মনজিলা সুলতানা: বিবাহ বা বিয়ে হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। তবে সবক্ষেত্রে যে এই সম্পর্ক দারুনভাবে কার্যকর তাও কিন্তু নয়। ফলে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার অগণিত উদাহরণ সমাজে দৃশ্যমান। আজ আলোচনা করবো মুসলিম স্ত্রী কর্তৃক বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু অধিকার ও করণীয় সম্পর্কে।
বিবাহবিচ্ছেদ কী
বিবাহবিচ্ছেদ শব্দ ল্যাটিন থেকে আসে divortium, এবং গঠিত হয় উপসর্গ দ্বি- বা ব্যবস্থা, যা বিচ্ছেদ বা অমিল, এবং মূল বোঝায় পালটে, যার অর্থ “চালু করুন” বা “স্পিন”। অর্থাৎ এ-ই মতের অমিল থেকেই বিচ্ছেদের শুরু। বিবাহবিচ্ছেদ হয় বিয়ের সাময়িক বিরতি বা স্থায়ী বিরতি। আইনানুগ শর্তে বিবাহ বিচ্ছেদ হলো বিবাহ চুক্তি বিলোপ, যার ফলে উভয় পক্ষ স্বাধীনভাবে তাদের জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য দুজন থেকে আলাদা হয়। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক দাম্পত্য সম্পর্ক এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষে সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে তারা উভয়েই কিছু নির্দিষ্ট উপায়ে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন; যার একটি হলো তালাক। বিবাহ বিচ্ছেদ দুই ভাবে হতে পারে- প্রথমত, প্রাকৃতিক কারণ বশতঃ যেমন: মৃত্যু। দ্বিতীয় কারণ পক্ষগণের ইচ্ছায়, যাকে আমরা তালাক বলতে পারি।
তালাক কী?
‘তালাক’ একটি আরবি শব্দ; যার অর্থ ভেঙে ফেলা, ছিন্ন করা, বা ত্যাগ করা। মুসলিম আইনে তালাক স্বামী-স্ত্রীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। অর্থাৎ তালাক হচ্ছে একমাত্র আইনগত পদ্ধতি যার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। অথবা আইনসিদ্ধ উপায়ে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করাকেই তালাক বলে। স্বামী-স্ত্রী একে অপরের কাছ থেকে আলাদা হওয়ার জন্য যে বিবৃতি বা পদ্ধতিতে যায় তাই তালাক। এটি স্বামী বা স্ত্রী দুই পক্ষ থেকেই আসতে পারে।
মুসলিম স্ত্রী কর্তৃক তালাকের পদ্ধতি
বাংলাদেশে মুসলিম বিবাহ এবং তালাক মুসলিম পারিবারিক আইন বা শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তালাকের পদ্ধতি মূলতঃ তিনটি। এগুলো অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। নারী বা পুরুষ যে কোন পক্ষই তালাক প্রদান করুক না কেন তাদের অবশ্যই নিম্নবর্ণিত পদ্ধতি মেনে তালাক প্রদান করতে হবে।
১। তালাকের নোটিশ প্রদান;
২। সালিস এর উদ্যোগ গ্রহণ;
৩। ৯০ দিন অতিবাহিত হবার পরে তালাক এর সার্টিফিকেট গ্রহণ (একজন রেজিস্টারড নিকাহ রেজিস্টার)।
স্ত্রী কর্তৃক বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু অধিকার ও করণীয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা
আমাদের সমাজে স্ত্রী কর্তৃক তালাক দেয়ার বিধানটি এখনো সর্বস্তরের মানুষ জানেন না। আর জানলেও নানা ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য জানেন। যার কারণে সাংসারিক অশান্তি, নারী নির্যাতন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় এবং অনেকেই আত্মহত্যার মত প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে বাধ্য হন। আজকের আলোচ্য বিষয় মুসলিম স্ত্রী কর্তৃক বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কিছু অধিকার ও করণীয় সম্পর্কে সচরাচর জিজ্ঞাসাসমূহ নিয়ে।
মুসলিম স্ত্রী চাইলে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন?
হ্যাঁ পারেন। যেহেতু মুসলিম বিবাহ একটি দেওয়ানী চুক্তির মত এবং এখানে দুটি পক্ষের উপর নির্ভর করে বিবাহ বলবত থাকে তাই যে কোন পক্ষ চাইলে এটি থেকে বের হয়ে আসতে পারে।
তালাক কার্যকর হতে কতদিন সময় লাগে এবং স্ত্রী গর্ভবতী সময়ে কি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়?
সাধারণত নোটিশ পাঠানোর ৯০ দিন পরে তালাক কার্যকর হয়। তবে স্ত্রী গর্ভবতী হলে দুটি কারণের যেটি পরে হবে তার পর তালাক কার্যকর হবে। এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ ১৯ BLD পৃষ্ঠা-২৭ মামলার সিদ্ধান্তে বলেন যে, গর্ভাবস্থায় একজন তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীলোকের জন্য পরিষ্কার নির্দেশনা হলো, তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সে ভরণপোষণ পাবে।
বিবাহের কাবিন নামায় তালাকের অনুমতির কোন বিধান আছে কি?
হ্যাঁ আছে। বিয়ের সময় কাবিননামার ১৮ ও ১৯ নম্বর দুটি কলাম রয়েছে। সেখানে বলা আছে, স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেছে কিনা এবং স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করেছে কিনা। সেখানে যদি স্ত্রীর ঘরটিতে হ্যাঁ থাকে তাহলে তিনি সহজেই তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবেন। এ তালাককে তালাক-ই -তাওফিজ বলে। তবে কিছু বিধি-বিধান মানতে হয়।
তালাক-ই-তাওফিজ এর ক্ষেত্রে স্ত্রীকে কোনো নিয়ম মেনে তালাক প্রদান করতে হয়?
হ্যাঁ মানতে হয়। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ ধারার বিধান মতে, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক ঘোষণার পর তালাক দিয়েছে বলে যথাশিগগির সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং স্বামীকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে। তবে এ কাজটি রাষ্ট্রীয় ডাকযোগে A/D সহযোগে প্রদান করাই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি। তবে যে পক্ষ থেকেই তালাক প্রদান করা হোক না কেন এক্ষেত্রে নির্ধারিত বিধান লঙ্ঘন করলে সেই পক্ষ এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদন্ডে বা ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে কিংবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবে।
চেয়ারম্যান সাহেবের নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে ৯০ দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় না। আইন অনুযায়ী নোটিশ প্রাপ্তির ৩০ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপস বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশি পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশি পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলনের) জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থায় অবলম্বন করবে।
জেনে রাখা ভালো, চেয়ারম্যান কর্তৃক আপসের জন্য এ ধরনের নোটিশ না করলেও কিংবা কোনো পদক্ষেপ না নিলেও ৯০ দিন অতিক্রান্ত হলেই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।
তালাক ঘোষণাকালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে বা অন্তঃসত্ত্বা থাকলে উল্লিখিত সময় অথবা গর্ভাবস্থা-এ দুটির মধ্যে দীর্ঘতরটি অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
তালাক-ই-তাওফিজ ছাড়াও কি অন্য উপায়ে একজন স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারেন?
হ্যাঁ পারেন। তালাক-ই-তাওফিজ মতে তালাক ছাড়াও মুসলিম আইনে নারীদের হাতে তালাকের আরও তিনটি পথ খোলা আছে।
ক. ‘খুল’ বা ‘খুলা’ তালাক;
খ. মুবারাত এবং
গ. আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ।
আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ কি?
বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়া একান্ত প্রয়োজন হয়, কোন ভাবেই সংসার করা সম্ভব নয়। এবং সংসার করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছেন তখন স্ত্রীকে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইনে বর্ণিত ধারা ২ এর নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ হয় যখন স্ত্রী তালাক-ই-তৌফিজ ও খুলার মাধ্যমে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটাতে ব্যর্থ হন।
এই আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে কোন কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়েবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে তালাকের জন্য আবেদন করতে হবে। আদালতের ডিক্রিমূলে তখন স্ত্রীর তালাক কার্যকর হবে।
আইন অনুযায়ী স্ত্রী যেসব কারণে আদালতে তালাক চাইতে পারেন সেগুলো হলো-
চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে।
দুই বছর স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হলে।
স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়ে বেশি কারাদণ্ড হলে।
স্বামী কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর যাবত দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে।
বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বহাল থাকে।
স্বামী দুই বছর ধরে অপ্রকৃতিস্থ বা পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠরোগে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে।
বিয়ে অস্বীকার করলে। অর্থাৎ যদি কোনো মেয়ের বাবা বা অভিভাবক মেয়েকে ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে বিয়ে দেন এবং সেই মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙে দিতে পারে। তবে শর্ত হলো, মেয়েটির সঙ্গে স্বামীর দাম্পত্য সম্পর্ক (সহবাস) যদি স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনই কেবল বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাওয়া যাবে।
স্বামী একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে। অর্থাৎ স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙ্ঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে।
স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে। নিম্নলিখিত আচরণগুলো ‘নিষ্ঠুরতা’ হিসেবে গণ্য হবে।
(ক) অভ্যাসগত আচরণে স্ত্রীকে আঘাত করা (দৈহিক আঘাত ছাড়াও মানসিক আঘাতও এর অন্তর্ভুক্ত, যা তার জীবন শোচনীয় বা দুর্বিষহ করে তুলেছে);
(খ) অন্য কোনো খারাপ নারীর সঙ্গে জীবনযাপন বা মেলামেশা;
(গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করা;
(ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করা;
(ঙ) স্ত্রীকে নিজস্ব ধর্মপালনে বাধা দেয়া;
(চ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, তাদের সঙ্গে পবিত্র কোরআনের নির্দেশ অনুসারে সমান ব্যবহার না করা;
(ছ) এছাড়া মুসলিম আইনে বিয়েবিচ্ছেদের জন্য বৈধ বলে স্বীকৃত অন্য যে কোনো কারণে স্ত্রী পারিবারিক আদালতে বিয়েবিচ্ছেদের দাবি করতে পারবে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতনকে বোঝাবে না বরং যে কোনো মানসিক নির্যাতনও নিষ্ঠুরতার অন্তর্ভুক্ত হবে। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিয়েবিচ্ছেদ আইনে ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন: হাসিনা আহমেদ মামলায় আদালত মন্তব্য করেছেন যে স্ত্রীর অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করা হলে স্ত্রী আদালতে বিয়েবিচ্ছেদ চাইতে পারবে।
আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দিলে করণীয় কি
যদি আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেয় তাহলে তার পরের ৭ দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ইউপি/ পৌরসভা/সিটি করপোরেশনের চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে পাঠাবেন। স্বামীর অবস্থান জানা না থাকলে মুসলিম বিয়ে-বিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯-এর ধারা ৩ অনুসারে তার উত্তরাধিকারদের কাছে নোটিশ দিতে হবে।
১৯৬১ সালের মুসলি পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী তালাকের নোটিশ পাওয়ার পর চেয়ারম্যান আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবেন সেদিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে। গর্ভাবস্থায় বিয়েবিচ্ছেদ হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না। এ ক্ষেত্রে ৯০ দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হবে। স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না।
স্ত্রী তালাক দিলেও কি মোহরানা পাবে?
স্ত্রী তালাক দিলেও মোহরানার টাকা তাকে দিতে হবে এবং তালাক কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত ভরণপোষণ করতে হবে। তবে দাম্পত্য মিলন না ঘটলে এবং মোহরানা সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকলে স্ত্রী মোহরানার অর্ধেকের অধিকারী। ১৯৩৯ আইনের ৫ ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে, এই আইনের কোনো কিছুই কোনো বিবাহিত নারীর বিয়েবিচ্ছেদের ফলে মুসলিম আইনানুসারে তার দেনমোহর বা এর কোনো অংশের ওপর কোনো অধিকারকেই প্রভাবিত করবে না।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর (তালাক) বা পরবর্তীতে স্ত্রীর আইনি অধিকার
আমরা জানি বিবাহ বিচ্ছেদের মাধ্যমে একটি সম্পর্কের ইতি টানা হয়। কিন্তু স্ত্রীর কিছু অধিকার জন্মায় যা আইনত যে তার স্বামীর কাছে দাবীদার।
ক) দেনমোহর: বিবাহের সময় কাবিন নামায় উল্লেখ্য যে দেনমোহর থাকে তার যে অংশ পরিশোধ করা হয়নি অর্থাৎ অপরিশোধিত দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী হবেন স্ত্রী।
খ) ইদ্দতকালীন খোরপোষ: ইদ্দত একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ দিন, সংখ্যা বা রজঃস্রাব গণনা করা। এটি মূলত নারীর মানসিক ও শারীরিক সক্ষমতা বিশেষ করে তার অনাগত সন্তানের জন্ম পরিচয়ের অধিকারকে নিশ্চিত করার জন্য করা হয়। বিবাহের ইদ্দতকালীন সময়ের খোরপোষ তিনি পাবেন। তালাকের পর পূর্ণ বা ইদ্দতকালীন সময় অর্থাৎ ৯০ দিন (তিন চন্দ্রমাস) খোরপোষ দেয়া ছাড়া স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব।
একটি বিখ্যাত মামলা রশিদ আহমেদ বনাম আনিছা খাতুন (১৯৩২) ৫৯ ইন্ডিয়ান আপিলস, পৃষ্ঠা ২১ এ বলছেন যে, ইদ্দতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি তালাকের বিষয় স্ত্রীকে অবহিত করা না হয় সেক্ষেত্রে তালাকের বিষয় অবহিত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী ভরণপোষণ পেতে অধিকারিণী।
গ) সন্তান থাকলে সেই সন্তানের অভিভাবকত্ব: বিবাহ বিচ্ছেদের সময় যদি স্ত্রীর কাছে কোন সন্তান থাকে তার হেফাজত এবং অভিভাবকত্ব মা দাবী করতে পারবে,কিন্তু আলাদালতের মাধ্যমে তা নির্ধারণ হবে। সাধারণত ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত মায়ের কাছে বা হেফাজতে রাখার নিয়ম আছে। এবং কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে সাবালক হওয়া পর্যন্ত।
ইদ্দত শেষ হলে ও কি ভরনপোষণ দেয়ার নিয়ম আছে?
হ্যাঁ আছে। আদালত চাইলে নারীর ভরণ-পোষণ দেয়ার জন্য সন্তান (যদি উপার্জনের ক্ষমতা থাকে), অথবা বাবা-মা, অথবা আত্মীয়-স্বজনদের আদেশ দিতে পারে। এমন কাউকে পাওয়া না গেলে সবশেষ রাষ্ট্রকে ভরণ-পোষণের জন্য আদেশ দেয়া হতে পারে।
স্ত্রীর পুনঃবিবাহ না হওয়া পর্যন্ত সে কি ভরণপোষণ পেতে পারে?
স্ত্রীর পুনঃবিবাহ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য যৌক্তিক পরিমাণ ভরণপোষণ দিতে বাধ্য কিনা তা নিয়ে একটি মামলা আছে মো. হেফজুর রহমান বনাম ছামছুর নাহার বেগ এবং অন্যান্য (১৯৯৫) ১৫ BLD পৃষ্ঠা-৩৪ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের একটি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, তালাক দেয়ার পরও তার তালাকপ্রাপ্ত উক্ত স্ত্রীর পুনঃবিবাহ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য যৌক্তিক পরিমাণ অঙ্কের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য।
স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদান করা হলে সে কি দেনমোহর পাবার অধিকারী?
এই প্রশ্নটি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু ভুল ধারনা আছে। অনেকেই মনে করেন স্ত্রী কর্তৃক তালাক প্রদান করলে সে হয়তো দেনমোহর পাবে না। কিন্তু সত্য হলো স্ত্রী নিজে বিবাহ বিচ্ছেদ করলে তার প্রাপ্য দেনমোহর প্রাপ্তিতে কোন বাধা নাই।
বিবাহ বিচ্ছেদের পর নারী কোথায় যাবেন?
আমাদের দেশের বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোতে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নারীর বাবা জীবিত এবং সচ্ছল থাকলে নারী বাবার বাড়ি যেতে পারেন। ইসলাম ধর্মীয় বিধানানুসারে বিবাহ বিচ্ছেদের পর নারী তার বাবার বাড়িতে বা নিজগোত্রে ফিরে যাবে এবং সে মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবার ওপর বর্তায়। বাবা দরিদ্র হলে সচ্ছল মায়ের ওপর এরূপ ভরণপোষণের দায়িত্ব বর্তায় এবং মা ও বাবা উভয়ই অসমর্থ হলে দাদার ওপর এরূপ ভরণপোষণের দায়িত্ব বর্তায়।
মা-বাবা বা দাদা কেউই ভরণপোষণ দিতে অসামর্থ্য হলে সেক্ষেত্রে নিকটাত্মীয়দের ওপর ভরণপোষণের দায়িত্ব বর্তায়। এখানে নিকটাত্মীয় বলতে ওই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যার মৃত্যুর পর তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা নারী তার সম্পত্তির যে উত্তরাধিকার লাভ করত, সে অনুপাতে ভরণপোষণ দিতে হবে।
মন্তব্য
সাধারণত একটি তালাক অনেকগুলো বিষয়ের জন্ম দেয়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ তালাকের সাথে ভরণপোষণ, দেনমোহর ও কিছু ফৌজদারী বিষয় জড়িত থাকে বিধায় তা থেকে দুই পক্ষের মাঝে সামাজিব এবং পারিবারিক দূরত্ব তৈরী হয় যার প্রভাব সন্তানের উপর পরে। তবে অধিকার সচেতন হলে দুই পক্ষের জন্যই তা মংগলজন এবং সম্মানের। মনে রাখতে হবে বিবাহ বিচ্ছেদ কেবল একটা সম্পর্কের ইতি এর বাজে প্রভাব যাতে সন্তানের উপর না পরে সেই খেয়াল রাখা স্বামী- স্ত্রী উভয়ের দায়িত্ব।