মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এর সমন্বয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট মনিটরিং কমিটি সম্প্রতি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) -কে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানিতে আজ রোববার (৬ মার্চ) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
বিদেশে অর্থপাচারে জড়িতদের মধ্যে পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে এ দিন আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এ প্রতিবেদন দাখিলের পর আদালত এই আদেশ দেন।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আন্না খানম কলি। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশিদ আলম খান। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আব্দুল কাইয়ুম খান ও অ্যাডভোকেট সুবীর নন্দী দাস।
আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, আজ তিনটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ এর যৌথ অনুসন্ধান ও তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য, সিআইডি, দুদক এবং বিএফআইইউ এর সমন্বয়ে সাত সদস্য বিশিষ্ট মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে।
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কমিটি গঠন করার পর কমিটির কাজ অব্যাহতভাবে চলছে। এর মধ্যে কমিটির অধীনে ৬টি অনুসন্ধান দল কাজ করছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এরপর আদালত মানিলন্ডারিং প্রতিরোধে এই কমিটির সঙ্গে এনবিআরকে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে কমিটিকে আগামী ১০ এপ্রিলের মধ্যে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিলেরও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি এ সংক্রান্ত রিটের শুনানি শেষে বিদেশে অর্থপাচারে জড়িতদের মধ্যে পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চান হাইকোর্ট। ৬ মার্চের মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
একইসঙ্গে সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকের মাধ্যমে যারা বিদেশে অর্থপাচার করেছেন তাদের কত টাকা সেসব ব্যাংকে জমা আছে সে তথ্য এবং তাদের তালিকা হাইকোর্টে জমা দিতে বলেছেন আদালত। ৬ মার্চের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আজ এই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
এর আগে প্যারাডাইস ও পানামা পেপার্সে নাম আসা ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের তথ্য হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় ২৬ জানুয়ারি প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে কেলেঙ্কারিতে নাম আসা ৬৯ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের তালিকা এবং এর মধ্যে ১০ ব্যক্তি-পরিবারের বিষয়ে গৃহীত ব্যবস্থার তথ্য উল্লেখ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩০ জানুয়ারি এ বিষয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে শুনানি হয়।
হাইকোর্টে দেওয়া তালিকায় নাম আছে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর দুই ছেলের। তাদের মধ্যে বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীও রয়েছেন। এর আগে ১২ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৮ টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য দিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক বিশেষ করে সুইস ব্যাংকসহ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, দুবাই ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে যেসব অর্থপাচার হয়েছে তার তথ্য নিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল। গত ১৭ অক্টোবর হাইকোর্টকে এ তথ্য জানানো হয়। পরে আরও সময় নেয় বিএফআইইউ এবং দুদক।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) হাইকোর্টে এ প্রতিবেদন জমা দেয়।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) থেকে পাওয়া হলফনামা আকারে ওই প্রতিবেদন রাষ্ট্রপক্ষ জমা দেয়। এর মধ্যে পানামা পেপার্সের ৪৩ জন এবং প্যারাডাইস পেপার্সের ২৬ জনের নামের তালিকা নিয়ে কাজ করছে বিএফআইইউ। নাম আসা ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন দেশে চিঠিও পাঠিয়েছিল বিএফআইইউ।
এর মধ্যে ১০ ব্যক্তি–পরিবারের বিষয়ে আর্থিক লেনদেন, বিদেশে অবস্থান ও ব্যাংক পরিচালনার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হলে আদালত এ বিষয়ে আদেশ দেন।
পানামা পেপারস, প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে অগ্রতি প্রতিবেদন জানাতে দুদক, সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া সুইস ব্যাংকসহ অন্যান্য বিদেশি ব্যাংকে যারা অর্থপাচার করেছে তাদের তালিকা দিতে এবং কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেটি ৬ মার্চের (আজ) মধ্যে জানাতে হবে বিএফআইইউকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে পাওয়া তালিকায় ২৬ জনের নাম এসেছে প্যারাডাইস পেপারসে ও পানামা পেপারসে ৪৩ জনের নাম এসেছে। বিএফআইইউয়ের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট আবেদনের ভিত্তিতে ১০ জনের অর্থপাচার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা। তালিকায় নাম আছে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর দুই ছেলের। বারাকা পতেঙ্গা পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর নামও রয়েছে তালিকায়।
এর আগে গত (২০২১ সালের) বছরের ৬ ডিসেম্বর পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে নাম আসা অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা জানাতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও সিআইডিকে তা জানাতে বলা হয়।
এরপর গত ৫ ডিসেম্বর পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে নাম আসা অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকা পৃথক দুটি প্রতিবেদনে হাইকোর্টে দাখিল করে দুদক।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য বিশ্লেষণ করে ও আইসিআইজের ওয়েবসাইটে বর্ণিত দেশভিত্তিক তালিকা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে প্রথম পর্বে ৪৩ ব্যক্তি ও দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম আসে। এর পরে ২৬ জনের নাম পাওয়া যায়।
দেশের ভিন্ন ভিন্ন নাগরিক ও কোম্পানি অর্থপাচার করে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশি ব্যাংকগুলোতে গোপনে জমা রাখা বিপুল অর্থ উদ্ধারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় একটি রিট করেন। এর শুনানি নিয়ে ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি আদালত রুলজারিসহ আদেশ দেন।