১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা নিরীহ বাঙালির ওপর বর্বর গণহত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নসহ মানবতাবিরোধী নৃশংসতা চালিয়েছিল। এসব অপরাধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করা বা নৃশংসতায় সরাসরি অংশ নেয় এদেশীয় দোসরেরা। এর মধ্যে রয়েছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী।
স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়। সে হিসাবে যাত্রা শুরুর এক যুগ পূর্তি হয়েছে গত শুক্রবার। ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরুর পর দুই বছরের মাথায় ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়, যা ট্রাইব্যুনাল-২ নামে পরিচিতি পায়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুই ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচার কার্যক্রম।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গত এক যুগে ৪৪টি মামলার রায় এসেছে। এসব মামলায় দণ্ডিত আসামি ১০৬ জন। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে বিচার এবং প্রাক্-বিচার (তদন্ত শেষ হয়েছে) পর্যায়ে রয়েছে ৪১টি মামলা। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও ২৪টি অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
ট্রাইব্যুনাল থেকে প্রথম রায় আসে ২০১৩ সালে। ওই বছর দুটি ট্রাইব্যুনাল থেকে মোট ৯টি মামলায় রায় হয়। পরের দুই বছর ১২টি মামলায় রায় দেন দুই ট্রাইব্যুনাল। ২০১৬, ২০১৭, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ২০টি মামলায় রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-১। ২০২০ সালে ট্রাইব্যুনাল থেকে কোনো রায় আসেনি। গত বছর দুটি রায় দেন ট্রাইব্যুনাল-১। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) একটি মামলায় দুই আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। এ নিয়ে ৪৪টি মামলার রায় এল ট্রাইব্যুনাল থেকে।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এসব মামলায় আসামি ১২১ জন। তবে রায় ঘোষণার আগে মারা যান ১৪ আসামি। সব মিলিয়ে সাজা হয় ১০৬ জনের। খালাস পান ১ জন। আর সাজাপ্রাপ্ত ৫৪ আসামি এখনো পলাতক।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে শীর্ষ পর্যায়ের সাত আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আর আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করছেন জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামিরা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও মীর কাসেম আলী। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের করা আপিলের ওপর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় দেন আপিল বিভাগ। রায়ে আজহারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। এ রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন (রিভিউ) করেন তিনি। পুনর্বিবেচনার আবেদন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়।
অন্যদিকে জাতীয় পার্টির সাবেক নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আবেদন করেন তিনি। তবে পুনর্বিবেচনা আবেদন নিষ্পত্তির আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে হাসপাতালের প্রিজন সেলে মারা যান তিনি।
এ ছাড়া আপিল বিচারাধীন অবস্থায় মারা গেছেন দণ্ডিত আট আসামি। তাঁরা হলেন ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা আবদুল আলীম, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা আব্দুস সুবহান, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোসলেম প্রধান, আকমল আলী তালুকদার, মাহবুবুর রহমান ও সাখাওয়াত হোসেন এবং আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিল্লাল হোসেন। মারা যাওয়ায় তাঁদের আপিল অ্যাবেটেড (সমাপ্তি) ঘোষণা করেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এসবের বাইরে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২৭টি আপিল হয়েছে, যা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। পাশাপাশি বর্তমানে ট্রাইব্যুনালে প্রাক্-বিচার ও বিচার পর্যায়ে থাকা ৪১টি মামলায় আসামির সংখ্যা ২৪৩। তাঁদের মধ্যে ১৩০ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। পলাতক ৮৬ জন। ২৩ জন মারা গেছেন। বাকিরা জামিনে রয়েছেন।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য অনুসারে, এখন ২৪টি অভিযোগ তদন্তাধীন। এসব অভিযোগের বিপরীতে আসামির সংখ্যা ৬০। এর মধ্যে ২২ জন পলাতক ও ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।