ফাইজুল ইসলাম: সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে সবার পক্ষে সমান আইনি সহায়তা লাভ করা সম্ভব না। কেননা আইন, আদালত, মামলা সহজ ভাষায় বলা গেলেও প্রতি পদেই দরকার অর্থের যোগান। এজন্য আইনি সহায়তা সবার পক্ষে সমান পাওয়া সম্ভব না।
বাংলাদেশ সংবিধানের (অনুচ্ছেদ ৩৩.১) এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সে হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করা কোন ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার। আর সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব কোন ব্যক্তির প্রতি। প্রতিটি মামলায় (Audi Alteram Partem or Hear from the other side) ন্যাচারাল জাস্টিসের নীতি বাস্তবায়ন না হলে সুষ্ঠু বিচার সম্ভব না। বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এই অধিকার অনেকাংশে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে।
নিউজিল্যান্ডে যাদের আইনজীবী নেয়ার সামর্থ্য নেই তাদেরকে আইনি সহায়তা সরাসরি সরকারি অর্থায়নে দেয়া হয়। সেখানে সকল ধরনের আদালতের কার্যক্রম ব্যবস্থায় আইনি সহায়তা রয়েছে। কানাডাতে যারা গরীব ও অসচ্ছল তাদের মামলার খরচ যৌথভাবে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার বহন করেন। ডেনমার্কে বেসামরিক মোকদ্দমার জন্য আবেদনকারীদের আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত মানতে হয়।
বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির সহযোগিতায় দরিদ্র বিচারপ্রার্থীদের ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০’ পাস করে। সারা দেশের বেশিরভাগ মানুষের এ বিষয়ে এখনো পুরোপুরি ধারণা না থাকায় তারা বিনামূল্যে আইনি সহায়তা নিতে পারছেন না।
প্রতিটি জেলায় এ আইনের আওতায় ‘জেলা আইনগত সহায়তা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। দেশের সব জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে আইনগত সহায়তা অফিস চালু হয়েছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টেও আইনগত সহায়তা অফিস খোলা হয়েছে। এখন থেকে নিম্ন আদালতের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টেও বিনা মূল্যে আইনগত সহায়তা পাওয়া যাবে।
বিনামূল্যে আইনি সহায়তা মূলত কি
আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর ২(ক) ধারা অনুযায়ী আইনগত সহায়তা বলতে বোঝায়- ‘আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন এবং নানাবিধ আর্থ-সামাজিক কারণে বিচার প্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থীকে আইনি সহায়তা প্রদান করা’। যেমন: কোনো আদালতে দায়েরকৃত বা বিচারাধীন মামলায় আইনগত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান কিংবা মামলার প্রাসঙ্গিক খরচ প্রদানসহ অন্য যে কোনো সহায়তা প্রদান। মূল কথা মামলা চালানোর মত যার সামর্থ নেই সরকারের পক্ষ থেকে তাকে সহায়তা প্রদান করা। আইনি সহায়তা পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার।
বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা কারা পাবেন
১. কর্মক্ষম নন, আংশিক কর্মক্ষম, কর্মহীন বা বার্ষিক ৬,০০০ টাকার ঊর্ধ্বে আয় করতে অক্ষম মুক্তিযোদ্ধা
২. বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এমন ব্যক্তি
৩. ভিজিডি কার্ডধারী দুঃস্থ মহিলা
৪. আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে আদালতে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে অসমর্থ ব্যক্তি
৫. বিনা বিচারে আটক এমন ব্যক্তি যিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আর্থিকভাবে অসচ্ছল
৬. পাচারের শিকার নারী বা শিশু
৭. এসিডদগ্ধ নারী বা শিশু
৮. আদর্শ গ্রামে গৃহ বা ভূমি বরাদ্দপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তি
৯. অসচ্ছল বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্তা দরিদ্র নারী
১০. শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কারণে উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তি এবং সহায় সম্বলহীন প্রতিবন্ধী
১১. আদালত কর্তৃক বিবেচিত আর্থিকভাবে অসহায় কিংবা দরিদ্র কোনো ব্যক্তি
১২. জেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত আর্থিকভাবে অসহায় কিংবা দরিদ্র কোনো ব্যক্তি
১৩. আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায় সম্বলহীন, নানাবিধ আর্থ-সামাজিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ কোনো ব্যক্তি যিনি আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা পরিচালনা করতে অসমর্থ
লিগ্যাল এইড অফিস থেকে কোন ধরনের আইনি সেবা প্রদান করা হয়
১. যে কোনো ব্যক্তি, তার আর্থিক সামর্থ্য যা-ই হোক না কেন, সরকারি আইনগত সহায়তা কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত আইনগত তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনগত পরামর্শ গ্রহণ কিংবা বিবদমান পক্ষসমূহের মধ্যে আপসযোগ্য বিরোধসমূহ বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার সেবাসমূহ;
২. অসহায় ও দরিদ্র ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মামলা দায়েরের প্রয়োজন হলে সরকারি খরচে মামলা দায়ের ও পরিচালনা করা;
৩. মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক সব ব্যয় পরিশোধ;
৪. ফৌজদারি মামলার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ব্যয় পরিশোধ;
৫. বিনা মূল্যে ওকালতনামা সরবরাহ;
৬. আইনজীবীর ফি পরিশোধ;
৭. বিনা মূল্যে রায় কিংবা আদেশের অনুলিপি সরবরাহ।
৮. মধ্যস্থতাকারী বা সালিশকারীর সম্মানি পরিশোধ;
৯. ডিএনএ টেস্টের যাবতীয় ব্যয় পরিশোধ;
১০. মামলা পরিচালনার জন্য আইনজীবী নিয়োগ;
১১. আদালত থেকে প্রেরিত মামলাসমূহ মধ্যস্থতা করা;
কীভাবে আইনি সেবা পাওয়া যায়
আইনি সহায়তা পেতে হলে প্রথমে আইনগত সহায়তা পাওয়ার জন্য কোনো ব্যক্তি তার নাম, পূর্ণ ঠিকানা এবং সহায়তা চাওয়ার কারণ উল্লেখ করে একটি সাদা কাগজে আবেদন বা দরখাস্ত করতে হবে ।
যে বিষয়ে আইনি সহায়তা চাওয়া হচ্ছে তা যদি হাইকোর্ট অথবা সুপ্রিম কোর্টে বিচারের বিষয় হয় তাহলে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার চেয়ারম্যান বরাবর এবং অন্যান্য আদালতের বিচারের বিষয় হলে জেলা কমিটির চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করতে হবে।
এ ছাড়া কোনো জেলা কমিটি বরাবর সহায়তা পাওয়ার জন্য আবেদনপত্র বা দরখাস্ত দাখিল করা হলে
সংস্থা বা জেলা কমিটি তাতে একটি নাম্বার দিয়ে আবেদনপত্রটির ওপর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সংস্থা বা জেলা কমিটির পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের ব্যবস্থা করবে।
আবেদনপত্রে উল্লেখিত তথ্যের ভিত্তিতে যদি সংস্থা বা জেলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব না হয় তবে আবেদনকারীকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত তথ্য সরবরাহের জন্য পরামর্শ দিবেন।
এরপর সংস্থা বা জেলা কমিটির সভায় আবেদনপত্রটির আলোকে আইনগত সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা সংস্থা বা জেলা কমিটি কর্তৃক আবেদনকারীকে জানানো হবে। যদি কোনো আবেদনকারীর আবেদন জেলা কমিটি কর্তৃক নাকচ হয় তাহলে সেটা মঞ্জুরির জন্য ও আবেদনকারী তার আবেদন নাকচ হওয়ার তারিখ হতে ৬০ দিনের মধ্যে সংস্থার কাছে আপিল পেশ করতে পারবে এবং এ ব্যাপারে সংস্থার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে
কল সেন্টারে কল দিয়ে আইনি সহায়তা
আইনগত সেবা প্রদান আরও বিস্তৃত ও সহজ করার লক্ষ্যে সরকার ২০১৬ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে টোল ফ্রি জাতীয় হেল্পলাইন কল সেন্টার চালু করেছে।কোন চার্জ কাটা হয় না এখানে কল দিলে।
অফিস চলাকালীন এই কল সেন্টারের ১৬৪৩০ নম্বরে যে কোনো মোবাইল/টেলিফোন থেকে ফোন করে আইনি পরামর্শ, আইনগত তথ্য, লিগ্যাল কাউন্সিলিং, মামলা করার প্রাথমিক তথ্য, সরকারি আইসি সেবা সম্পর্কিত যে কোনো পরামর্শ, সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যে কোনো অভিযোগ কর্তৃপক্ষকে অবহিতকরণ সম্পর্কিত সেবা পাওয়া যায়।
অ্যাপের মাধ্যমে আইনি সহায়তা
বিডি লিগ্যাল এইড অ্যাপের মাধ্যমেও আইনি সহায়তা পাওয়া যায়। অনলাইনে আইনি সেবা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার ২০১৮ সালে বিডি লিগ্যাল এইড অ্যাপ চালু করেছে। এছাড়া director-nlaso.gov.bd ই-মেইল ঠিকানায় এবং bdnlaso ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমে যোগাযোগ করেও বিনা মূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যেতে পারে। বিদেশ থেকে +৮৮০৯১২৩১৬৪৩০ নম্বরে ফোন করে বিনা মূল্যে সরকারি আইনি সেবা নেওয়া যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ সংবিধান; আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০; ড. মোহাম্মদ রেজাউল করিম।