দীপজয় বড়ুয়া : ইংরেজি Estoppel শব্দটির অর্থ হল নিবৃত্তি। এস্টোপেল নীতির উদ্ভব হয়েছে মূলত allegans, contraria non est audience সূত্র হতে। এর অর্থ কোন ব্যক্তির পরস্পর বিরোধী বক্তব্য গ্রহণীয় নয়। এস্টোপেল নীতি অনুযায়ী কোন ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী বক্তব্যের সত্যতা অস্বীকার করতে পারবে না।
সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারায় এই নীতিটি বিধিবদ্ধ হয়েছে। সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, যখন কোন ব্যক্তি তার ঘোষণা, কার্য বা কার্য বিরতির দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু সত্য বলে বিশ্বাস করতে বা সেই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কাজ করতে দিয়েছে, তখন প্রথমোক্ত ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি কোন মামলায় উক্ত বিষয়ের সত্যতা পরবর্তীতে অস্বীকার করতে পারবে না।
উদাহরণ : সুমিত স্বেচ্ছায় এবং মিথ্যাভাবে রক্তিমকে বিশ্বাস করায় যে, সুমিত একটি জমির মালিক এবং তৎদ্বারা রক্তিমকে ঐ জমি কিনতে এবং মূল্য দিতে প্রলুব্ধ করে। মূলত সুমিত উক্ত জমির মালিকই নয়। উক্ত জমির প্রকৃত মালিক সুমিতে পিতা। অসাধুভাবে রক্তিমের নিকট উক্ত জমি বিক্রি করার ২ মাস পর সুমিতের পিতা মারা যায়। পরবর্তীকালে ঐ জমি সুমিতের সম্পত্তিতে পরিণত হয় এবং বিক্রয়ের সময় উক্ত জমিতে তার কোন স্বত্ব ছিল না এই অজুহাতে বিক্রয় নাকচ করার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে তার স্বত্বহীনতা অবশ্যই প্রমাণ করতে দেয়া যাবে না।
[3 BCR 1983(AD) 122 Rashid Ahmed Vs. Nurul Islam] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, নালিশী ভূমি দায়িকের ভূমি হিসাবে এক সময় বাদী স্বয়ং জাহির করায় বিবাদীগণ নিলাম খরিদ করায় পরবর্তীকালে প্রকৃত ভুলের দরুন উক্তরূপ জাহির করা হয়েছিল বলে তা স্বীয় ভূমি হিসাবে দাবি করতে স্বীকৃতি বাধা আক্রান্ত করে’।
এস্টোপেল -এর উপাদান
সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারা বিশ্লেষণ করলে ষ্টপেল এর যে সমস্ত উপাদানসমূহ পাওয়া যায় তা হলো-
১) ঘোষণা কার্য বা কার্য বিরতির দ্বারা কোন বর্ণনা বা বিবৃতি থাকতে হবে।
২) উক্ত বর্ণনা বা বিবৃতিটি কোন ঘটনা বা বিষয়বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে হতে হবে।
৩) বিবৃতিকারী ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোন ব্যক্তিকে তার বিবৃতির মাধ্যমে কোন ঘটনা সত্য বলে বিশ্বাস করতে দিয়েছেন বা করিয়েছেন।
৪) উক্ত বিবৃতির উপর বিশ্বাস করে দ্বিতীয় ব্যক্তি কোন কাজ করেছেন এবং
৫) এস্টোপেল এর উপর নির্ভরকারী ব্যক্তিকে দেখাতে হবে যে, সে আসল ঘটনা বা বিষয়বস্তু সম্বন্ধে অবগত ছিল না।
এস্টোপেল নীতিটি যে মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত
এস্টোপেল নীতিটি একটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। এস্টোপেল নীতিটি এই নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত যে, কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য কোন ব্যক্তিকে কোন কিছু বিশ্বাস করতে বা ঐ বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে কোন কিছু করতে দেয় তাহলে ঐ ব্যক্তি উক্ত ক্ষেত্রে তার বক্তব্যের সত্যতা পরবর্তীতে অস্বীকার করতে পারবে না। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির পরস্পর বিরোধী বক্তব্য সাক্ষ্য আইনে গ্রহণীয় নয়।
এস্টোপেল নীতিটি সম্পত্তি হস্তান্তর আইনেও গৃহীত
সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারায় এস্টোপেল নীতিটি ১৮৮২ সালের সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৪৩ ধারায় গৃহীত হয়েছে। সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের ৪৩ ধারায় বলা হয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি কোন স্থাবর সম্পত্তি স্বেচ্ছায় এবং মিথ্যাভাবে বা প্রবঞ্চনামূলকভাবে অন্য কোন ব্যক্তিকে উহা ক্রয় করতে ও মূল্য প্রদান করতে প্রলুব্ধ করে তবে পরবর্তীতে তিনি তার উক্ত বক্তব্যের সত্যতা অস্বীকার করতে পারবে না ।
এস্টোপেল -এর বৈশিষ্ট্য
সাক্ষ্য আইনের ১১৫ ধারা বিশ্লেষণ করলে ষ্টপেল এর যে সকল বৈশিষ্ট পাওয়া যায় তা হলো-
ক) এস্টোপেল নীতিটি সাক্ষ্য আইনের নীতি, এর উপর ভিত্তি করে কোন মামলা দায়ের করা যায় না। কিন্তু আত্মরক্ষা হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
খ) যেক্ষেত্রে একাধিক পক্ষ নাই সেক্ষেত্রে এস্টোপেল নীতি প্রযোজ্য নয়।
গ) আইনের বিরুদ্ধে এস্টোপেল প্রযোজ্য নয়।
আইনের বিরুদ্ধে এস্টোপেল প্রযোজ্য নয়
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণয়কৃত প্রত্যেকটি আইন সকল জনগণের উপর বাধ্যকর আর তাই আমরা এই আইনকে কখনই অস্বীকার করতে পারি না। কোন ব্যক্তি যদি কোন আইনের বিধান সম্পর্কে মিথ্যা বিবৃতি দেয় এবং উক্ত বিবৃতির উপর ভিত্তি করে অপর কোন ব্যক্তি যদি কোন কাজ করে সেক্ষেত্রে উক্ত বিবৃতিটি অসত্য প্রমাণিত হলেও বিবৃতি দানকারীকে এস্টোপেল দ্বারা বাধ্য করা যাবে না। কারণ আইনের বিরুদ্ধে এস্টোপেল নীতি প্রয়োগ করার সুযোগ দিলে জনস্বার্থ ও প্রশাসনিক শৃংখলা ব্যাহত হবে। আর এজন্যই বলা হয়ে থাকে যে, ষ্টপেল নীতিটি আইনেরর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা যাবে না।
উদাহরণ : ইমরান, সোহানকে এই মর্মে জানায় যে, সে সোহানের সম্পত্তির যে আয়কর এসেছে তার অর্ধেক করে দেবে। পরবর্তীতে সোহানকে উক্ত আয়করের নির্ধারিত সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করা লাগে। এক্ষেত্রে ইমরানকে ষ্টপেল নীতি দ্বারা বাধ্য করা যাবে না। কেননা আয়কর অধ্যাদেশ আইন দেশে প্রচলিত একটি আইন।
বিচারিক রেফারেন্স
[1 BLD 1981 page 464 Mujib Chowdhury Vs. Syed Abdul Motaleb] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে , ‘নথিভুক্ত বিষয় হতে প্রতিবন্ধকতা বলতে দোবারা দোষের চেয়ে বেশি কিছু বুঝায় না। আদালতে বিচার আমলে পক্ষগণ যেভাবে যা বলেছে দাবি বা ওজর করতে বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। পক্ষগণের মধ্যে একাধিক মোকদ্দমা থাকায় বিবাদীপক্ষ ১০০০ টাকার দাবি ত্যাগ করে আপোষ করে। পরবর্তীকালে ঐ আপোষের ডিক্রীর বিরুদ্ধে মোকদ্দমা স্বীকৃতির প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত’।
[PLD 1966 (Lah) 1050 Joynab Vs. Faza Dad] মামলার সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে ‘আর্জি ও জবাবের বর্ণনা বা স্বীকৃতি দ্বারাও স্বীকৃতির প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতে পারে। যেখানে রাজস্ব আদালতে বিবাদীকে উচ্ছেদের জন্য মোকদ্দমায় বিবাদী ওজর করে যে। তিনি বাদীর ভাড়াটিয়া নন, অতঃপর বাদী মোকদ্দমাটি প্রত্যাহারপূর্বক দেওয়ানী আদালতে রুজু করায় এই মোকদ্দমায় বিবাদী বলতে পারে যে, তিনি ভাড়াটিয়া ছিলেন’।
সাক্ষ্য আইনের ১১৬ ধারায় মালিক প্রজা, ভূস্বামী ও রায়ত, অনুমতিদাতা ও অনুমতিপ্রাপক বা ওকরাইদের ভিতর প্রতিবন্ধকতার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেক ধরণের প্রতিবন্ধকতা বা নিবৃত্তি এই ধারার আলোচ্য বিষয়বস্তু নয়। এতে জমি বা মালিক ও রায়ত কিংবা ভাড়াটিয়া এবং অনুমতিদাতা ও অনুমতিপ্রাপক বা ওকরাইদের ভিতরের একটি মূল প্রতিবন্ধকতা বা নিবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কোন লোক একজনের মালিকানা স্বীকারে প্রজা কিংবা ভাড়াটিয়া হিসাবে দখলে আসার পরে উক্ত মালিকের মালিকানা কিংবা স্বত্ব ছিল না এইরূপ উক্তি করতে বাধাগ্রস্থ হবে।
লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, চট্টগ্রাম।
তথ্য কণিকা : সাক্ষ্য আইনের ভাষ্য, সাক্ষ্য আইন: বিচারপতি ছিদ্দিকুর রহমান মিয়া; এডভোকেট নাসির উদ্দিন – আইন শব্দসমূহ সাক্ষ্য আইন ১৮৭২; সাক্ষ্য আইন- বাসুদেব গাংগুলি।