কাজী ফয়েজুর রহমান : যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর ছবি, নাম, পরিচয় এবং কোনো ধরনের ঠিকানা গণমাধ্যমে প্রকাশ না করার জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনানুযায়ী কোনো গণমাধ্যমই এ কাজ করতে পারে না।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হইয়াছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তত্সম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।’
কিছু ক্ষেত্রে চেহারা অস্পষ্ট (ব্লার) করা ছবি প্রকাশ করা হয়। তবে দেশের বেশকিছু সংবাদমাধ্যম এই আইন লঙ্ঘনের মহোৎসবে মেতে উঠেছেন। কার চেয়ে কে কত সুন্দর ছবি প্রকাশ করবেন যেন এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত!
যদিও এই আইন লঙ্ঘনে আছে শাস্তির বিধান। আইনে এ বিধান লঙ্ঘনে জেল-জরিমানার কথা বলা আছে। তবে কার্যকারিতা না থাকায় সম্ভবত গণমাধ্যমকর্মীদের কেউ কেউ তা ভুলেই বসেছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘বিধান লংঘন করা হইলে উক্ত লংঘনের জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের প্রত্যেকে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ডে বা অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’
সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই আইন না মানার হিড়িক বন্ধে গত বছরের শুরুর দিকে এ বিধান বাস্তবায়নের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করা হয়। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন জাস্টিস ওয়াচ ফাউন্ডেশনের করা ওই রিট আবেদনের শুনানি নিয়ে একই বছরের মার্চে আদালত ভিকটিমের ছবি, নাম, পরিচয় ও কোনো প্রকার ঠিকানা প্রচার-প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দেন।
একইসঙ্গে হাইকোর্ট যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, নাম, পরিচয়, ঠিকানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ অনান্য পরিচয় গণমাধ্যমে প্রচার-প্রকাশ বন্ধে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেন।
পাশপাশি হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে গণমাধ্যম বা সংবাদ মাধ্যমে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর ছবি, নাম, পরিচয়, ঠিকানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ অন্যান্য পরিচয় প্রচার-প্রকাশ না করা সংক্রান্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১৪ ধারা যথাযথভাবে প্রয়োগে বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন ‘বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না’ জানতে চাওয়া হয়।
তথ্য সচিব, আইন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, তথ্য অধিদপ্তরের (পিআইডি) অধ্যক্ষ, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, সচিব, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
সেই সাথে ওই বছরের ৩ মে এ বিষয়ে শুনানির পরবর্তী তারিখ ধার্য করেন হাইকোর্ট। তবে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দেওয়ার কথা বলা হলেও তা আজো সংশ্লিষ্টরা দিয়েছেন কি-না কে জানে!
তবে জবাব না দেওয়া হলেও আদালত যে ভিকটিমের ছবি, নাম, পরিচয় ও কোনো প্রকার ঠিকানা প্রচার-প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন সেই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশকেও নিয়মিত ‘হাইকোর্ট দেখিয়ে’ চলেছেন সংবাদমাধ্যমগুলো।
যার জলজ্যান্ত প্রমাণ সম্প্রতি ধর্ষণ ও হত্যার শিকার নোয়াখালীর মেয়েটি। সাম্প্রতিক ঘটনা বলে এই উদাহরণ দিলাম। তবে গুগল করলে এমন হাজার হাজার ছবি পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। এই মেয়েটি শিশুও বটে। যদিও উল্লেখিত ঘটনার ক্ষেত্রে মেয়েটি কেবল ভিকটিম, যদি অপরাধীও হত তারপরও গণমাধ্যমে ছবি প্রকাশের বিষয়ে কঠোরভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে।
২০১৯ সালে এক রায়ে আদালতে বিচারাধীন কোনো মামলার শিশু আসামির ছবিসহ তার পরিচিতি গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করা যাবে না বলে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিচারের আগে, বিচার চলাকালে এবং বিচারের পর সংশ্লিষ্ট শিশু সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায় বা তাকে চিহ্নিত করা যায় এমন কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না বলে ঐ রায়ে বলা হয়।
আদালতের রায়ে বলা হয়, প্রতিবেদনে শিশুকে অপরাধী, আসামি, সাজাপ্রাপ্ত এসব শব্দ লেখা যাবে না। তবে সংশ্লিষ্ট মামলায় রায়ের পর দোষী প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা যাবে।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ ঘোষিত ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, আজকের একটি শিশুকে ভবিষ্যৎ জীবনে যাতে কোনো কলঙ্ক বহন করতে না হয়, সেটা বিবেচনা করেই এই নির্দেশনা দেওয়া হলো।
বিদ্যমান আইন ও হাইকোর্টের রায় থাকার পরও সংবাদমাধ্যমগুলোর এমন আচরণ দায়িত্বহীনতা নাকি সচেতন গাফিলতি নাকি অজ্ঞতা তা হয়তো তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু আইন মান্য করতে বাধ্য করা যাদের দায়িত্ব ছিল তারাও কি দায় এড়াতে পারেন?
লেখক : সংবাদকর্মী