নোটিশ জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দেওয়ার হুমকির অভিযোগ বিষয়ে নিজেদের ভূমিকার ব্যাখ্যা দিতে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও তাঁর নাজিরকে তলব করেছেন হাইকোর্ট। ইউএনও মো. রেজাউল করিম ও তাঁর অফিসের নাজির উকিল মিয়াকে ২১ জুন সশরীরে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক–আল–জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মঙ্গলবার (৭ জুন) স্বতঃপ্রণোদিত আদালত অবমাননার রুলসহ এ আদেশ দেন।
রুলে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদেরকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালতে এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায় উপস্থিত ছিলেন।
আদালতে উপস্থিত অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনের উদ্দেশ্যে হাইকোর্ট বলেছেন, একজন ইউএনও উপজেলা প্রশাসনের প্রধান কর্মকর্তা। আদালতের আদেশ পালনের জন্যই নোটিশ জারিকারক তার কার্যালয়ে গিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই নোটিশ রিসিভ করা দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের। কিন্তু নোটিশ জারির কারকের সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করা হয়েছে তা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আবার মোবাইল কোর্ট বসিয়ে বিচারের হুমকি দিয়েছে। যা খুবই দুভার্গ্যজনক।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এ বিষয়ে খোঁজ নেব। প্রকৃত ঘটনা কি জানার চেষ্টা করব।
পরে আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি জানান, ফরিদপুরের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে লিখিতভাবে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ঘটনা জানানো হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান। এপ্রেক্ষিতে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত আদালত অবমাননার রুলসহ ওই আদেশ দেন।
ফরিদপুরের আদালত থেকে পাঠানো এ–সংক্রান্ত অবহিতকরণ পত্র থেকে জানা যায়, গত ২৭ এপ্রিল বোয়ালমারী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়ানি মামলার (৫৩/২০২২) নোটিশ জারি করতে জারিকারক মো. কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান।
সেদিন আড়াইটার দিকে নাজির উকিল মিয়ার কাছে নোটিশ গ্রহণের অনুরোধ জানালে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে তাঁদের অপেক্ষায় রাখেন। বিকেল চারটার দিকে তাঁরা আবারও নাজিরের কাছে গেলে তিনি উত্তেজিত হয়ে তাঁদের ওপরের তলায় গিয়ে বসতে বলেন।
অন্য জায়গায় সমন জারির কাজ আছে জানালে উকিল মিয়া বলেন, তাতে তার কী, জজকোর্টের নোটিশ না রাখলে তার কী হবে? তিনি এর চেয়ে বড় কাজে ব্যস্ত আছেন। তিনি নোটিশ পাশের টেবিলে দিতে বললে পাশের টেবিলে দায়িত্বরত কর্মচারী নোটিশ বুঝে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
জারিকারক বিষয়টি আদালতকে অবহিত করবে বললে উকিল মিয়া বলেন, ‘জজের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই; আমরা নির্বাহী বিভাগের লোক। নোটিশ না রাখলে আমাদের কিছুই হবে না।’
একপর্যায়ে নোটিশ বুঝে নেন উকিল মিয়া। ইতিমধ্যে ওই অফিসের একজন কর্মচারী বিষয়টি ইউএনওকে অবহিত করলে তিনি জারিকারক দুজনকে তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে দরজা আটকিয়ে জেরা করতে থাকেন।
স্টাফদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জারিকারকদের সাজা দেওয়ার হুমকি দেন ইউএনও। একপর্যায়ে ইউএনও মো. রেজাউল করিম এ সময়ে তাঁদের মুঠোফোন কেড়ে নেন এবং মুচলেকা দিয়ে চলে যেতে বলেন।
তাঁরা রোজা আছেন জানালে ইউএনও তাদের বলেন, মুচলেকা ব্যতীত তাঁদের ছাড়বেন না তিনি। একপর্যায়ে পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেন ইউএনও। এরপর জোর করে নির্দেশনামতে মুচলেকা লিখিয়ে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া।
অবহিতকরণ পত্রে আরও বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মুক্ত হয়ে ওই দুজন জারিকারক বিষয়টি প্রথমে জেলা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত নাজির মো. রফিকুল ইসলামকে জানান। নাজির বিষয়টি নেজারত শাখার ভারপ্রাপ্ত জজকে অবহিত করেন। নেজারত শাখার ভারপ্রাপ্ত জজ জারিকারকদের লিখিত অভিযোগ পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠান।
এদিকে গত ১৯ মে বোয়ালমারীর সিনিয়র সহকারী জজ (৫৩/২০২২ নম্বর) মামলার এক আদেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তাঁর কার্যালয়ের নাজিরের বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে না—তা আদেশ পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত হাইকোর্ট কারণ দর্শানোর এই নোটিশের কার্যক্রম না চালাতে বোয়ালমারীর সিনিয়র সহকারী জজকে নির্দেশ দিয়েছেন।