'কোর্ট ম্যারেজ' এর আইনগত ভিত্তি ও করণীয়
অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী

মর্যাদার লড়াই নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় চাই বার-বেঞ্চের পারস্পরিক সম্মানবোধ

মো. রায়হান আলী : আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বার ও বেঞ্চের সুসম্পর্ক একান্ত জরুরি। বিচার সংশ্লিষ্টদের সুসম্পর্ক থাকলে একদিকে যেমন ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে অন্যদিকে বিচার প্রার্থীদের বিচার বিভাগের প্রতি আরো শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে। আমরা প্রায় সময় গণমাধ্যমের কল্যাণে এমনটা জানতে পারি যে, কোর্টের বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে মামলা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কিংবা শুনানীতে মতবিরোধের কারণে তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে কোর্ট বর্জনের মত ঘটনা ঘটে থাকে। যা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য মোটেও কাম্য নয়।

সম্প্রতি গণমাধ্যমের মাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারি ২২ সেপ্টেম্বর,২০২২ তারিখে খুলনার বিজ্ঞ ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের বিচারক জনাব নির্মলেন্দু দাশের আইনজীবীদের সাথে অসাদাচারণের ঘটনা সহ আরো অন্যান্য অভিযোগের প্রেক্ষিতে আইনজীবীরা প্রতিবাদ করায় উক্ত বিচারক ও খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির কিছু সদস্যের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। এতে করে আদালতপাড়ায় সেদিন বিচারকের এহেন ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছিল। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা বিচারঙ্গনে মোটেও কাম্য নয়।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে ন্যায় বিচার নিশ্চত করবে রাষ্ট্র। নাগরিকের জান-মাল রক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায় বিচার প্রাপ্তিটা একটা সাংবিধানিক অধিকার; আর এ অধিকার কোন ভাবেই খর্ব হতে পারে না। ন্যায় বিচার প্রাপ্তি একজন নাগরিকের প্রতি কোন দয়া নয়; বরং আইনগত অধিকার বটে। রাষ্ট্রের চারটি গুরুত্বপূর্ণ অর্গানের মধ্য অন্যতম হল বিচার বিভাগ। এই বিচার বিভাগের মাধ্যমেই বিচারিক সেবা দান করা হয় নাগরিকদের।

আমাদের সংবিধান বলা আছে, ‘আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভের অধিকার শুধু অধিকারই নয়, মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।’ মৌলিক অধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রদান করতে আইনত বাধ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র নাগরিকদের এসকল মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু শর্ত ও পদ্ধতি আরোপ করেছে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কিছু শর্ত ও পদ্ধতির কথা বলা আছে যা পূরণ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রয়োগ করা যায়। বিদ্যমান এ অধিকার বিচার বিভাগ আদালতের মাধ্যমেই মানুষের এ অধিকার প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করার বিধান আছে।

জনগণের বিচারিক সেবা প্রদানে রাষ্ট্রের দায়িত্বটা পালন করবে বিচারক, আইনজীবী ও বিচার সংশ্লিষ্টরা। এখানে একে অপরের পরিপূরক। তাই কোন ভাবে একে অপরের মধ্যে মত বিরোধের কারণে সুসম্পর্ক নষ্ট হলে বিচার বিভাগের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা কমে আসবে। বিচারক-আইনজীবীদের মধ্যে বিচারিক সেবা প্রদানে সুসম্পর্ক থাকা জরুরী হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুসম্পর্কের অবনতি ঘটছে।

বিচারঙ্গনে বিচারক-আইনজীবীর মধ্যে মতনৈক্যতার ঘটনা শুধু যে সাম্প্রতিক তা নয়, এমনটা পূর্বেও ঘটেছে। দুই আইনজীবীকে জরিমানা ও অসৌজন্যমূলক আচরণের বিষয়ে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির কাছে ১০ নভেম্বর, ২০২০ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যনির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে পত্র পাঠানো হয়।

প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো পত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘গত ৮ নভেম্বর রিট পিটিশন নম্বর ১৩১৪২/২০১৯ এর শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির দুইজন সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন এবং অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসানকে ১০০ টাকা করে জরিমানা এবং আদালত অবমাননার রুল ইস্যু করা হয়েছে। শুনানিতে আইনজীবীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। যা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবীদের মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মামলা দায়ের কিংবা পরিচালনার কারণে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে জরিমানা ধার্য কিংবা আদালত অবমাননার রুল ইস্যুর ক্ষেত্রে আদালতের কাছে সমিতি আরও সহনশীলতা প্রত্যাশা করে।’

আইনজীবী সমিতির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। আইনজীবী ও বিচারকের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ থাকলেই শুধু আদালত সুষ্ঠুভাবে তার মহান দায়িত্ব পালন করতে পারেন। দেশের আইনজীবীরা আইন ও আদালতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থেকে নিজেদের আইন পেশায় নিয়োজিত করেছেন। এই অন্যান্য ভূমিকার জন্য আইনজীবীদের আদালতের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলা হয়ে থাকে। আদালত সহনশীলতার সাথে তার ওপর অর্পিত মহান দায়িত্ব পালন করে থাকেন। অথচ ইদানীং দুই-একটি আদালতে মামলার শুনানি চলাকালে আইনজীবীদের বিভিন্নভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারের জন্য যুগযুগ ধরে গড়ে তোলা বার ও বেঞ্চের মধ্যে সুসম্পর্কের অবনতি হচ্ছে বলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মনে করে।’ (সূত্র: জাগো নিউজ২৪.কম; ১০ নভেম্বর ২০২০)

২০১৯ সালের ৩১ মার্চ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আইনজীবী এবং বিচারকদের সম্বলিত প্রচেষ্টায় বিচার বিভাগ এগিয়ে যেতে পারে। এতে বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। বিচারক বা আইনজীবী কারোরই দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা কাম্য নয়। বিচারক ও আইনজীবী পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ থাকা জরুরি। একজন আইনজীবী সম্পর্কে বেঞ্চের ভাল ধারণা থাকা ওই আইনজীবীর জন্য সম্পদ। একই কথা প্রযোজ্য একজন বিচারকের বেলায়ও। অর্থাৎ আইনজীবী ও বিচারকরা হচ্ছে একটি পাখির দুটি পাখার মতো। বাম হাত ও ডান হাতের মতো। তাদের পরস্পরের প্রতি আস্থার সম্পর্ক বিচার ব্যবস্থার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।’

বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়ানোর জন্য সারাদেশে মামলাজট কমানোর লক্ষ্যে বর্তমান প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আট বিভাগে হাইকোর্টের আট বিচারপতির নেতৃত্বে মনিটরিং সেল গঠন করেছেন। মনিটরিং কমিটি গঠনের পর কমিটির সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধায়ন, নিরবিচ্ছিন্ন মনিটরিং এবং গতিশীল নেতৃত্বে মামলা নিষ্পত্তির হার বেড়েছে।

মামলা নিষ্পত্তির এই হার আরো গতিশীল করতে এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার সংশ্লিষ্টদের সুসম্পর্ক একান্ত জরুরি। বার-বেঞ্চের সুসম্পর্ক বৃদ্ধিতে বিজ্ঞ বিচারক-আইনজীবীদের মধ্যে আরো ভূমিকা নিতে হবে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় বিচার সংশ্লিষ্টদের আরো উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : মো. রায়হান আলী; আইনজীবী, জজ কোর্ট, খুলনা।