শারমিন আরা: বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘পাপ’ কবিতাটি যখন পড়েছি তখনই ভাবতাম এ দুনিয়ায় ভুল করেনি এমন কোনো লোক কী আছে! সত্যিইতো নেই। কবি বলেছেন –
“এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনি করেনিক’ কে আছে পুরুষ-নারী?
আমরা ত ছার; পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারী!”
ভুল থেকে মানুষ অপরাধ করে, পাপ করে। কিন্তু সে ভুল যদি হয় অনিচ্ছাকৃত কিংবা বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে, তবে তার জন্য শাস্তি প্রদান কতটা যুক্তিযুক্ত। এসব ভাবনার জবাব পেলাম বিজ্ঞ যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. সাইফুল ইসলামের “প্রবেশন ও প্যারোল আইন- তত্ত্ব ও প্রয়োগ” বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ পড়ে।
মাস ছয়েক আগে বইটির কথা ফেসবুকে বিভিন্ন বন্ধুদের পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারি। কিছুদিন পর যখন ক্রয় করার জন্য খোঁজ করলাম তখন দেখি কোথাও কোনো কপি নেই। অপেক্ষায় থাকলাম দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য। গত সপ্তাহে বইটি হাতে পেয়েছি। পড়ে মনে একটা কথাই মনে হয়েছে, ফৌজদারি মামলায় যারা আসামী হয় তারা সবাই ইচ্ছে করে অপরাধী হয় না। সবাই পেশাদার অপরাধী না। কেউ কেউ বিশেষ পরিস্থিতির কারণেও হয়, দরিদ্রতার কষাঘাতে পড়েও হয়।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে লিখেছেন, “মনুষ্য চরিত্র সম্বন্ধে, যারা গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করবেন, তারা বুঝতে পারবেন, আমাদের সমাজের দুরবস্থা এবং অব্যবস্থায় পড়েই মানুষ চোর-ডাকাত-পকেটমার হয়। আল্লাহ কোনো মানুষকে চোর-ডাকাত করে সৃষ্টি করেনা। জন্ম গ্রহণের সময় সকল মানুষের দেহ একভাবে গড়া থাকে।”
অভিজ্ঞতার দেখেছি কোনো কোনো ব্যক্তিকে অপরাধ না করেও হাজতে থাকতে হয়েছে। কখনো সেটা প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়ে, কখনো বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ভুলের কারণে। প্রথমবারের মতো ছোটখাট অপরাধে জড়িত শাস্তি হিসেবে কারাগারে পাঠালে সেখানে দাগী আসামীদের সাথে থেকে আরো বড় অপরাধী হিসেবে বের হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
অনেক অপরাধবিজ্ঞানী মনে করেন কারাগার হচ্ছে ‘ইউনিভার্সিটি অব ক্রাইম’। তাই কারাদণ্ডের বিকল্প হিসেবে ছোট খাট অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বাড়ীতে থেকে একজন প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানে সংশোধনের সুযোগ দেয়া হয়। কারো কারো আবার পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও করা হয়। এই ব্যবস্থার নাম প্রবেশন।
কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য প্রবেশনের ওপর আইন ১৯৬০ সালে হলেও বাস্তবে এর তেমন দৃশ্যমান প্রয়োগ ছিল না। সম্প্রতি সারাদেশের মতো আমাদের রংপুরের আদালতগুলোতেও এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা গিয়েছে। লঘু দণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীরা শর্ত সাপেক্ষে বাড়ীতে থেকেই নিজেদের সংশোধন করতে পারছে। একইসাথে কারাগারে বন্দিদের চাপও কমছে।
লেখক বইটিতে প্রবেশনের ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, প্রয়োগ পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন। প্রবেশন এবং প্যারোলের যাবতীয় খুটিনাটি বিষয় এই বইতে পাওয়া যাবে। রয়েছে প্রবেশন সংক্রান্ত সকল ফরম, আদেশ এবং রিপোর্টের নমুনা। তাছাড়া হাজতি আসামীর নিকটাত্মীয় মারা গেলে কিভাবে পুলিশ প্রহরায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাময়িক প্যারোলে মুক্তির মাধ্যমে জানাজায় অংশগ্রহণ করা যায় তার আবেদনের ও আদেশের নমুনা দেয়া হয়েছে। মনে হয়েছে এটি কোনো আইনের জটিল বই নয়, যেন এক পাঠ্যপুস্তক। ভালো লেগেছে প্রবেশন ও প্যারোলের মত একটি বিষয় ফুলের মালার মত স্তরে স্তরে সাজিয়ে পাঠকের সামনে সহজ করে তুলে ধরেছেন।
বইটি হাতে পেয়ে “don’t judge a book by its cover” এই একটি ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বইটির প্রচ্ছদ যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি তার ভেতরটাও। এটি নিঃসন্দেহে বিচারক, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, গবেষক, আইনজীবী, পুলিশ, প্রবেশন অফিসার, সমাজসেবা অফিসার, জেল সুপার, মানবাধিকার কর্মীসহ আইনের শিক্ষার্থীগণের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়।
বইটি পড়তে গিয়ে কিছুটা প্রত্যাশা বেড়েছে। শর্তাধীন অব্যাহতির মত চমৎকার অপ্রচলিত বিষয়কে কিভাবে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় এর আবেদনের নমুনাসহ আরেকটু বিস্তারিত লেখা প্রত্যাশা করছি। কয়েকটি আদেশের নমুনা রয়েছে যা শুধুই বিচারকদের জন্য। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে লেখক পাঠকের এই প্রত্যাশা পূরণ করবেন।
শেষ করছি কালজয়ী রুশ কথাশিল্পী ফিওদর দস্তয়েভস্কি ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসের একটি উক্তি দিয়ে। সেখানে অনুতপ্ত নায়ক রাসকোলনিকভকে বলা হয়েছিল, ‘রাস্তার তেমাথায় চলে যাও, মানুষের কাছে মাথা নত করো, চুমো খাও জমিনকে, কারণ ওর বিরুদ্ধেও পাপ করেছ তুমি, তারপর জোর গলায় সারা দুনিয়াকে শুনিয়ে বলো, আমি একজন খুনি।’
রাশিয়ার তৎকালীন প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাসের সাথে আমাদের সমাজেও মিল আছে। লঘু দণ্ড ও গুরুদণ্ডপ্রাপ্ত যারা ভুল করে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে চায়, তার সেই সংশোধনের সুযোগ পাওয়া উচিত। সেই সুযোগ পেতে পারে কখনো বাড়ীতে থেকে, কখনো কারাগারে থেকে সরকারের আফটার কেয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। ছোট্ট একটা সুযোগ অপরাধীর জীবন বদলে যাবার পাশাপাশি সমাজেও পরিবর্তন হবে, মানুষের মাঝে অপরাধপ্রবণতা কমে আসবে।
লেখক: আইনজীবী, জজ কোর্ট, রংপুর।