দীপজয় বড়ুয়া: সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যৎ চিন্তা এবং জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের জন্য শহুরে জীবনের প্রতি মানুষের ঝোঁক বেশি। এখানে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। প্রতিদিনই তাই কর্মসংস্থান বা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় শহরমুখী হচ্ছে মানুষ। আর এসব মানুষের প্রায় ৮৫ শতাংশই ভাড়া বাসায় বসবাস করেন।
প্রায়শঃ ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালা কর্তৃক নানা ধরনের অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হন। যেমন– যখন তখন ভাড়া বৃদ্ধি করা, ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যেমন বাসায় অতিথি বেশি না আসা, বাসার গেইট বন্ধ করে দিলে সকালের আগে না খোলা, মনগড়া নিয়ম তৈরী করা এবং ভাড়াটিয়াদের তা মানতে বাধ্য করা, বিনা নোটিশে উচ্ছেদ করা ইত্যাদি অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত সবাই বাড়ি ভাড়ার এ পাগলা ঘোড়ার কাছে অসহায়। কোথাও কোনো জবাবদিহিতা নেই।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইন সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা দরকার সবার। বেশিরভাগ ভাড়াটিয়াই বাড়িভাড়া সংক্রান্ত আইন জানেন না। তাই বিভিন্ন অধিকার থেকে বঞ্চিত হন তারা। বাড়িওয়ালাদের দ্বারা প্রতারিত হন। এধরনের অনিয়ম ও হয়রানি প্রতিরোধে বাংলাদেশে প্রচলিত রয়েছে ১৯৯১ সালের বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন।
একটি ঘটনা
জাহাঙ্গীর ও ইরফান দুই বন্ধু। যারা দুজনই চাকরিজীবী। তারা যে বাসায় উঠে সেটার জন্য তাদেরকে তিন মাসের অগ্রিম ভাড়া দিতে হয় ও বলা হয় বাসা ছেড়ে দেয়ার দুইমাস আগে মালিককে জানাতে হবে, নয়তো তারা অগ্রিম ভাড়ার টাকা ফেরত পাবেন না। এরকম মৌখিক শর্তে তারা রাজি হয়। কিন্তু বাসায় উঠেই তারা দেখলো যে দিনে মাত্র ২ ঘন্টা পানি দেয়া হয়, সেটাও অনিয়মিত। বাথরুমে কোন ধরণের ফিটিংস লাগানো নেই ও বৈদ্যুতিক বাতির সুইচবোর্ডগুলোর অবস্থাও তেমন ভালো না। মালিককে কিছু বললে মালিক পালটা হুমকি দেন এবং তাদেরকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেন। নিরুপায় হয়ে থাকতে বাধ্য হয় দুই বন্ধু।
আইন অনুযায়ী বাড়িভাড়া সংক্রান্ত সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য ভাড়া নিয়ন্ত্রক রয়েছেন। সাধারণত জ্যেষ্ঠ সহকারী জজ আদালতগুলো বা senior assistant judge court এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। এ আইনের কিছুটা হলেও যদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো তাহলে ভাড়াটিয়াদের জিম্মি অবস্থা অনেকটা লাঘব হতো।
আসুন দেখে নিই আইনে কী বলা হয়েছে
আইনে বাড়ির ভাড়া মানসম্মতভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। মানসম্মত ভাড়া সম্পর্কে এই আইনের ১৫ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ভাড়ার বার্ষিক পরিমাণ সংশ্লিষ্ট বাড়ির বাজার মূল্যের শতকরা ১৫ ভাগের বেশি হবেনা। বাড়ির বাজার মূল্য নির্ধারণ করার পদ্ধতি ও বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৬৪তে স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে।
এ ভাড়া বাড়ির মালিক ও ভাড়াটের মধ্যে আপসে নির্ধারিত হতে পারে। আবার ভাড়া নিয়ন্ত্রকও নির্ধারণ করতে পারেন। এটাকে সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্য করতে ঢাকা সিটি করপোরেশান ঢাকা মহানগরীকে দশটি রাজস্ব অঞ্চলে ভাগ করে ক্যাটাগরি ভিত্তিক সম্ভাব্য বাড়িভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে।
আইনানুযায়ী দুই বছরের আগে বাড়ির ভাড়া বাড়ানো যাবে না। কোনো বিরোধ দেখা দিলে বাড়ির মালিক বা ভাড়াটের দরখাস্তের ভিত্তিতে দুই বছর পর পর নিয়ন্ত্রক মানসম্মত ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে পারবেন।
বাড়িওয়ালা যদি মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত ভাড়া ভাড়াটের কাছ থেকে আদায় করেন, তাহলে প্রথমবার অপরাধের জন্য মানসম্মত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং পরবর্তী প্রতিবার অপরাধের জন্য ওই অতিরিক্ত টাকার তিনগুণ পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এই আইনের ১৮নং ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে, ১৮৮২ সনের সম্পত্তি হস্তান্তর আইন বা ১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের বিধানে যাই থাকুক না কেন, ভাড়াটিয়া যদি নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ করতে থাকেন এবং বাড়িভাড়ার শর্তসমূহ মেনে চলেন তাহলে যতদিন ভাড়াটিয়া এভাবে করতে থাকবেন ততদিন পর্যন্ত উক্ত ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
এমনকি ১৮(২) ধারা মতে বাড়ির মালিক পরিবর্তিত হলেও ভাড়াটিয়া যদি আইনসম্মত ভাড়া প্রদানে রাজি থাকেন তবে তাকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। চুক্তিপত্র না থাকলে যদি কোনো ভাড়াটে প্রতিমাসের ভাড়া পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করেন, তাহলেও ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা যাবে না।
যুক্তিসংগত কারণে ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করতে চাইলে যদি মাসিক ভাড়ায় কেউ থাকে, সেক্ষেত্রে ১৫ দিন আগে নোটিশ দিতে হবে। চুক্তি যদি বার্ষিক ইজারা হয় বা শিল্পকারখানা হয়, তবে ছয়মাস আগে নোটিশ দিতে হবে।
কোনো ব্যক্তি ভাড়ার অতিরিক্ত প্রিমিয়াম, সালামি বা জামানত ভাড়াটেকে দেওয়ার জন্য বলতে পারবেন না। বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-এর ১০ ও ২৩ ধারা মোতাবেক বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রকের লিখিত আদেশ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বাড়ি মালিক তার ভাড়াটিয়ার কাছ থেকে অগ্রিমবাবদ এক মাসের বাড়িভাড়ার অধিক কোনো প্রকার ভাড়া, জামানত, প্রিমিয়াম বা সেলামি গ্রহণ করতে পারবেন না। তাহলে দণ্ডবিধি ২৩ ধারা মোতাবেক তিনি দণ্ডিত হবেন।
এই আইনে বাড়ির মালিককে ভাড়ার রসিদ প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এ রসিদ সম্পন্ন করার দায়দায়িত্ব বাড়িওয়ালার। রসিদ প্রদানে ব্যর্থ হলে ভাড়াটের অভিযোগের ভিত্তিতে বাড়িওয়ালা আদায়কৃত টাকার দ্বিগুণ অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বাড়িভাড়ার চুক্তি ৩০০ টাকার নন-জুডিসিয়াল স্ট্যাম্পে করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে নিবন্ধন করে নেওয়া যেতে পারে। এর ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়ানো সম্ভব। চুক্তিপত্রে ভাড়া, ভাড়াবৃদ্ধি, বাড়ি ছাড়ার নোটিশসহ বিভিন্ন বিষয় স্পষ্ট করে উল্লেখ করতে হবে।
এছাড়া কোনো কারণে ভাড়াটিয়ার ভাড়া নেওয়া অংশ মেরামত করার প্রয়োজন হলে বাড়িওয়ালাকে তা মেরামতের নির্দেশ দিতে পারেন এবং মেরামতের খরচ বাড়িওয়ালাকেই বহন করতে হবে। জরুরি মেরামতের ক্ষেত্রে নোটিশ পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেরামতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে ভাড়াটিয়া তার নিজ উদ্যোগে মেরামত করতে পারবেন এবং যাবতীয় খরচ ভাড়া থেকে কেটে রাখতে পারবেন।
ভাড়াটে হিসেবে আপনার/আমার অধিকার এই আইনে লেখা আছে। এই অধিকার কোনো বাড়িওয়ালা লঙ্ঘন করলে তাকে পেতে হবে শাস্তি।
যা করবেন
১. মানিঅর্ডারযোগে প্রেরণ করা ভাড়ার টাকা বাড়িওয়ালা যদি গ্রহণ না করেন, পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ভাড়াটিয়াকে সিনিয়র সহকারী জজের বরাবর দরখাস্ত এবং একইসঙ্গে ভাড়ার টাকাও জমা দিতে হবে।
২. একজন আইনজীবীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রক বরাবর আবেদন করতে হবে।
৩. ভাড়া নিয়ন্ত্রক প্রাথমিকভাবে শুনানির পর যদি সন্তুষ্ট হন যে ভাড়া প্রদানের জন্য অনুমতি দেয়া যাবে, সেক্ষেত্রে ভাড়ার টাকা প্রতিমাসেই আদালতে জমা দেয়া যাবে।
৪. আদালতে ভাড়ার টাকা জমা দিলে আইনতভাবে ভাড়াটিয়াকে ভাড়াখেলাপি বলার সুযোগ থাকবে না।
৫. বাড়িওয়ালার সঙ্গে লিখিত চুক্তিতে কী কী শর্তে ভাড়া দেয়া হলো এবং করণীয় কী, সেসব নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। চুক্তিপত্রে ভাড়া বাড়ানো, অগ্রিম জমা ও কখন বাড়ি ছাড়বেন তা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে।
৬. আর প্রতিমাসে বাড়িওয়ালার কাছ থেকে ভাড়ার লিখিত রসিদ সংগ্রহ করতে হবে।
বাড়িভাড়া আইন অনুযায়ী বাড়ির মালিক তার বাড়িটি বসবাসের উপযোগী করে রাখতে আইনত বাধ্য। বাড়ির মালিক ইচ্ছা করলেই ভাড়াটিয়াকে বসবাসের অনুপযোগী বা অযোগ্য অবস্থায় রাখতে পারেন না। স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বসবাসের উপযোগী করে বাড়িটি প্রস্তুত রাখতে বাড়ির মালিকের উপর এই বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ২১ নং ধারায় বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে।
অর্থাৎ ভাড়াটিয়াকে পানি সরবরাহ, বিদ্যুৎ সরবরাহ, পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ইত্যাদি সুবিধা প্রদান করতে হবে। এমনকি প্রয়োজনবোধে লিফটের সুবিধাও দিতে হবে। কিন্তু উক্তরূপ সুবিধা প্রদানে বাড়িমালিক অনীহা প্রকাশ করলে কিংবা বাড়িটি মেরামতের প্রয়োজন হলেও ভাড়াটিয়া নিয়ন্ত্রকের কাছে দরখাস্ত করতে পারবেন।
বাড়ির মালিক ন্যায়সংগত কারণ ছাড়াই ভাড়াটিয়াকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলতে পারবেন না। অনেকক্ষেত্রে বাড়ির মালিক ভাড়া নিতে চান না। এক্ষেত্রে চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বা যদি চুক্তি না থাকে সেক্ষেত্রে মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে মানিঅর্ডার এর মাধ্যমে বাড়ির মালিকের ঠিকানায় ভাড়া পাঠাতে হবে। বাড়ির মালিক যদি ভাড়ার টাকা গ্রহণ না করে সেক্ষেত্রে টাকা ফেরত আসার পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ভাড়াটেকে ভাড়া নিয়ন্ত্রক, অর্থাৎ সহকারী জজের কাছে আইনজীবীর মাধমে দরখাস্ত দিতে হবে। আদালত অনুমোদন দিলে প্রতিমাসে ভাড়া আদালতে জমা দেওয়া যাবে।
তবে বাড়িওয়ালারও বাড়িভাড়া আইনে কিছু অধিকার রয়েছে। যদি ভাড়াটিয়া প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে ভাড়া পরিশোধ না করেন তবে সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ১০৬ এবং ১০৮ (গ) উপ-ধারা অনুযায়ী উচ্ছেদের নোটিশ দিয়ে ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। যৌক্তিকতার নিরূপণে প্রতি দুই বছর পর পর মানসম্মতভাবে ভাড়া বাড়াতে পারেন।
এছাড়াও বাড়ির মালিকের অনুমোদন ব্যতিত যদি সাবলেট কিংবা বাড়ির গঠনগত কোনো বড় পরিবর্তন কিংবা পার্শ্ববর্তী বাড়ির দখলকারী কোনো ব্যক্তিবর্গকে যদি উৎপাত, উত্যক্ত বা বিরক্ত করে থাকলে ভাড়াটিয়ার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
লেখক: আইনজীবী; জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।