মো. সাহিদ ইসলাম : নোয়াখালীর জেলা শহর মাইজদীতে অষ্টম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী দাঁড়াবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছে জেলা আইনজীবী সমিতি। নিঃসন্দেহে ওই স্কুলছাত্রীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার বিচার অত্যাবশ্যক, অপরাধ প্রমাণ সাপেক্ষে আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া একান্ত জরুরি বলেও মনে করি।
কিন্তু আইনের ন্যাচারাল জাস্টিস মতবাদকে উপেক্ষা করে আসামি পক্ষে আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ না দিয়ে হয়ত বিচার সম্পন্ন হবে তা নিয়ে দ্বিমত নাই, তবে সেই বিচারকে নিরপেক্ষ কিংবা ন্যায় বিচার বলা যাবে কি?
প্রথমত, কে কোন মামলা লড়বে বা লড়বে না সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার একজন আইনজীবীর একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। এই বিষয়ে সমিতির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধ করা ন্যায়সঙ্গত কি! অনুরোধ করাটাও উচিত নয়, কারণ কারো মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করার জন্য কেউ কাউকে অনুরোধ করাটা উচিত নয় কখনোই।
দ্বিতীয়ত, সংবিধান ৩৩(১) অনুযায়ী আসামিকে অবশ্যই আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তাকে আইনজীবীর মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অসাংবিধানিক ভাবে বিচার হলে, উচ্চ আদালতে অধস্তন আদালতের রায় কতটুকু বহাল থাকবে সেটা কি তারা ভেবে দেখেনি? তাহলে তারা আল্টিমেটলি তো ভিক্টিমকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করে, আসামীকে সুযোগ দিচ্ছে উচ্চ আদালত থেকে সুবিধা পাওয়ার!
তৃতীয়ত, ন্যাচারাল জাস্টিস এর বিপরীতে হবে তাহলে এই বিচার! কারণ ন্যাচারাল জাস্টিস এর একটা প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো “No one should be condemned unheard” একইসাথে জাতিসংঘে গৃহীত সার্বজনীন মানবাধিকার সনদ, ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস, ১৯৪৮, এর অনুচ্ছেদ ১১(১) এর লঙ্ঘন হবে, অর্থাৎ ইউনাইটেড ন্যাশন তথা সারা বিশ্বের কাছে জাতি হিসেবে UDHR ভায়োলেশনকারী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হবে বাংলাদেশ! যা নিশ্চয়ই জাতির জন্য অসম্মান ব্যতীত কিছুই বয়ে আনবে না!
চতুর্থত, সব প্রমাণ আসামির বিপক্ষে হলেও তাকে আদালতের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত হতে হবে, আর আদালতের মাধ্যমে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত “Everyone is innocence until proven guilty” অর্থাৎ আসামীর শাস্তি দেয়া যাবেনা!
পঞ্চমত, একটা বিচারের জন্য অবশ্যই ৩টা এলিমেন্টস দরকার- বিচারক, ডিফেন্স ও প্রসিকিউশন। এই তিনটা ব্যতীত কোনভাবেই ন্যায়বিচার সম্ভব নয়। ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ৩৪০ অনুযায়ী আসামী পক্ষে আইনজীবী না থাকলে রাষ্ট্রকে আইনজীবী নিয়োগ দিতে হবে যা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যার মত জঘন্য ঘটনায় দায়েকৃত মামলায়ও রাষ্ট্রকে করতে হয়েছে। কারণ এটা আসামীর আইনগত অধিকার আর সেই অধিকার ভঙ্গ করলে সেটা মৌলিক অধিকার পরিপন্থী!
ষষ্ঠত, হতে পারে স্বাভাবিক ভাবে যা দেখা যাচ্ছে আসামি তার থেকেও জঘন্য অপরাধ করেছে। যা দুই পক্ষের আইনজীবীর যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই সামনে আসা সম্ভব। আসামি পক্ষে আইনজীবী না দাঁড়ালে সেই সত্য সামনে আসবে না ফলে অপরাধীরই সুযোগ বেশি থাকবে।
আবার স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখেই কাউকে অপরাধী বলার পরে সে প্রকৃত অপরাধী না-ও হতে পারে! উদাহরণস্বরুপ,- স্ত্রীকে হত্যার বিচার চেয়ে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার এখন ওই মামলারই আসামি! (যদিও এই মামলা এখনো বিচারাধীন)। ধর্ষণ পূর্বক হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়ার কথা ১৬৪ ধারায় আসামীদ্বয় স্বীকার করার বছর খানেক পর ভিকটিম প্রেমিকা জামাই নিয়ে এসে জনসম্মুখে হাজির। চট্টগ্রামে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলা আসামীকে নিয়ে তোলপাড় হওয়ার কিছুদিন পরে মৃতব্যক্তি এসে হাজির! এদিকে ২ দিন আগে মরিয়ম তার মায়ের লাশ শনাক্ত করে প্রতিবেশীদের দ্বায়ী করার দুইদিন না যেতেই মরিয়মের মা উদ্ধার। নোয়াখালীতেও নিহত ছাত্রীর মা যার দিকে আঙ্গুল তুলল সে দেখা যাচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে খুনী না, খুনের দায় স্বীকার করল নিহত ছাত্রীর প্রাক্তন শিক্ষক।
তাই আদালতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত হতে দেয়াটা অবশ্যই উচিত। নাহলে ভিক্টিম ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে আবার অনেক সময় প্রকৃত অপরাধী বাইরে হাওয়া খাবে, শাস্তি পাবে কোন নির্দোষ!
তাহলে এবার ভেবে দেখুন, যারা আসামি পক্ষে আইনজীবী না থাকাকে যুক্তিযুক্ত মনে করছেন তারা কি আসলে ভিক্টিমকে সমবেদনা জানাচ্ছেন নাকি আবেগের বশে ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করছেন এবং আসামীকে ছাড় পাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন!
লেখক : শিক্ষার্থী, এলএল.বি (অনার্স), ৪র্থ বর্ষ এবং সাধারণ সম্পাদক, জাস্টিস সার্ভড ফাউন্ডেশন।