দেশের বিভিন্ন জেলায় আট মামলায় ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানামূলে আটকের পর বিনা দোষে ১০০ দিন হাজতবাসের ঘটনায় ভুক্তভোগী কৃষককে ৮০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) হাইকোর্টের বিচারপতি জাফর আহমেদ ও কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।
ভুক্তভোগী কৃষকের নাম আজিজুর রহমান ওরফে আবদুল আজিজ। তিনি সাভারের ভাকুর্তার ফিরিঙ্গীকান্দা গ্রামের গেদু মিয়ার ছেলে।
একইসঙ্গে রুলে আজিজুর রহমান ওরফে আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানা থেকে জাল, মিথ্যা পরোয়ানা জারির বিষয়টি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সেই সঙ্গে ভুয়া পরোয়ানা জারির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি ভুয়া পরোয়ানার বিষয় তদন্ত করতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তদন্ত শেষে আগামী দুই মাসের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছন আদালত।
স্বরাষ্ট্র সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, অপরাধ তদন্ত বিভাগ ও বিশেষ শাখার প্রধান (অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপ মহাপরিদর্শক, পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার, ঢাকা, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার, মাদারীপুর, জামালপুর, গাজীপুরের পুলিশ সুপার, জয়দেবপুর থানার উপ-পরিদর্শক মো. জামাল উদ্দিনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে এদিন রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সৈয়দ ইউনুস আলী রবি। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নওরোজ মো. রাসেল চৌধুরী।
আইনজীবী সূত্রের খবর
গাজীপুরের জয়দেবপুর থানায় ২০১৭ সালের ২০ মার্চ আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা হয়। পরে ২০১৮ সালের ৬ মার্চ তাকে গ্রেফতার করে সাভার থানা পুলিশ। পরে তাকে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সোপর্দ করা হয়। শুনানি শেষে আদালত তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেন।
কয়েক দিন সেখানে থাকার পর আবদুল আজিজকে গাজীপুর জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। এর তিন দিন পর সেখান থেকে পাঠানো হয় কাশিমপুর কারাগারে। এভাবে দেশের বিভিন্ন কারাগারে ১০০ দিন কারাভোগ করার পর ২০১৮ সালের ১৩ মে তার জামিন হয়। পরে ১২ জুন তিনি মুক্তি পান।
ওই মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ জয়দেবপুর থানার পুবাইল তালুটিয়া বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ৪০০টি ইয়াবা বড়িসহ রিপা ও আমেনা নামে দুই মাদক কারবারিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এসময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে আজিজসহ নয়জন পালিয়ে যান।
মামলার নথি থেকে জানা যায়, কাশিমপুর কারাগারে থাকা অবস্থায় তাকে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি ও চান্দগাঁও থানার চারটি মামলায়, রাজধানীর মিরপুর থানার দুইটি মামলায়, জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার একটি মামলায় ও মাদারীপুর সদর থানার একটি মামলায় পরোয়ানার মাধ্যমে গ্রেফতার দেখানো হয়। এসব মামলায় তাকে চট্টগ্রাম কারাগার, মাদারীপুর কারাগার ও জামালপুর কারাগারে থাকতে হয়। সর্বশেষ তিনি ছিলেন কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
চট্টগ্রাম আদালতের আদেশ
চট্টগ্রাম মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ তৃতীয় আদালতের বিচারক বিলকিছ আক্তার গত বছর ২৯ মে এক আদেশে বলেন, চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানার মামলায় আজিজুর রহমান ওরফে আবদুল আজিজ নামে কোনো আসামি নেই।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আজিজুরের অন্তর্বর্তীকালীন হাজতি পরোয়ানার ফটোকপিতে শুধু দায়রা নম্বর ছাড়া আর কোনো কিছুর মিল নেই এবং আদালত (চট্টগ্রাম মহানগর যুগ্ম দায়রা জজ তৃতীয় আদালত) থেকে তার নামে কোনো গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়নি। এছাড়া অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকলে তাকে (আবদুল আজিজ) মুক্তির নির্দেশ দেন আদালত।
মাদারীপুর আদালতের আদেশ
মাদারীপুর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত গত বছরের ৩১ মে এক আদেশে বলেন, আবদুল আজিজকে (আজিজুর রহমান) হয়রানির জন্য বিচারক ও আদালতের সিল-স্বাক্ষর জাল করে মাদারীপুর সদর থানার একটি মামলায় তার নামে হাজতি পরোয়ানাসহ এক পাতার আদেশনামা তৈরি করা হয়েছে।
আদালতে উপস্থাপন করা ওই আদেশনামায় অনেক অসঙ্গতি আছে বলে আদালত উল্লেখ করেন। এরপর আদালত আজিজুর রহমানের ওই পরোয়ানা বাতিল ও অকার্যকর সাব্যস্ত করে অন্য কোনো মামলায় আটকাদেশ না থাকলে মাদারীপুর সদর থানার মামলাতেও তাকে মুক্তির আদেশ দেন। এভাবে আটটি মামলাতেই আবদুল আজিজের মুক্তির আদেশ দেন আদালত।
ভুক্তভোগী ও তাঁর আইনজীবীর বক্তব্য
সাভারের স্থানীয় কোনো একটি প্রভাবশালী মহল ভুয়া পরোয়ানা তৈরি করে তাকে হয়রানি করছে বলে দাবি আব্দুল আজিজের। তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশে ১০০ দিন হাজত খাটার পর ২০১৮ সালের ১২ জুন আমি ছাড়া পাই।
ছাড়া পেয়ে হয়রানির প্রতিকার চেয়ে ২০১৮ সালের ৩ জুলাই পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) কাছে লিখিত অভিযোগ করি। পরে ভুয়া পরোয়ানা ও পুলিশি হয়রানি থেকে প্রতিকার পেতে ২০১৯ সালের ১১ জুলাই গাজীপুর পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করি। কিন্তু কারও কাছ থেকে কোনো জবাব বা প্রতিকার পাইনি। যে কারণে চলতি মাসে হাইকোর্টে রিট করি।
আইনজীবী সৈয়দ ইউনুস আলী রবি জানান, আদালতের নির্দেশে সাতটি মামলা থেকে আবদুল আজিজ মুক্তি পেলেও গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার মাদকের মামলায় তিনি এখনো হাজিরা দিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।