গত ৮ মাসে গড়ে ৪৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে ৫৩ শতাংশই স্কুলের শিক্ষার্থী। এ বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবর সংকলিত করে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আত্মহত্যার উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার, আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়া কতটা জরুরি’ শিরোনামের প্রতিবেদন তুলে ধরে বলা হয়, আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৭৯ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ২০ বছর।
আত্মহত্যার কারণের মধ্যে রয়েছে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, পড়াশোনার চাপ, সেশনজট, অভিমান, প্রেমঘটিত বিষয়, পরিবার থেকে কিছু চেয়ে না পাওয়া, পারিবারিক কলহ, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি, চুরি বা মিথ্যা অপবাদ, মানসিক সমস্যা, বিয়েতে প্রত্যাখ্যাত, স্বামী পছন্দ না হওয়া, মোটরবাইক কিনে না দেওয়া ইত্যাদি। এ ছাড়া মানসিক ভারসাম্যহীনতা, বিষণ্নতা, বন্ধুর মৃত্যু এবং আর্থিক সমস্যার বিষয়গুলো আত্মহত্যা করার পেছনে কারণ ছিল।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, করোনাকালে ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ১৩ মাসে গণমাধ্যমে ১৫১ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর প্রকাশ হয়েছিল। এ বছরের আট মাসে তা দ্বিগুণের বেশি। অনেক আত্মহত্যার খবর পরিবারগুলো চেপে যায় বলে অনেক খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয় না। সংবাদ সম্মেলনে তরুণ প্রজন্মকে যেকোনো পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি করা এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে অভিভাবক, শিক্ষকসহ সবাইকে যত্নশীল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
গত কয়েক মাসে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়।
গত ২৩ আগস্ট রাজধানীর তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় একটি বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে হলি ক্রস স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী পারপিতা ফাইহা। স্কুলের পরীক্ষায় অকৃতকার্য করানোর অপমানে সে আত্মহত্যা করে বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় গত সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর একটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটি শিক্ষকের কাছে টিউশন না নেওয়ায় অকৃতকার্য করানো হয়েছে বলে অভিযোগের প্রমাণ পায়নি। তবে কঠিন প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনে ভীতি সঞ্চার করে কৌশলে টিউশন নিতে বাধ্য করার প্রমাণ পেয়েছে।
পারপিতার আত্মহত্যার ৪ দিন পর গত ২৭ আগস্ট রাজধানীর দক্ষিণখান মোল্লারটেক এলাকার একটি ১০ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা মোসাদ্দেক (২১)। মেয়ের আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে বাবার বিরুদ্ধে মেয়েটির মা বাদী হয়ে মামলা করেন। ৩১ আগস্ট বাবাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আত্মহত্যার পেছনে পারিবারিক কলহ দায়ী বলে প্রাথমিক অবস্থায় পুলিশ ধারণা করেছে। সানজানার মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর সহপাঠীরা প্রতিবাদ সভা করেন।
কেন এত আত্মহত্যা
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বলেন, সমাজে, পরিবারে ও শিক্ষাব্যবস্থায় এমন উপাদান রয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা থেকে বিরত রাখতে পারছে না। শিক্ষাব্যবস্থা পাস–ফেলনির্ভর। যে শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হচ্ছে তার দিকে পরিবার, সমাজ আঙুল তুলে বলছে ‘তুমি শেষ, তুমি ব্যর্থ’। শিক্ষার্থীদের মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য সুস্থ বিনোদনব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সেটা নেই। খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত মাঠ নেই। একধরনের সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আরও বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে কীভাবে মানসিক দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কীভাবে নিজের ক্ষতি করা থেকে বিরত থাকতে থাকবে। যেকোনো মানসিক অবসাদে লোকলজ্জার ভয় এড়িয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ) আজিজুল হক বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দেন, এমন বক্তাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সন্তান কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে, সে ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা তানসেন রোজ। মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ফাউন্ডেশনের গবেষণা সহযোগী ফারজানা আক্তার। প্রতিবেদনে আত্মহত্যা প্রতিরোধে ১০টি সুপারিশ করা হয়।