ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনচর্চা, শিল্প-সাহিত্য, ভাষা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তাদের প্রকৃত সংস্কৃতি জানা যাবে বলে মনে করেন সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। এই সাংসদ বলেছেন, তাদের আত্মপরিচয়ের সংকট ও উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে, যা শুধু আইন প্রণয়ন করে নয়, আইনের কঠোর বাস্তবায়নও থাকতে হবে। সংখ্যায় যতই কম হোক, প্রতিটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
রাজধানীর আসাদ গেটের সিবিসিবি সেন্টারে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা-সংস্কৃতিচর্চা: সংকট ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনারে রোববার (১৩ মার্চ) এসব কথা বলেন তিনি। যৌথভাবে এটি আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, কাপেং ফাউন্ডেশন ও অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)।
সেমিনারের প্রধান অতিথি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘অস্বীকৃতির সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে প্রকট। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই যেখানে স্বীকার করা হয় না, সেখানে ভাষা-সংস্কৃতি অনেক দূরে।’
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ভাষাগবেষক ও জাবারাং কল্যাণ সমিতির নির্বাহী পরিচালক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা। তিনি তাঁর প্রবন্ধে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা-সংস্কৃতিচর্চার বর্তমান অবস্থা, রাষ্ট্রীয় নানা উদ্যোগ ও বিদ্যমান বিভিন্ন সংকট নিয়ে আলোচনা করেন।
মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীই প্রান্তিকতার শিকার। বর্তমানে অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা বিলুপ্তির চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। যেমন রেংমিটচা ভাষায় মাত্র ছয়জন কথা বলেন।’
মথুরা ত্রিপুরা বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে সব সময় হেয় চোখে দেখা হয়। বিশেষ করে তাদের নানা অশোভন নামে সম্বোধন করা হয় এবং নাটক, ভিডিওতেও সেভাবে উপস্থাপন করা হয়। এর প্রতিকার হওয়া জরুরি। তবে আশার বিষয়, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষার বিকাশ ও তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার ওপর বর্তমান সরকার কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাদরি ও গারো ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। কিন্তু এই পাঁচ মাতৃভাষায় শিক্ষার অগ্রগতি কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে কী কী প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারিভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা আশাব্যঞ্জক নয়।
সভাপতির বক্তব্যে নারীনেত্রী খুশী কবির বলেন, ‘বিভিন্ন উপায়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জায়গাজমি দখল করে তাদের নিঃস্ব করার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে। বিশ্বায়নের বিস্তারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা আমাদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে।’
সেমিনারে কবি ও প্রাবন্ধিক সোহরাব হাসান বলেন, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উত্তরণে বাঙালিদেরও সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
সেমিনারে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৪১টি ভাষার মানুষ রয়েছে; যদিও ১৪টি জাতিগোষ্ঠীর ভাষা আজ বিলুপ্ত। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের জীবনভাবনা জড়িত। ভাষা-সংস্কৃতি হারিয়ে গেলে ধরিত্রীর সঙ্গে মানুষের সম্পর্কও ছিন্ন হয়ে যাবে।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, পাভেল পার্থ, কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা প্রমুখ। এতে স্বরচিত চাকমা কবিতা পাঠ করেন কবি মৃত্তিকা চাকমা। ইয়াংঙান ম্রো নিজ ভাষায় রচিত ব্যাকরণ নিয়ে আলোচনা করেন।