নামাজ পড়ার শর্তে আসামিকে 'মুক্তি' বিতর্ক বনাম আইনি পর্যালোচনা
ব্যারিস্টার শেখ মোঃ তারিকুল ইসলাম শামমি

নামাজ পড়ার শর্তে আসামিকে ‘মুক্তি’ বিতর্ক বনাম আইনি পর্যালোচনা

ব্যারিস্টার শেখ মোঃ তারিকুল ইসলাম শামমি : চট্টগ্রামে একজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট গাঁজা রাখার অপরাধে অভিযুক্ত দুই জন আসামীকে দোষ স্বীকার করার পর শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ও দুইটি বঙ্গানুবাদসহ কোরান শরীফ প্রদান করার শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছে।

এই রায় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই লিখেছেন এটা বেআইনি। কেউ কেউ লিখেছেন, দন্ডবিধিতে কি এই শাস্তি আছে? নামাজ কিভাবে শাস্তি হতে পারে? দেশে কি শরীয়া আইন চলছে? ধর্ম কি কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যায়?

এদের মধ্যে এমন এমন ব্যক্তিবর্গ আছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাদের ফলোয়ার হাজার হাজার। যাই হোক, ঘোষিত রায় নিয়ে সমালোচনা হতেই পারে।

The Probation of Offenders Ordinance, 1960 নামক একটি আইন আছে, সাম্প্রতিককালে আদালতের বিচারকগণ এই আইন অধিক পরিমাণে প্রয়োগ করছেন।

উক্ত আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, অপরাধের ধরণ ও অপরাধীর চরিত্রসহ পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করে আদালতের নিকট উপযুক্ত মনে হলে, পুরুষ দোষী সাব্যস্ত হলে (convicted), দন্ডবিধির কিছু গুরুতর অপরাধ এবং পুরুষ ও মহিলা উভয় দোষী সাব্যস্তের (convicted) ক্ষেত্রে, যেসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ডের শাস্তি আছে সে সমস্ত অপরাধ ব্যতীত যেকোন অপরাধের ক্ষেত্রে আদালত “শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে”

ইচ্ছে করেই থেমে গেলাম। খেয়াল করুন আবার- “শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে”। আদালত শাস্তি প্রদানের পরিবর্তে একজন প্রবেশন অফিসারের অধীনে ১ বছর থেকে ৩ বছর পর্যন্ত মেয়াদে অভিযুক্তকে মুক্তি প্রদান করতে পারেন। এটাকে বলা হয়- প্রবেশন অর্ডার।

এর পেছনে মূল বা আবশ্যিক শর্ত এই যে, আসামী জামিনদার সহ বা ছাড়া এই মর্মে বন্ড দিবে যে,

ক. প্রবেশন মেয়াদে সে অপরাধে জড়াবে না।

খ. সে শান্তি বজায় রাখবে।

গ. ভালো ব্যবহার করবে।

ঘ. আদালতে উপস্থিত হতে বলা হলে সে আদালতে হাজির হবে এবং শাস্তি প্রদান করা হলে তা গ্রহণ করবে।

এগুলো হচ্ছে মূল বা আবশ্যিক শর্ত। এছাড়া আদালত প্রয়োজনীয় মনে করলে প্রবেশন অফিসারের তত্ত্বাবধানের সুবিধার্থে বন্ডে যেকোন শর্ত বা অন্যান্য অতিরিক্ত শর্ত জুড়ে দিতে পারেন। এবার আলোচ্য অধ্যাদেশের ৫(২) ধারাটা হুবহু তুলে ধরছি-

While making a probation order, the Court may also direct the bond shall contain such conditions as in the opinion of the Court may be necessary for securing supervision of the offender by the probation officer and also such additional conditions with respect of residence, environment, abstention from intoxicants and any other matter which the Court may, having regard to the particular circumstances of the case, consider necessary for preventing repetition of the same offence or a commission of other offence by the offender and for rehabilitating him as an honest, industrious and law-abiding citizen.

আমাদের মিডিয়াগুলোতে এই অতিরিক্ত শর্তগুলো নিয়েই নিউজ হয়। যেমন- ১০০টি বৃক্ষরোপনের শর্তে আসামীকে মুক্তি দিল আদালত।

এখন এই অতিরিক্ত শর্তের ক্ষেত্রে আইনে কিছু বিষয় বলে দেওয়া আছে। যেমন অতিরিক্ত শর্তগুলো কি সম্পর্কিত হবে এ বিষয়ে বলা আছে-

with respect of residence, environment, abstention from intoxicants and any other matter which the Court may, having regard to the particular circumstances of the case, consider necessary.

আসামীর যদি রাতে চুরি করার অভ্যাস থাকে তাহলে শর্ত থাকতে পারে – সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত আসামীকে বাসায় থাকতে হবে (Residence)। বৃক্ষরোপনের শর্ত environment এর সাথে যায়। ধরা যাক মাদক গ্রহণকারী একজন মুসলিম ধর্মের আসামীর ক্ষেত্রে আদালতের মনে হলো, মাদক গ্রহণ করলে তো নামাজ হয় না, যদি তাকে নামাজ পড়ার অতিরিক্ত শর্ত দেয়া হয় তবে হয়তো সে মাদক গ্রহণ থেকে দূরে সরে আসবে যেটা abstention from intoxicants এর সাথে ভালোভাবেই যায়। এছাড়া কেসের পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় মনে করলে আদালত যেকোন বিষয় সম্পর্কে শর্ত বা অতিরিক্ত শর্ত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন।

আদালতের বিবেচনাপ্রসূত এসব শর্ত বা অতিরিক্ত শর্তের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা আছে-

for preventing repetition of the same offence or a commission of other offence by the offender and for rehabilitating him as an honest, industrious and law-abiding citizen.

একজন সৎ, পরিশ্রমী ও আইনমান্যকারী নাগরিক হিসেবে একজন অপরাধীকে পূনর্বাসন করতে ও পুনরায় যেকোন অপরাধ করতে বারিত করতে আদালত অতিরিক্ত শর্ত হিসেবে দুইজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী অপরাধীকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে দিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন এসেছে ধর্ম পালনকে চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বা মোটা দাগে ব্যক্তি স্বাধীনতার ব্যাপারটা। হ্যা, একজন নাগরিককে রাষ্ট্র বেআইনীভাবে আটকে রাখতে পারে না বা তার ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করতে পারে না। তবে আদালত কর্তৃক দন্ডিত হয়ে যখন কেউ জেলে রায়, তখন নিশ্চয়ই আপনি বলেন না, জেলে নেওয়ায় তার ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে। তাহলে শাস্তির পরিবর্তে যখন একজন অপরাধী কিছু শর্তসাপেক্ষে আইনের বিধান অনুযায়ী মুক্তি পাচ্ছে, সেখানে সেই শর্তে কিছু চাপিয়ে দেয়া বিধান থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। এখানে ব্যক্তি স্বাধীনতার বিষয় কি খাটে? তবে সেই শর্ত যদি অবমাননাকর, যন্ত্রণাময় ও লাঞ্ছনাকর হলে সেটা অন্য কথা। যেমন ধরুন আদেশ হলো- প্রতি ওয়াক্তে জামাতে নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে যারা বের হবে সবার পা ধরে মাফ চাইতে হবে ।

আরেকটা বিষয় হচ্ছে শর্ত পালনে মনিটরিং এর ব্যাপারে সমালোচনা হতে পারে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে কিনা এটা মনিটরিং কিভাবে হবে? এটাতো এমন না যে, বৃক্ষরোপন করেই শেষ। একবছর প্রবেশন পিরিয়ডে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া একটা continuing condition.

উক্ত অধ্যাদেশের ১৪ ধারা অনুযায়ী সরকারের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা থাকলেও কোন বিধি প্রণীত হয়নি। আশা করি সাম্প্রতিক কালে এই আইনের প্রয়োগ করে দেয়া রায়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার এ বিষয়ে বিধি প্রণয়ন করবে।

পরিশেষে, একটু সাম-আপ করে বলতে চাই-

১. প্রবেশন আদেশ শাস্তির পরিবর্তে দেয়া হয়।

২. এটা The Probation of Offenders Ordinance, 1960 আইন অনুযায়ী দেওয়া হয়।

৩. বন্ডে মূল শর্ত বা আবশ্যিক শর্ত থাকবে- আসামী প্রবেশন মেয়াদে অপরাধে জড়াবে না, ভালো ব্যবহার করবে, সমাজে শান্তি বজায় রাখবে। আদালত ডাকলে উপস্থিত হবেন।

৪. বন্ডে অতিরিক্ত শর্ত হিসেবে বৃক্ষরোপন, সংসার করা, মন্দিরে দুইবেলা খাওয়ানো, নজরুল সঙ্গীত শেখা, নামাজ পড়া – ইত্যাদি থাকতে দেখা যায়।

লেখক : অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট