শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান : বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পরাধীন ভারতবর্ষে বাংলা ভাষায় প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ‘ধূমকেতু’ ছিল ব্যতিক্রমধর্মী পত্রিকা। অর্ধসাপ্তাহিক এ পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। পত্রিকায় প্রচ্ছদে হপ্তায় দুবার দেখা দিবে এই ঘোষণা দিয়ে পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। বিপ্লবীদের মুখপত্র খ্যাত এ পত্রিকা ১৩২৯ বঙ্গাব্দে ২৬শে শ্রাবণ (১১ই আগস্ট ১৯২২) প্রথম প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার উদ্দেশ্যই ছিল বিপ্লব, কৃষক-মজদূর ও মধ্যবিত্তের জাগৃতি এবং ইংরেজ সরকারের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ।
এ পত্রিকা নিয়ে যত আলোচনা হয়েছে অন্য কোনো পত্রিকা নিয়ে ততটা আলোচনা হয়নি। ‘ধূমকেতু’ ছিল সমকালের রাজনৈতিক ঘটনা-প্রবাহের প্রতিফলন। ধূমকেতুতে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ, কবিতা ও খবর এবং সম্পাদকীয় নিবন্ধের মাধ্যমে কাজী নজরুল অকুতোভয়ে ভারতবর্ষের স্বরাজ ও স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করেন। তাঁর অগ্নিঝরা ভাষা ও নির্ভীক বক্তব্যের জন্য পত্রিকাটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিক্রয়ের দিক থেকেও সেকালে বাংলা ভাষার সকল পত্রিকাকে ছাড়িয়ে যায়। এ পত্রিকাটি অন্যান্য পত্রিকার তুলনায় নিতান্তই স্বল্পায়ু ছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহাসিক অবদানের দিক থেকে এই অল্প সময়ে এ পত্রিকাটি অতুলনীয় ভূমিকা পালন করেছিল।
জানা যায়, ধূমকেতু স্থায়ী হয়েছিল পাঁচ মাস ষোল দিন। এই স্বল্প সময়ে সব মিলিয়ে ধূমকেতু’র মোট ৩২টি সংখ্যা বের করা সম্ভব হয়। তার মধ্যে ১ থেকে ২২টি সংখ্যা পর্যন্ত কাজী নজরুল সম্পাদনা করেন। তবে ২১তম সংখ্যা পর্যন্ত সারথি বা সম্পাদক হিসেবে কাজী নজরুলের নাম ছাপা হয়। ১২তম সংখ্যা প্রকাশিত হলে কাজী নজরুলের নামে মামলা হলে উক্ত মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হয়। ফলে তিনি পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আরও কিছু দিন কলকাতায় অবস্থান করে সম্পাদক বা সারথি হিসেবে নিজের নাম ব্যবহার না করে ধূমকেতু বের করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে ২২তম সংখ্যাটি তিনি সম্পাদনা করলেও নিজের নাম ছাপাননি। তিনি চেয়েছিলেন ভারতের প্রাণের দাবি, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি ঘোষণা করবেনই।
১৯২২ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বরে (৯ই আশ্বিন ১৩২৯) ধূমকেতুর ১২তম সংখ্যায় কাজী নজরুল রচিত ৭৯ পঙক্তির ‘আনন্দময়ীর আগমনে নামক একটি প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি ব্রিটিশ সরকারের রাজরোষে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ১২৪ (ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করে। সমকালের এই চাঞ্চল্যকর মামলাটি ‘ধূমকেতু’র মামলা হিসেবে বিখ্যাত, এ ধারার মামলা দায়ের করতে পুলিশকে সরকারের নিকট থেকে অনুমোদন নিতে হয়। কাজী নজরুলের ক্ষেত্রেও অনুমোদন চেয়েছিলেন এবং পেয়েছিলেন। সমকালে এ ধারার একটি বিখ্যাত মামলার নাম হচ্ছে- Emperor Vs Mohan Dus karamchand Ghandy। ‘ধূমকেতু’র মামলার নাম সঠিকভাবে পাওয়া না গেলেও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের ইতিহাসে মামলাটি ‘ধূমকেতু’ মামলা নামেই পরিচিত।
কাজী নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ধূমকেতু পত্রিকায় প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। এ কবিতায় তিনি সমকালের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থার গোটা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন। এ কবিতায় সমকালের কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম এসেছে পুরাণের প্রতীকরূপে। যেমন- গান্ধী, বিষ্ণু, অরবিন্দ, মহেশ্বর, চিত্তরঞ্জন-ব্রহ্ম, সুরেন্দ্রনাথ = সুরেন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ = রবি, রাবীন্দ্র-বরুণ ইত্যাদি প্রতীকে। এ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি তুলে ধরা হলো :
আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলায় মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
বিষ্ণু নিজে বন্দী আজি ছয় বছরি ফন্দি কারায়।
চক্র তাহার চরকা বুঝি ভণ্ড-হাতে শক্তি হারায়।
…
সুরেন্দ্র আজ মন্ত্রণা দেয় দানব রাজার অত্যাচারে
দম্ভ তাহার দম্বোলি ভীম বিকিয়ে দিয়ে পাঁচ হাজারে।
এ কবিতার পর তিনি ‘ধূমকেতু’ পরবর্তী ১৩তম সংখ্যাতেই প্রকাশ করলেন সমকালের ত্রিশ কোটি ভারতীয়দের প্রাণের দাবি, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি।
পরবর্তী ‘ধূমকেতু’র আরও কয়েকটি সংখ্যা ছিল তীব্র জ্বালাময়ী। এসকল ‘জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকারের ভিত কেঁপে ওঠেছিল। ‘ধূমকেতু’র ১২তম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতার জন্য কাজী নজরুলের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ১২৪ (ক) ধারায় রুজ্জুকৃত মামলায় ১৯২২ সালের ৮ই নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ একই সাথে ধূমকেতু অফিস ও ছাপাখানাসহ সম্ভাব্য সকল জায়গায় তল্লাসি করে। তাঁকে না পেয়ে পত্রিকার ১২তম সংখ্যার যে কয়টি কপি পায় তা জব্দ করে এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়ি থেকে ধূমকেতুর মুদ্রাকর ও প্রকাশক আফ্জালুল হককে গ্রেফতার করে।
পরে ২৩শে নভেম্বর কুমিল্লা জেলা শহরের (তৎকালীন ত্রিপুরা) কান্দিরপাড় থেকে পুলিশ লাইন অভিমুখী সড়কের মাঝামাঝি স্থান (বর্তমানে ঝাউতলা) থেকে কাজী নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের দিনই তাঁকে চাটগাঁ মেলে কলকাতা এনে মামলার বিচার কাজ শুরু করা হয়।
১৯২২ সালের ২৫শে নভেম্বর চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ১২৪(ক) ধারা অনুসারে রুজ্জুকৃত ধূমকেতু মামলায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ইংরেজ কবি সুইন হো’র আদালতে কাজী নজরুলকে হাজির এবং ২৯শে নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য হয়। কাজী নজরুলের পক্ষ সমর্থনে বেশ কয়েকজন সাহসী আইনজীবী বিনা পারিশ্রমিকে এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন মলিন মুখোপাধ্যায়। আদালতে কাজী নজরুলের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ১২৪(ক) ধারা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। রাষ্ট্রদ্রোহিতার যে কটা ধারা আইনে আছে তার কোনো একটি ধারানুসারে মামলা করতে হলে পুলিশ সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারে না। এ জন্য সরকারের অনুমতি আগে নিতে হয়, কাজী নজরুলের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিল। সমকালে এই ধারায় অপরাধের বিচার বাংলা প্রেসিডেন্সিতে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার ছিল। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলায় ফৌজদারি মামলা বিচারের জন্য বাংলা প্রেসিডেন্সিকে ৪টি ভাগে ভাগ করে এ কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়।
তখন বিচারিক কার্য সম্পাদনের জন্য কোনো পৃথক ম্যাজিস্ট্রেট ছিল না। রাষ্ট্রের নির্বাহীরা নির্বাহী প্রকৃতির কাজ সম্পাদন ছাড়াও বিচারিক কাজ সম্পাদন করতেন এবং সে সময় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ১২৪(ক) ধারার অপরাধের দণ্ডাদেশ প্রদান করতে পারতেন।
ধূমকেতু মামলায় কাজী নজরুলকে দণ্ডাদেশ প্রদান করতে সাক্ষী-সাবুদের দরকার পড়েনি। এই মামলায় জামিনে থাকা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকর আফ্জালুল হক রাষ্ট্রপক্ষের অ্যাপ্রুভার সাক্ষী হয়ে কাজী নজরুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তিনি কেবল নিজের মুক্তির সুযোগ নিতে রাজসাক্ষী হয়েছিলেন। বিচারের সময় কাজী নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে বিবৃতি দেন, তা ‘রাজবন্দীর জবাববন্দী’ নামে খ্যাত।
এই জবানবন্দি তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেলে ১৯২৩ সালে ৭ই জানুয়ারি রচনা করেছিলেন। অসাধারণ এ জবানবন্দিটি ভারত বর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক মূল্যবান দলিল হিসেবে বিখ্যাত। তাঁর এই বিপ্লবী জবানবন্দিটি আদালতে গৃহীত হয়নি। ১৯২৩ সালের ১৯শে জানুয়ারি কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহো এক প্রহসনমূলক ধূমকেতু মামলার রায় দেন। ভারতীয় দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ১২৪(ক) ধারা অনুযায়ী ‘ধূমকেতু’ রাজদ্রোহ মামলায় কাজী নজরুলকে তিনি এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ প্রদান করেন।
কাজী নজরুল এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেননি। সেকালে কলকাতা চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের প্রদত্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধের দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করা যেতো। কিন্তু কাজী নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। অসহযোগ-খিলাফত আন্দোলনের যুগে রাজনৈতিক বন্দিরা নীতিগতভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করতেন না। মহাত্মা গান্ধী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা হাসরত মোহানী প্রমুখের বিরুদ্ধেও এ ধারায় মামলা হয়েছিল, জেল হয়েছিল। তাঁরা অপরাধ স্বীকার করে ছিলেন।
সেই সময় হাজার হাজার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা-কর্মীরা কারাবরণ করেছেন। সমকালে রাষ্ট্রদ্রোহিতাই ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধর্ম। তখনকার সময়ে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক মামলায় দণ্ডিত দশ জনের মধ্যে নয় জনই ছিল নির্দোষ। তাঁদের অপরাধ স্বদেশ প্রেম। দলে দলে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কারাবরণ করেছেন, আত্মপক্ষ সমর্থন করেননি। কাজী নজরুল এই মামলায় হাইকোর্টে আপিল না করায় চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের রায়টি সমকালের আইন সাময়িকীতে তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এ কারণে ধূমকেতু মামলা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্যাদি পাওয়া যায় না।
তাছাড়া আদালতের বিধানুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে নিষ্পত্তিকৃত নথি ধ্বংস করা হয়। সঙ্গত কারণেই সেই সময়ে এ মামলার বিচারের রায়ের নথি পত্র বা কপি পাওয়া সম্ভব নয়। তবে যে ধারা অনুযায়ী দণ্ডিত হন, সেই তত্ত্বের বর্ণনা করা যায়। ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ধূমকেতু মামলা একটি ঐতিহাসিক মামলা এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
লেখক : গবেষক