ফাইজুল ইসলাম: রোমান ভাষায় Tort কে Delict বলা হয়। ইংরেজী ভাষায় Tort কে wrong বলা হয়। বাংলা ভাষায় Tort এর সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য কোনো শব্দ না থাকায় একে Tort বলে অভিহিত করা হয়। তবে কেউ কেউ আবার একে Quasi contract (নিমচুক্তি) ও Civil wrong (দেওয়ানী চুক্তি) বলে আখ্যায়িত করে থাকে।
সহজ কথায় যখন কোন ব্যক্তি তার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে সরে গিয়ে কিংবা বিচ্যুতি হয়ে অন্য কারো ক্ষতি সাধন করে তখন তাকে Tort বলা হয়।
এ বিষয়ে প্রফেসর Salmond বলেন-Tort চুক্তি ও বিশ্বাসভঙ্গ ব্যতীত এমন এক ধরনের দেওয়ানী অপরাধ যার প্রতিকার হচ্ছে অনির্ধারিত আর্থিক ক্ষতিপূরণ।
স্যার পার্সি উইনফিল্ড তার ‘Province of the law of torts’ পৃষ্ঠা ৩২-এ ‘ক্লার্ক অ্যান্ড লিন্ডসেল অন টর্টস’ (সাধারণ আইন লাইব্রেরি সিরিজ নং.৩) (১২তম সংস্করণ) অধ্যায় ১, পৃষ্ঠা ১, -এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, “প্রাথমিকভাবে আইন দ্বারা নির্ধারিত একটি দায়িত্ব লঙ্ঘন থেকে উদ্ভূত দায়বদ্ধতা; এই ধরনের দায়বদ্ধতা সাধারণত ব্যক্তিদের প্রতি এবং এর লঙ্ঘন অপ্রয়োজনীয় ক্ষতির জন্য একটি পদক্ষেপ দ্বারা প্রতিকারযোগ্য।”
দেশের বেশির ভাগ মানুষই জানে না যে শারীরিক আঘাতের জন্য দোষী ব্যক্তি কারাবরণের পাশাপাশি বাদীর (ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি) চিকিৎসার খরচসহ অন্যান্য ক্ষতির দায়স্বরূপ ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। দোষী ব্যক্তিকে জেল বা অর্থদণ্ড দিয়ে থাকেন আদালত তথা রাষ্ট্র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাদী কোনো সুবিধা পান না। তবে টর্ট আইনের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তির কাজের জন্য বাদী ব্যক্তিগতভাবে যে ক্ষতির সম্মুখীন হন, তা পুষিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে। এতে বাদী নিজের জন্য সুনির্দিষ্টভাবে আইনি প্রতিকার পেয়ে থাকেন। একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে।
যেমন, জাওয়াদ নামের এক ব্যক্তি রবিউলের হাত বা পা কেটে ফেলল বা ভেঙে দিল। এ ক্ষেত্রে যদি দোষী ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক অপরাধের ধরন ও প্রকৃতি অনুযায়ী আইন মোতাবেক নির্দিষ্ট মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে এতে বাদীর বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির তেমন কিছু আসে-যায় না। তাঁর চিকিৎসা খরচ ও হাত-পা কাটা বা ভেঙে ফেলার কারণে তিনি যে কয়দিন কাজ করতে পারলেন না এবং তাঁর আনুষঙ্গিক ক্ষতির জন্য শুধু টর্টে মামলা করার মাধ্যমেই ক্ষতিপূরণ আদায় করা সম্ভব।
টর্টে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকারের বিধান রয়েছে। তবে এগুলোর মধ্যে আর্থিক জরিমানাই বেশি দেওয়া হয়ে থাকে। আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা (Injunction) জারি বা সুনির্দিষ্ট প্রতিকারের আদেশ দেওয়া হয়ে থাকে। আধুনিক বিশ্বে টর্ট আইনের মাধ্যমে মানসিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও চালু আছে।
বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণ মামলা উল্লেখযোগ্য দুটি নজির নিম্নরূপ –
১. ক্যাথরিন মাসুদ বনাম মো. কাশেদ মিয়া ও অন্যান্য (Catherine Masud vs Md. Kashed Miah and others)
এটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ মামলা কারণ এটি মোটর গাড়ি অধ্যাদেশ, ১৯৮৩[৫] এর ধারা ১২৮-এর অধীনে দায়ের করা প্রথম মামলা যা মোটর দুর্ঘটনার দাবি ট্রাইব্যুনালের অস্তিত্বের বিধান করে। তবে সংবিধানের ১১০ ধারায় আবেদনকারীর করা আবেদনের ভিত্তিতে মামলাটি মানিকগঞ্জের ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে স্থানান্তর করা হয়।
ঘটনা হলো, ১৩.০৮.১১ তারিখে নিহত তারেক মাসুদসহ নয়জন মাইক্রোবাসে করে মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন। মাইক্রোবাসটি ঢাকা আরিচা মহাসড়কের জোকা নামক স্থানে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স পরিবহন নামের একটি মাইক্রোবাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই কান পুরস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ, এটিএন নিউজের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিশুক মুনিরসহ তিনজন নিহত হন।
তারেক মাসুদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৪৫২ টাকা দিতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট বিভাগ। বাসের মালিক, চালক ও একটি বীমা কোম্পানিকে তিন মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়।
আদালতের আদেশ অনুযায়ী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের বাসের তিন মালিক কাশেদ মিয়া, তার ছোট ভাই মুজিবুল হক খোকন এবং জাহাঙ্গীর কবির তুহিনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪ কোটি ৩০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে নিহতের পরিবারের সদস্যদের।
আর চালক জামির হোসেনকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ লাখ টাকা এবং রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৮০ হাজার টাকা দিতে বলা হয়।
তারেক মাসুদের বিধবা স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ, ছেলে নিষাদ বিংহাম পুত্র মাসুদ ও মা নুরুন্নাহার মাসুদকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাস মালিক, চালক ও বীমা কোম্পানিকে নির্দেশ দেওয়া হয়। রিলায়েন্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির দ্বারা প্রদেয় ক্ষতিপূরণের মধ্যে রয়েছে মাইক্রোবাসের ক্ষতি করার জন্য ৫০,০০০ টাকা, তারেকের মৃত্যুর জন্য ২০,০০০ টাকা এবং তার মৃত্যুর কারণ তার আঘাতের জন্য ১,০০,০০০ টাকা।
তারেকের ক্ষতি পূরণের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে যার উপর তার বেঁচে থাকা ব্যক্তিরা নির্ভর করে, তাদের ভালবাসা এবং স্নেহ এবং ভিকটিমের চিকিৎসা ও শেষকৃত্যের খরচ। আদালত বলেছেন, তারেকের মা নির্ভরশীল হিসেবে ১০ লাখ টাকা পাবেন।
২. গ্রিন লাইন পরিবহন লিমিটেড বনাম রাসেল সরকার (Green Line Paribahan Limited vs Rasel Sarkar)
রাজধানীতে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসের চাপায় রাসেল সরকারের বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য দায়ের করা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণার জন্য হাইকোর্ট একটি মাইলফলক স্থাপন করেছেন।
মামলার নথি অনুযায়ী, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হলে ওই বাসের চালক প্রাইভেটকার চালক রাসেলকে ইচ্ছাকৃতভাবে পিষে ফেলেন।
রিট দায়েরের পর হাইকোর্ট ১৪ মে ২০১৮ রুল জারি করে এবং ২০১৯ সালের ১২ মার্চ রাসেল সরকারকে ৫০ লাখ টাকা দিতে গ্রীন লাইন পরিবহন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত।
২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল গ্রীন লাইন পরিবহন রাসেলকে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করে এবং হাইকোর্ট কর্তৃক নির্ধারিত ৪৫ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য আরও এক মাস সময় দেওয়া হয়।
আমাদের সংবিধান ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি দরজা খোলা রেখেছে সংক্ষুব্ধ পক্ষের জন্য। সীমিত পরিসরে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের কাছে যে কোনো অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রতিকার চাওয়ার জন্য এবং জনস্বার্থ মামলা।
হাইকোর্ট বিভাগের কিছু সিদ্ধান্ত টর্ট অনুশীলনের আশাকে আলোকিত করেছে। বহুমাত্রিক অনিয়ম ও অসদাচরণ প্রশমিত করার জন্য টর্ট চর্চা অপরিহার্য, যাতে আমরা টেকসই উন্নয়ন, আইনের শাসন এবং যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মোকাবেলা করার যোগ্যতা নিশ্চিত করতে পারি, যাতে আমরা বেসরকারি খাতসহ সরকারের বিভিন্ন অঙ্গকে যথাযথভাবে কাজ করতে বাধ্য করতে পারি। ভবিষ্যতে এটি করার জন্য, আমাদের আইন প্রণেতা এবং আইন সংস্কারকদের উচিত সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে টর্ট ইস্যুতে গবেষণাকে উৎসাহিত করা।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।