দীপজয় বড়ুয়া: মামলা করার পর যদি বাদী তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন, সেক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ রয়েছে। ফৌজদারি কিছু গুরুতর অপরাধ ছাড়া আদালত অধিকাংশ সময় ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা প্রত্যাহারে সহায়তা দিয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমঝোতার ভিত্তিতে মামলা প্রত্যাহার হয়। ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা দায়ের করবার পর মামলা দায়েরকারী যদি মনে করেন যে তিনি আর মামলাটি পরিচালনা করবেন না, সেক্ষেত্রে মামলা প্রত্যাহারের সুযোগ দেয়া হয়েছে। আইনে আপস-অযোগ্য ফৌজদারি মামলাগুলোর প্রত্যাহারে আদালত খুব সতর্ক থাকার চেষ্টা করলেও আপসযোগ্য মামলাগুলোতে সহজেই মামলা প্রত্যাহার করা যায়। আর দেওয়ানি মামলাগুলো প্রত্যাহার করাও বেশ সহজ। ফৌজদারি কার্যবিধি ও দেওয়ানি কার্যবিধিতে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া বলা আছে।
ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করার নিয়ম
ফৌজদারি মামলা সাধারণত দু’রকম সি.আর কেস এবং জি.আর কেস। জি.আর কেসগুলো সাধারণত থানায় দায়ের করা হয়। অন্যদিকে সি.আর কেসগুলো দায়ের হয় সরাসরি ফৌজদারি আদালতে। জি.আর কেসগুলোতে বাদীপক্ষে রাষ্ট্র নিজেই আইনজীবী নিযুক্ত করেন, যাদের বলা হয় পাবলিক প্রসেকিউটর। অন্যদিকে সি.আর মামলাগুলোতে নালিশকারীকেই ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী নিযুক্ত করে মামলা পরিচালনা করতে হয়।
কোনো মামলায় পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাব কিংবা মামলার পক্ষগণের মধ্যে সমঝোতার কারণে মামলা প্রত্যাহারের প্রসঙ্গটি সামনে আসতে পারে। মামলা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধিতে দুই রকমের বিধান রাখা আছে। যেসব জি.আর মামলায় রাষ্ট্র নিজেই পক্ষ, সেসব মামলায় পাবলিক প্রসিকিউটরের তরফ থেকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা যায়। অন্যদিকে সি.আর কেসে নালিশকারী বা তার পক্ষ থেকে নিযুক্ত আইনজীবী মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করতে পারেন ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৮ ধারার অধীনে।
সরকারি কৌঁসুলির পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় বলা হয়েছে যে, সরকারি কৌঁসুলি বা পাবলিক প্রসিকিউটর আদালতের অনুমতি নিয়ে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত মোকদ্দমায়, সাধারণভাবে যেসব অপরাধে তার বিচার হচ্ছে, তার যেকোনো এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে পরিচালনা থেকে সরে যেতে পারেন। অভিযোগনামা প্রণয়নের আগে সরে গেলে ওই এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামির অব্যাহতি হবে; এবং অভিযোগ প্রণয়নের পর সরে গেলে অথবা এই আইন অনুসারে কোনো অভিযোগনামা প্রণয়ন করা প্রয়োজন না হলে ওই এক বা একাধিক অপরাধ সম্পর্কে আসামিকে খালাস দিতে হবে।
মামলা পরিচালনা থেকে সরে যাওয়ার উপযুক্ত কারণ সম্পর্কে সরকারি অভিযোক্তা আদালতকে সন্তুষ্ট করবেন। কেবল সরকারের তরফ থেকে মামলা থেকে সরে যাওয়ার আদেশ আদালত কর্তৃক অনুমতি প্রদানের জন্য যথেষ্ট কারণ হবে না। কার্যবিধির ৪৯৪ ধারার অধীনে মামলা প্রত্যাহারে বেশকিছু বিষয় আদালতের পর্যবেক্ষণে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। যেমন –
প্রথমত, মামলা প্রত্যাহারের আবেদন কেবল পাবলিক প্রসিকিউটরের তরফ থেকেই হতে হবে। এজাহারকারী কিংবা আসামির আবেদন কিংবা সরকারের কোনো আদেশের বলে মামলা প্রত্যাহার করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, মামলা প্রত্যাহারের যুক্তিযুক্ত কারণ কৌঁসুলির পক্ষ থেকে আদালতের সামনে ব্যাখ্যা করতে হবে। কেবল সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে আদালত মামলা প্রত্যাহারের আদেশ দেবে না। মামলা প্রত্যাহার সম্পর্কে আদালতের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
সুতরাং, আদালত যদি মামলা প্রত্যাহারের কারণ সম্পর্কে সন্তুষ্ট না হয়, সেক্ষেত্রে প্রত্যাহারের অনুমতি না দিয়ে মামলা এগিয়ে নেয়ার আদেশ দেবে। মামলার ভিকটিম বা এজাহারকারী যদি মনে করে রাষ্ট্রপক্ষ অহেতুক তাদের মামলাটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেক্ষেত্রে ক্ষেত্রবিশেষে দায়রা জজ আদালত কিংবা হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করতে পারে।
নালিশকারীর পক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার
ফৌজদারি কার্যবিধির ২৪৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো মামলার চূড়ান্ত আদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত ফরিয়াদি যদি ম্যাজিস্ট্রেটের সন্তুষ্টি বিধান করতে পারেন যে, তাকে নালিশ প্রত্যাহারের অনুমতি দেয়ার পর্যাপ্ত কারণ রয়েছে, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট তাকে সেই নালিশ প্রত্যাহারের অনুমতি দেবেন এবং আসামিকে খালাস দেবেন। উল্লেখ্য যে, এই ধারাটি শুধু নিষ্পত্তি যোগ্য মামলার ক্ষেত্রে, যা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪৫ ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। সেজন্য অভিযোগকারী এই ধারা অনুসারে নালিশ প্রত্যাহার করতে পারেন।
দেওয়ানি মামলা প্রত্যাহার
দেওয়ানি কার্যবিধির ২৩ আদেশের ১ নিয়ম অনুসারে, দেওয়ানি মামলা হওয়ার পর যেকোনো সময়ে বাদী সব বা যেকোনো বিবাদীর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করতে বা আংশিক দাবি পরিত্যাগ করতে পারেন। যেক্ষেত্রে আদালত এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, কোনো পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য মোকদ্দমাটি ব্যর্থ হতে বাধ্য এবং মামলার বিষয়বস্তুর জন্য কিংবা কোনো দাবির অংশের জন্য নতুনভাবে মোকদ্দমা করার জন্য বাদীকে অনুমতি দেয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, সেক্ষেত্রে আদালত উপযুক্ত শর্তে বাদীকে তার মোকদ্দমা প্রত্যাহার করে অথবা তার আংশিক দাবি পরিত্যাগ করার অনুমতি দিতে পারবেন এবং ওই মোকদ্দমার বিষয়বস্তু সম্পর্কে বা ওই রকম আংশিক দাবি সম্পর্কে পুনরায় মোকদ্দমা করার অনুমতি মঞ্জুর করতে পারেন।
আদালতের উল্লিখিত অনুমতি ছাড়া যেক্ষেত্রে বাদী মোকদ্দমা প্রত্যাহার করেন বা আংশিক দাবি পরিত্যাগ করেন, সেক্ষেত্রে বাদী আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে মোকদ্দমার খরচার জন্য তিনি দায়ী হবেন এবং ওই বিষয়বস্তু বা আংশিক দাবি সম্পর্কে নতুনভাবে কোনো মোকদ্দমা দায়ের করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। এই নিয়মের কোনো বিধান বলে আদালত কয়েকজন বাদীর মধ্যে একজনকে অন্যান্য বাদীর সম্মতি ছাড়া মোকদ্দমা প্রত্যাহার করার অনুমতি দিতে পারেন না।
প্রত্যাহারের পর একই বিষয়ে আর মামলা করা যায় না
নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মামলা প্রত্যাহার করা হলে একই বিষয়ে পুনরায় নতুন করে মামলা করা যায় না। দেওয়ানি মামলার ‘রেসজুডিকাটা’ বা দোবারানীতি এবং ফৌজদারি মামলার ‘ডাবল জিওপারডি’ বা দোবারা সাজা নীতির আলোকে এধরনের মামলাকে বাধা দেয়া হয়। তবে উচ্চতর আদালতে রিভিশন দায়ের করে আদালতকে যদি সন্তুষ্ট করা যায়, সেক্ষেত্রে পুনর্বিচার কিংবা পুনর্তদন্তের নির্দেশ ন্যায় বিচারের স্বার্থে আদালত দিতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগের সহজাত ক্ষমতার অধীনে এধরনের আদেশ দেয়ার সুযোগ আছে।
লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।