সিরাজ প্রামাণিক: তালাকের পর স্ত্রী কর্তৃক নারী নির্যাতন, যৌতুক মামলা হলে হতাশ না হয়ে আইন ও আদালতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মামলাটিতে লড়ে যান। স্ত্রী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর থানা কিংবা আদালতে গিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ)/৩০ ধারায় অথবা যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় মামলা করে থাকেন। যদি কোন নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষের কোন ব্যক্তি যৌতুক চায় অথবা উক্ত নারীর সাধারণ জখম করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি এ ধারায় অপরাধী হবেন।
আপনি জেনে আনন্দিত হবেন যে, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে যৌতুক সংক্রান্ত ১১ (গ)/৩০ ধারাটি এবং যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারাটিও আপোষযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই আপনার বিরুদ্ধে মামলা হলে এজাহারের কপিটি সংগ্রহ করুন। যদি এমন হয় যে, আপনি জানতে পারলেন না আর হঠাৎ পুলিশ এসে আপনাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে গেল, তাহলে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনাকে কিন্তু আদালতে চালান করে দেবে। তখন একজন আইনজীবী নিয়োগ করে জামিনের আবেদন করুন। যদি দলিলপত্র ও সাক্ষ্য প্রমাণ ঠিক থাকে, তাহলে মিথ্যা মামলায় সহজেই আপনি জামিন পেয়ে যাবেন। মামলা থেকে পালিয়ে থাকা কিন্তু মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এতে আপনার অনুপস্থিতিতেই সাজা হয়ে যেতে পারে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগটির সত্যতা না পেলে তদন্ত শেষে আপনাকে নির্দোষ দেখিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন অর্থাৎ ফাইনাল রিপোর্ট আদালতে দাখিল করতে পারেন। আর জামিন না-হলে পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালতে জামিন আবেদন করতে পারেন। এছাড়া আপনি মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতির জন্য আবেদন করতে পারেন। অব্যাহতির আবেদন নাকচ হলে উচ্চ আদালতে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, যদি থানায় মামলা না হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়, সেক্ষেত্রে মামলাটি তদন্ত কিংবা গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও আপনি সরাসরি আদালতে গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইতে পারেন। ক্ষেত্র বিশেষে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে আপনি আগাম জামিনও চাইতে পারেন। একটি অপরাধ জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য যাই হোক না কেন, যুক্তিসঙ্গত কারণ সাপেক্ষে একজন পুলিশ কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট বা জজ স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে জামিন মঞ্জুর বা না-মঞ্জুর করতে পারেন।
এক্ষেত্রে আসামী গ্রেফতার হলে কিংবা সমন প্রাপ্তির পর আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করে আসামীপক্ষ বিজ্ঞ আদালতে নিবেদন করেন যে, বাদিনী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর আসামীর প্রতি রাগান্বিত ও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ আদালতের সামনে ফিরিস্তি আকারে তালাক প্রদানের নোটিশ, ডাক রশিদ, প্রাপ্তি স্বীকারসহ উপযুক্ত প্রমাণ পেশ করে থাকেন। মাননীয় আদালত সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবং তালাকের পর মামলা সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আসামীকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়ে থাকেন। এরপর মামলাটির পরবর্তী ধাপ থাকে সংশ্লিষ্ট ধারায় অভিযোগ গঠন বিষয়ে। চার্জ গঠন বিষয়ে শুনানীর সময় আসামী পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী বিচারকের নিকট অব্যহতি চেয়ে আবেদন পেশ করেন। যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন তালাকের পরে যদি মামলা দায়ের করা হয় তবে সেই ক্ষেত্রে মামলাটি অচল হবে এবং আসামী অব্যাহতি বা খালাস পাবেন। এ বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেন যে, মহামান্য হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলছেন, বিবাহ বিচ্ছেদ আগে হয়েছে। কাজেই কজ অব এ্যাকশনের দিনে ভিকটিমকে তার স্বামীর বাড়িতে থাকার কথা নয়। কিন্তু মাননীয় ট্রাইবুন্যাল আসামী পক্ষে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(সি) ধারামতে অব্যহতির আদেশ চেয়ে করা আবেদনটি খারিজ করে আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আসামী পক্ষ উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিভিশন দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে উক্ত অভিযোগ গঠন বাতিল করে আসামীকে অব্যহতি দেন। এরপর বাদী (রাষ্ট্র) পক্ষ মহামান্য হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান।
মাননীয় আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয় যে, অভিযুক্ত স্বামীকে খালাস দেওয়ার হাইকোর্টের আদেশ সঠিক। যা ১২ এডিসি, পৃষ্ঠা-৯৬ এবং ৬ এএলআর (এডি), ভলিউম-২, পৃষ্ঠা-৯০ এ রিপোর্টেড হয়েছে।
এবার দেখি যৌতুকের সংজ্ঞার মহামান্য হাইকোর্ট কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামী কিংবা স্ত্রীপক্ষ অন্য পক্ষের কাছে অর্থ-সম্পদ দাবি করলেই তা যৌতুক বলে বিবেচিত হবে না। এ ধরনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করলে সে মামলাও চলবে না। যৌতুক নিরোধ আইনে করা একটি মামলা বাতিল চেয়ে আসামির করা আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি আবদুর রবের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। আদালত একই সঙ্গে মামলাটির কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করেন। ওই মামলার আসামির নাম এন. এম শফিকুর রহমান। আদালত রায়ে বলেছেন, আইনে স্পষ্ট রয়েছে, বিয়ের সময়কার শর্ত হিসেবে বিয়ের মজলিসে কিংবা বিয়ের আগে অথবা পরে কোনো সময় অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে তবে তা যৌতুক হিসেব গণ্য হবে (৭ এএলআর, পৃষ্ঠা ৩১৩)।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।