রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী : শিরোনামে যা দেখেছেন, এটাই সত্যি! অ্যডভোকেটদের এই ড্রেস কোডের প্রচলনটি তখন থেকেই শুরু। বৃটিশ শাসনমুক্ত হলেও উপমহাদেশের আইন অঙ্গনে রয়ে গেছে সেই ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরা রীতিনীতি।
সদ্য প্রয়াত ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রাজকীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও নানারকম তথ্য গত কয়েকদিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে ইথারে ইথারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিওতে দেখলাম, রাণীকে সমাহিত করার আগে সেইন্ট জর্জেস চ্যাপেলে গির্জায় প্রার্থনা অনুষ্ঠানের সময় তাঁর কফিনের চারপাশে শেষ প্রার্থনা করা হচ্ছে। সাদা কালো পোশাক পরিহিত প্রার্থনারত যাজকদের দেখে মনে হচ্ছিল তাঁরা আইনজীবী কি-না! কারণ তাঁদের পরিহিত পোশাক অনেকটা অ্যাডভোকেটদের ড্রেস কোড এর মতো!
কৌতূহল মেটাতে সাথে সাথে গুগলে সার্চ দিয়ে তথ্য খোঁজার চেষ্টা করি আইনজীবী-বিচারকদের পোশাক সংক্রান্ত ঐতিহ্য কি, কীভাবে এই পোশাকের প্রচলন এবং কেনই বা এসব রঙের ব্যবহার। অনেক খোঁজাখুঁজির পর কালো গাউন পরিধান/ব্যবহার সম্পর্কে ইংল্যান্ডের তিনটি গল্প পাওয়া যায়;
প্রথমত, ১৬৮৫ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের জন্য শোকের প্রতীক হিসাবে কালো গাউন গ্রহণ করেছিল তখনকার রয়েল কোর্ট এর বিচারকগণ । একি ধরনের পোশাক আজও পরা হয়।
দ্বিতীয়ত, ১৬৯৪ সালে রানী দ্বিতীয় মেরি এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় জাতীয় বিচারকগণ শোকের চিহ্ন হিসাবে কালো পোশাক পরিধান করে অংশ নিয়েছিলেন। যেহেতু মেরির দাফনের পরে শোকের সময়কাল আরও কয়েক বছর স্থায়ী হয়েছিল, তাই কালো পোশাক পরার প্রথা ইংরেজ বিচার বিভাগে প্রবেশ করে এবং বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে বৃটিশ শাসনের অধীনে থাকা সবকটি বিচারালয়ে।
তৃতীয়ত, ১৭১৪ সালে রানী অ্যানের স্মরণে একই শোক পালন করা হয়েছিল। ১৭ শতকে ইতালীয় বিচারকরা ইংরেজ বিচারকদের অনুরূপ কালো পোশাক, সাদা ব্যান্ড এবং সাদা উইগ পরতেন।
এইভাবে তিন রাজার ঐতিহ্য থেকে, কালো গাউন ঐতিহ্য ব্রিটিশদের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে এবং তারপরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক অ্যাডভেঞ্চারের অংশ হিসাবে আজও টিকে আছে বহাল তবিয়তে।
অবশ্য রাজা এডওয়ার্ড রয়েল কোর্ট এর বিচারকদের জন্য ড্রেস কোড ব্যবহার শুরু করেছিলেন ১৩০০ শতকে । তখন এটা বিশ্বাস করা হয়েছিল যে, এই সাদা ব্যান্ড-গাউন বিচারক এবং আইনজীবীদের অন্যরকম একটি মর্যাদা দেয়। যুক্তরাজ্য থেকে উদ্ভূত এই গাউন, ব্যান্ড এবং নেকওয়্যারগুলি পরবর্তীতে আইনি, অফিসিয়াল, পুরোহিত এবং একাডেমিক লোকজনের মধ্যেও ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ করা গেছে। বর্তমানে কালো গাউন এবং সাদা ব্যান্ড (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া) সারা বিশ্বে আইনি পেশার প্রতীক। বিচারক এবং অ্যাডভোকেটদের প্রচলিত এই পোশাক আদালত এবং বিচারপতির প্রতি মর্যাদা এবং আনুগত্যের চিহ্ন বলে মনে হয়।
যাহোক, একটি ‘কালো কোট’ পরার পিছনে মূল কারণ হল কালো কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতার রঙ। কালো নিজেকে উপস্থাপন করে। ঠিক যেমন পুরোহিতরা কালো পোশাক পরেন ঈশ্বরের কাছে তাদের বশ্যতা দেখানোর জন্য, আইনজীবীরা ন্যায়বিচারের কাছে তাদের বশ্যতা দেখানোর জন্য কালো পোশাক পরেন। অন্যদিকে সাদা রঙ আলো, মঙ্গলতা নির্দেশ করে। সাদা রঙ আলো, ধার্মিকতা, নির্দোষতা এবং বিশুদ্ধতা বোঝায়। যেহেতু একটি আইনি ব্যবস্থাই একজন সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায়বিচারের একমাত্র আশা, তাই তাকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সাদা রঙ বেছে নেওয়া হয়। উভয় পক্ষের আইনজীবী (আবেদনকারী এবং বিবাদী) একই রকম পোষাক পরিধান করেন। রঙের তাৎপর্যও তুলে ধরে যে আইন অন্ধ।
‘কালো গাউন’ অ্যাডভোকেটের পরিচয়কে গুরুত্ব দেয় এবং তাদের পেশাদার ইমেজকে অনন্য চাক্ষুষ চরিত্র প্রদান করে। ‘কালো পোশাক’ পরা আইনজীবীদের মধ্যে শৃঙ্খলার অনুভূতি তৈরি করে এবং তাদের ক্ষমতার বোধ এবং অধিকার ও ন্যায়বিচারের সমর্থক হওয়ার অনুভূতি দেয়। যেহেতু কালো রঙ মর্যাদা, সম্মান, প্রজ্ঞা এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক কর্তৃত্ব, জ্ঞান, সতর্কতা এবং স্থিরতার বার্তা বহন করে এবং এই মূল্যবোধগুলি প্রত্যেক আইনজীবী এবং বিচারককে বজায় রাখতে হবে।
একটি সাদা ঘাড়-ব্যান্ড নির্দোষতার প্রতীক। সাদা কাপড়ের দুটি টুকরো একসাথে যুক্ত হয়ে অ্যাডভোকেটের ব্যান্ড তৈরি করে যা ‘আইনের ট্যাবলেট’ বা ‘পাথরের ট্যাবলেট’-এর প্রতিনিধিত্ব করে। এই ট্যাবলেটগুলি, খ্রিস্টান বিশ্বাস অনুসারে, সিনাই পর্বতের একটি জ্বলন্ত ঝোপ থেকে প্রাপ্ত দশটি আদেশ লিপিবদ্ধ করার জন্য স্রষ্টার বার্তাবাহক মূসা ব্যবহার করেছিলেন। দশটি আদেশ একটি অভিন্ন কোডেড আইনের প্রথম উদাহরণ বলে মনে করা হয়। ব্যান্ডের আকৃতিও বৃত্তাকার বন্ধ আয়তক্ষেত্রাকার ট্যাবলেটের মতো। এইভাবে, সাদা ব্যান্ডগুলি ঈশ্বরের এবং মানুষের আইনের সমর্থনকে প্রতিনিধিত্ব করে।
আবার কালো মানে অস্বচ্ছ এবং তাই, আইন দ্বারা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত প্রসিকিউশন এবং প্রতিরক্ষার পক্ষগুলি অজানা বলে মনে করা হয়, যার ফলে, ‘কালো গাউন’।
‘ড্রেস কোড’ বিচার বিভাগীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি আইনজীবীদের পবিত্রতা ও অঙ্গীকার প্রকাশ করে এবং পেশার প্রতি তাদের দায়িত্ব বৃদ্ধি করে। ‘ড্রেস কোড’ নিছক একটি ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’ নয়, তবে আইনজীবীদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে সক্ষম করে এবং ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করার শক্তি ও আত্মবিশ্বাসও দেয়। এটি আইনজীবীদের এবং অন্যান্য পেশাদারদের থেকে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বও দেয়। কোর্টরুমে উপযুক্ত পোশাক পরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিচার ব্যবস্থাকে সবচেয়ে সম্মানজনক ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা হয়, তাই সিস্টেম এবং সিস্টেমের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। কোর্টরুমে বিচারকরা একজন আইনজীবীকে যথাযথভাবে পোশাক পরিধান না করলে শুনানির সময় প্রত্যাখ্যান করতে পারেন।
এই কারণেই শুধু আইনজীবীদের নয়, আদালতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ‘ড্রেস কোড’ অনুসরণ করতে হবে। কোর্টরুমে ক্যাজুয়াল পোশাক পরা আইনের অসম্মান হিসাবে বিবেচিত হয়।
(বিশেষ দ্রষ্টব্য : এই লেখাটি ইন্টারনেটে পাওয়া বিক্ষিপ্ত তথ্য একীভূতকরত নিজস্ব পর্যবেক্ষণ মাত্র)
লেখক : আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।