অ্যাডভোকেট সাইফুল্লাহ জামশেদ সাইফ : পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ ব্যতীত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ব্যক্তিগত গাড়ি রিক্যুইজিশন করা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
এ সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) বিচারপতি জাফর আহমেদ ও বিচারপতি মো. আক্তারুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট অজিউল্যাহ ও অ্যাডভোকেট আজিম উদ্দীন পাটোয়ারী।
এর আগে ফেনীর মহিপাল এলাকার প্রাইভেটকার সমিতির সভাপতি মহিবুল্ল্যহ মামুন চৌধুরী হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। রিটে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব, ডিসি ফেনী, পুলিশ সুপার ফেনী ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারকে বিবাদী করা হয়।
এ বিষয়ে রিটকারি পক্ষের আইনজীবী আজিম উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ১৯৮৮ সালের অস্থাবর সম্পত্তি হুকুম দখল আইন অনুযায়ী কেউ রিক্যুইজিশন গাড়ি নিতে চাইলে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে নিতে হয়। কিন্তু সারা দেশে পুলিশ গাড়ি রিক্যুইজিশন করলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে না। এ কারণে রিট করা হয়। আাদলত শুনানি শেষে রুল জারি করেছেন।
এর আগে অপর একটি রিটের শুনানি শেষে জনস্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তিগত, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ঢাকা মহানগর পুলিশ সাত দিনের বেশি রিক্যুইজিশন করতে পারবে না মর্মে রায় দেন হাইকোর্ট। আর রিক্যুইজিশন বিষয়ে কোনো অভিযোগ উঠলে তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবেও নির্দেশনা দেন আদালত।
জনস্বার্থের দায়ের করা এক রিটে ২০১০ সালে জারি করা রুল নিষ্পত্তি করে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই দেওয়া হাইকোর্টের রায়ে এ রকম একগুচ্ছ নির্দেশনা এসেছে।
পুলিশের রিক্যুইজিশন বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ যুক্ত করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে রিট আবেদন করা হয়।
সে আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর ২০১০ সালের ২৩ মে আদালত রুল জারির পাশাপাশি জনস্বার্থ ছাড়া কোনো গাড়ি রিক্যুইজিশন না করতে সরকার ও পুলিশকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
পাশাপাশি গাড়ি রিক্যুইজিশন সংক্রান্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ১০৩(ক) ধারাটি কেন বেআইনি ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছিলেন।
পরে ২০১৯ সালে ৯ জুলাই আদালত রুল শুনানিতে চার আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি মনোনীত করেন। এ চার আইনজীবী হলেন এম আমীর-উল ইসলাম, রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন।
তাদের বক্তব্য ও রুল শুনে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে মামলাটি চলমান (কন্টিনিউয়াস মেন্ডামাস) রেখে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই রায় দেন আদালত।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘ডিএমপি অর্ডিন্যান্সে গাড়ি রিক্যুইজিশন করার ক্ষমতা দেওয়া হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এতে অনেকের মানবাধিকারও লঙ্ঘন হয়েছে। এ রায়ের পর তার কিছুটা হলেও প্রতিকার হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা মহানগর এলাকাকে কেন্দ্র করে রায়টি হলেও এ মামলাটি আদালত চলমান রেখেছেন। তার মানে হচ্ছে অন্য মহানগর এলাকায় এসব নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে যে কেউ আদালতের কাছে প্রতিকার চাইতে পারবেন। সোজা কথায় এসব নির্দেশনা সব মহানগর পুলিশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।’
২০১৯ সালের ৩১ জুলাই বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি খিজির আহমেদ চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চের দেওয়া ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি চলতি বছরের ৮ জুন প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায়ে কয়েক দফা গাইডলাইন অনুসরণ করতে বলেছেন হাইকোর্ট। সেগুলো হলো—
১. ডিএমপি আইনে রিক্যুইজিশন করার ক্ষমতা ডিএমপি কমিশনারের। গাড়ি কেবল জনস্বার্থে ব্যবহার করতে হবে, ব্যক্তিগত কাজে বা অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।
২. ব্যক্তিগত, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের গাড়ি রিক্যুইজিশন করার ক্ষেত্রে কারণ উল্লেখ করে আগে গাড়ির মালিককে নোটিশ দিতে হবে।
৩. রিক্যুইজিশন করা গাড়ি যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তার বাইরে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা কোনো কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন না।
৪. কোনো গাড়ি সাত দিনের বেশি সময়ের জন্য রিক্যুইজিশন করা যাবে না।
৫. রিক্যুইজিশনে থাকার সময় গাড়ির তেল, রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক খরচ কর্তৃপক্ষ বহন করবে।
৬. ডিএমপিকে একটি কমিটি গঠন করে রিক্যুইজিশন করা গাড়ির ক্ষতিপূরণ এবং প্রাত্যহিক ভাতা নির্ধারণ করতে হবে। ১৫ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৭. কোনো গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হলে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ডিএমপিকে এ সংক্রান্ত তহবিল গঠন করতে হবে।
৮. রিক্যুইজিশনের বিষয়ে কোনো অভিযোগ উঠলে বা পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
৯. রোগী বহনকারী, পঙ্গু বা বিদেশগামী যাত্রী বহনকারী গাড়ি রিক্যুইজিশন করা যাবে না।
১০. রিক্যুইজিশন করা গাড়ির রেজিস্টার মেইন্টেইন করতে হবে; যেখানে বিস্তারিত তথ্য থাকবে।
রায় পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে এসব নির্দেশনা বিজ্ঞপ্তি আকারে সংশ্লিষ্ট থানার কর্মকর্তাকে পাঠাতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে এসব নির্দেশনা মাইকিং করতে ঢকা মহানগরের পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।