সাঈদ আহসান খালিদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের মাস্টার্স ডিগ্রি প্রোগ্রামে আসন ফাঁকা থাকা সাপেক্ষে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও যাতে ভর্তি হতে পারে, সে বিষয়ে সম্প্রতি ডিনস কমিটির সভায় সুপারিশ করা হয়েছে যা শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা হবে। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে এই শিক্ষার্থীরা ঢাবিতে রেগুলার মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পাবে এবং ভর্তির ক্ষেত্রে কোন বয়সসীমাও থাকবে না।
কিছু দিন আগের একটি লেখায় আমি দাবি জানিয়েছিলাম যে, বাংলাদেশের প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএল.এম. প্রোগ্রাম উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত- যাতে যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগ্রহী যে কারো প্রবেশাধিকার থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়মিত মাস্টার্স প্রোগ্রাম যে কোন আগ্রহী শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তে আমি আনন্দিত। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় এটি একটি উদার, যুগান্তকারী এবং পথপ্রদর্শনমূলক পদক্ষেপ।
দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রেগুলার মাস্টার্স প্রোগ্রামে নিজেদের বিভাগ থেকে অনার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরাই শুধু ভর্তি হতে পারে। এদের অনেকে অনার্স সম্পন্ন করতে পারে না- নানা কারণে ড্রপ-আউট হয়, অনেক শিক্ষার্থী অনার্স প্রোগ্রাম শেষ করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা কারণে মাস্টার্সে ভর্তি হয় না- কেউ চাকুরিতে প্রবেশ করে, কেউ কেউ বিদেশের মাস্টার্স প্রোগ্রামে চলে যায়। ফলে, পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলার মাস্টার্স প্রোগ্রামে এসব আসনগুলো শূন্য থাকে যা একটি জাতীয় অপচয়।
এই শুন্য আসনগুলোতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স সম্পন্ন করা আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ভর্তির কোন সুযোগ নেই। কারো হয়তো স্বপ্ন ছিলো, প্যাশন ছিলো সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা অন্য কোন ভালো পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে পড়বে কিন্তু অনার্স ১ম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় কোন কারণে চান্স পায়নি, সেক্ষেত্রে বর্তমান ব্যবস্থায় সেই বিদ্যার্থীর কোনভাবেই আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত মাস্টার্স প্রোগ্রামে ফেরার সুযোগ নেই। সারা জীবনের জন্য সে এক্সক্লুডেড ও বঞ্চিত।
অন্যদিকে, অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনার্স সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজ নিজ বিভাগে গণহারে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির উপযুক্ততা লাভ করে। অনার্স সম্পন্ন করা এই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হতে কোন প্রতিযোগিতা বা নতুন করে ভর্তি পরীক্ষারও সম্মুখীন হতে হয় না। অথচ, তারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো অনার্স প্রোগ্রামের জন্য; মাস্টার্সের জন্য নয়। অনার্স ও মাস্টার্স দুটো সম্পূর্ণ পৃথক প্রোগ্রাম এবং বর্তমান শিক্ষানীতি অনুযায়ী অনার্সই বেশিরভাগ চাকুরির জন্য টার্মিনাল বা চূড়ান্ত ডিগ্রি হওয়ার কথা। মাস্টার্স বাধ্যতামূলক কোন ডিগ্রিও নয়। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স ১ম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার সুবাধে মাস্টার্স প্রোগ্রামেও এভাবে অটো ভর্তি হতে পারার সুযোগ আছে কি?
অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরেক পাবলিক/সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন ছাড়া পিএইচডি প্রোগ্রামেও ভর্তির সুযোগ রাখা হয়নি। কেউ পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির উপযুক্ত কিনা সেটি তো প্রার্থীর ইন্ডিভিজুয়াল কোয়ালিফিকেশান দিয়ে নির্ধারিত হওয়া যুক্তিসঙ্গত এবং ইন্টারন্যাশনাল প্র্যাকটিস কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাটাগরি দিয়ে গণহারে সবার প্রবেশাধিকার রুদ্ধ করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থী, বৈষম্যমূলক, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার বরখেলাপ।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রেগুলার মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামে নন-পাবলিক, প্রাইভেট বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ না দেওয়ার যুক্তিটি আসলে কী আমার জানতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রাম পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন আগ্রহী শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত। ইউনিভার্সিটির সীমানা থাকে, জ্ঞানের কোন সীমানা নেই।
মজার বিষয় হলো, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যেসব কর্তাব্যক্তি এই নীতিগত সিদ্ধান্ত আরোপ করেছেন উনারা নিজেরাই তো বাংলাদেশের অনার্স/মাস্টার্স ডিগ্রি ব্যবহার করে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড, প্রিন্সটন প্রভৃতি বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স/পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং এর তলানিতে থাকা বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাশ করা গ্র্যাজুয়েটদের একইভাবে ভর্তির অযোগ্য ঘোষণা দিতো- উনারা কি এই ডিগ্রি লাভের সুযোগ পেতেন? অথচ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের ইন্ডিভিজুয়াল পার্সোনাল প্রোফাইলকে গুরুত্ব দেয়, সে কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে সেটি নয়। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে কেউ হার্ভার্ড/ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির রেগুলার মাস্টার্স/পিএইচডি প্রোগ্রামে এডমিশন পেতে পারে কিন্তু দেশের বেশিরভাগ পাবলিক/সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেগুলার মাস্টার্স/পিএইচডি প্রোগ্রামে সে ভর্তির অযোগ্য।
হায়, সেলুকাস!
বিদ্যমান ভর্তি ব্যবস্থায় মাস্টার্স প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোন ডাইভার্সিটি নেই। সবাই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের একই অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসে৷ অথচ ডাইভার্সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইউনিভার্সিটি অব হংকং এর আইন বিভাগের যে রেগুলার এলএল.এম. প্রোগ্রামে আমি অধ্যয়ন করেছি সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থীর অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড আইন ছিলো না। কেউ ইংরেজির স্নাতক, কেউ বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড, কেউ সায়েন্স পড়ে এসেছে, কেউ ফিলোসফি, কেউ বা ইঞ্জিনিয়ারিং। বয়সের কোন বাধা ছিলো না বলে চল্লিশোর্ধ্ব বন্ধুও যেমন পেয়েছি সদ্য অনার্স শেষ করা ২২ বছরের ক্লাসমেট ও পেয়েছি। একেকজন একেক দেশের, একেক ভাষার, একেক ধর্মের, একেক সংস্কৃতির, একেক বিশ্বাসের। এতো ডাইভার্সিটির ভেতর একটা বিষয় ছিলো কমন- মাস্টার্সের বিষয়বস্তুর প্রতি সবার আগ্রহ ও প্যাশন। যারাই আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নিয়েছেন, আমি বিশ্বাস করি, সবার অভিজ্ঞতা একই।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামগুলো উন্মুক্ত করা হলে জ্ঞানের বদ্ধতা দূর হবে, ডাইভারসিটি আসবে, শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পার্সপেক্টিভ এর সাথে পরিচিত হবে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের মিথস্ক্রিয়া ঘটবে, ইউনিভার্সিটিকেন্দ্রিক প্রচলিত কৌলিন্য প্রথার অবসান হবে।
আশার কথা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এ অনার্স ডিগ্রি লাভ করা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তির নিশ্চয়তা দেয় না; নতুন ভর্তি পরীক্ষায় তাদেরকে উত্তীর্ণ হতে হয় যেখানে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েটদেরও প্রতিযোগিতায় টিকে মাস্টার্সে ভর্তির সুযোগ রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিন বদলের ডাক দিয়েছে। এটিকে সাধুবাদ জানাই এবং আশা করি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শীঘ্রই এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।