবেক ডিন প্রফেসর জাকির হোসেন তথা সহপাঠী জাকির ভাইয়ের মাধ্যমে পরিচিত হই প্রবাসী মলয় চন্দ্র দে’র সাথে। তিনি তখন বেলজিয়ামের এনটর্প সিটি’তে থাকতেন। দু’দিন ছিলাম মলয়দার বাসায়। বাসায় উঠেই মলয়দা’কে জিজ্ঞেস করি, ‘মলয়দা, পশ্চিম কোন দিকে? মলয়দা বললেন, ‘সোবহানী, এখানে পশ্চিম দিক ফিরে নামাজ পড়লে হবে না। কারণ, কেবলা পূর্ব দিকে।’ হাসিমাখা মুখে মলয়দার সেই ‘কেবলামুখী’ কথাগুলো এখনও কানে বাজে।
ইহুদি নিয়ন্ত্রণাধীন এনটর্পের ডায়মন্ড সিটির পাশেই ছিল মলয়দার বাসা। তিনি আমাকে ডায়মন্ড সিটি ঘুরে দেখান। পুরো ডায়মন্ড সিটি’তে অনেক দাড়ি-টুপিওয়ালা লোক দেখে অবাক হয়ে যাই। মলয়দা জানালেন, তারা ইহুদি। ইহুদিরাও দাড়ি রাখে টুপি পরে তা আগে জানতাম না। জীবনে প্রথম সেইদিন ইহুদিদের সরাসরি দেখলাম। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সম্প্রীতি নিজ চোখে দেখে এসেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তৎকালীন সহপাঠী ড. মাহমুদ, তৈয়ব ভাই, আতিক ভাই ও পারভিন আপা নিশ্চয়ই সেই দিনগুলোর সাক্ষী বহন করছেন।
তিন.
১৯৭৯ সাল। কালিয়াচাপড়া চিনিকল কোয়ার্টারে আমাদের বাসার পাশেই ছিল কাচিক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের তৎকালীন সহ-সভাপতি বাবু বেনু ভূষণ কর (বেনু কাকা)’র বাসা। প্রতিদিন দেখা হতো কাকার পরিবারের সদস্য: অজয়দা, সবিতা আপা, নমিতা, রিতা, মিতা, দীপন ও চয়নের সাথে। বেনু কাকা ও কাকিমা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। গত কিছুদিন পূর্বে সবিতা আপার সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়। তিনি এক এক করে আমাদের সবার খোঁজ খবর নেন এবং সস্ত্রীক কলকাতায় বেড়ানোর দাওয়াত দেন। সহপাঠী নমিতা ফোন করে প্রায়ই খোঁজখবর নেয়।
শিক্ষাজীবনের অনেক সহপাঠীর মাঝে হারাধন, নিরঞ্জন, বিমান, বিধান, সৌমেন ও পরিপন ছিল আমাদের অনেকের কাছেই প্রিয়। খুব মিস করি তাদের। স্কুল জীবনে কত সকাল দুপুর শতুবাবুর পুকুরে দাপিয়ে বেরিয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে, তার ইয়ত্তা নেই। শতুবাবুর পুকুর বা অন্য কোথাও বর্তমান প্রজন্মের ছেলেরা আমাদের মতো সম্প্রীতির সাঁতার কাটে কিনা জানিনা!
পবিত্র ইসলামে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আমার জানামতে অন্য ধর্মেও তাই। একজন ধার্মিক অবশ্যই পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন। কোন ধর্মীয় পোশাক, হিজাব-নিকাব কখনোই সম্প্রীতি বিনষ্টের কারণ হতে পারে না। ধর্মান্ধতা পরিহার করে নিজ নিজ ধর্মের যথাযথ অনুসরণ করলে অবশ্যই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে দেশে বিদেশে সর্বত্র।
লেখক: অধ্যাপক, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।