সুদীপ চন্দ্র হালদার : একজন সিঁধেল চোর কোন ব্যক্তির ঘর থেকে কিছু অর্থ চুরি করে অন্ধকার রাতে দৌড়ে পালাতে যেয়ে একটি গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে শারীরিক ভাবে প্রচণ্ড আহত হলেন, তাহলে এটা কি উনার শাস্তি বা দণ্ড? আমাদের স্বাভাবিক নৈতিক দৃষ্টিতে কিংবা খানিকটা প্রতিশোধাত্মক মানসিকতায় উক্ত ঘটনাটিকে শাস্তি বা দন্ড ভাবলেও আইনি পরিভাষাতে এটা শাস্তি বা দণ্ড নয়। শাস্তি বা দণ্ড বলতে কোন ব্যক্তি তার দ্বারা সংঘটিত বা তার ওপর আইন দ্বারা অর্পিত কোন দায়িত্ব অবহেলা করার ফলে তিনি যে অপরাধ করেছেন, রাষ্ট্র অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান দ্বারা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় উক্ত অপরাধের বিচারের রায় হল শাস্তি বা দণ্ড।
শাস্তি বা দন্ড ব্যক্তি, সম্পদ তথা সমাজের রক্ষাকবচ স্বরূপ। অপরাধপ্রবণ লোকেরা আইনে দণ্ড বা শাস্তির বিধান আছে বলেই অন্যায় কাজ বা আইন ভঙ্গ করা থেকে অনেকাংশে বিরত থাকে। প্রাচীনকালে, যখন একজন ব্যক্তি, অন্য কোন ব্যক্তিকে আহত করতেন, তখন আহত ব্যক্তির সমপরিমাণে উক্ত ব্যক্তিকে আহত করতে পারাকে অধিকার বলে গণ্য করা হত। ওই সময়ে, একটি চোখের পরিবর্তে একটি চোখ, একটি দাঁতের পরিবর্তে একটি দাঁত, এমন প্রথাকে আইন বলে মনে করা হত।
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস থেকে দেখা যায়, রাজা’র অপরাধীদের বা আইন অমান্যকারীদের শাস্তি প্রদানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ছিল, যা তার রাজ্যের আইন মান্যকারী সভ্য নাগরিকদের সুরক্ষা প্রদানে কার্যকরী ভূমিকা রাখত। তবে, শাস্তি বা শাস্তির উদ্দেশ্য সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে শাস্তি বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে মানবাধিকার খুব দৃঢ় ভাবে বিবেচনা করা হয়। আমরা যদি পূর্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব, খুব সামান্য অপরাধে একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হত।
কিন্তু বর্তমান সময়ে, অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ভয়ানক অপরাধ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড সাধারণত দেয়া হয় না। যদিও, এখনও কিছু বিচারিক ব্যবস্থাতে নৃশংস শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, তবুও সভ্যতার ক্রম বিকাশের সাথে সাথে শাস্তি/দণ্ড প্রদান পূর্বের তুলনায় বহুলাংশে কম হিংস্রতাপূর্ণ ও মানবিক হয়েছে। শাস্তি বা দণ্ড মানেই যে এক ধরনের প্রতিশোধাত্মক নেতিবাচক আনন্দ, এই ভাবনা বা বিশ্বাস থেকে অধিকাংশ বিচারিক ব্যবস্থা দূরে চলে এসেছে।
শাস্তি/দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম মতবাদ প্রচলিত রয়েছে।
ডিটারেন্ট থিওরি
এই মতবাদ অনুযায়ী, অপরাধীকে দন্ড/শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্য হল, অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে সমাজে এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা, যেন পুনরায় কেউ এই ধরনের অপরাধ না করেন। অর্থাৎ, অভিযুক্ত ব্যক্তি যে অপরাধ করেছেন, তাকে শুধুমাত্র সেই অপরাধের জন্যই শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে না; বরং, পুনরায় ওই অভিযুক্ত ব্যক্তি কিংবা অন্য কেউ যেন এই ধরনের অপরাধ ভবিষ্যতে না করেন, তার জন্য শাস্তি/দন্ড প্রদান করা হচ্ছে। ড. বার্নেট এই মতবাদ প্রসঙ্গে রূপকভাবে বলেছেন, ঘোড়া চুরি করার জন্য তোমাকে ফাসি দেয়া হবে না, কিন্তু, যাতে পরবর্তীতে অন্য কোন ঘোড়া চুরি না হয়, সেজন্য তোমাকে ফাসি দেয়া। এই মতবাদকে, কেউ কেউ ইউটোপিয়ান বা ভাববাদী মতবাদও বলে থাকেন।
প্রিভেনটিভ থিওরি
প্রিভেনটিভ থিওরি সাধারণত এই প্রতিজ্ঞার ওপর ভিত্তি করে চলে, ‘দণ্ড/শাস্তি প্রতিশোধের জন্য নয়, শুধুমাত্রই অপরাধ বন্ধ করার জন্য’। এই মতবাদ অনুযায়ী, শাস্তির লক্ষ্য পুনরায় অপরাধ করা থেকে অপরাধীকে বিরত বা সংযত রাখা। যদি একজন অপরাধীকে বন্দী করা হয়, অপরাধীর অপরাধ করার সক্ষমতা বিনষ্ট করা হয় কিংবা মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তাহলে উক্ত অপরাধী পুনরায় অপরাধ করতে পারবেন না এবং সমাজ সুরক্ষিত থাকবে। এই মতবাদে, জেলবন্দী করা অপরাধ হ্রাসের অন্যতম নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রিফর্মেটিভ থিওরি
এই মতবাদ অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয়, অপরাধ প্রবণতা এক ধরনের ব্যাধি বা রোগ; তাই যথাযথ শিক্ষা, ট্রেনিং, ইতিবাচক ব্যবহার ইত্যাদি করলে অপরাধী তার ব্যাধিস্বরূপ এই অপরাধ প্রবনতা থেকে মুক্তি পেতে পারেন; সমাজের আইন মান্যকারী একজন সুসভ্য মানুষে পরিনত হতে পারেন। বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে, অভিযুক্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে এই মতবাদের ব্যবহারিক প্রয়োগ করা হচ্ছে।
রেট্রিবিউশন থিওরি
রেট্রিবিউশন থিওরি মানেই হল কোন অপরাধের প্রতিশোধ হিসেবে নির্দিষ্ট দণ্ড/শাস্তি প্রদান। এই মতবাদ অনুযায়ী, কোন অপরাধী ঠিক সেই ধরনের দণ্ড/শাস্তি ভোগ করার যোগ্য, যেটা সে ভিকটিমকে করেছে। অর্থাৎ, যেমন আঘাত, ঠিক তদ্রুপ, প্রতিঘাত। রেট্রিবিউশন থিওরি অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয়, অপরাধী অপরাধ/আইন ভঙ্গ করে সমাজের ক্ষতি করেছে, আর তাই, দণ্ড/শাস্তি ভোগের মাধ্যমে সমাজকে তার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
ইনক্যাপাসাইটেশন থিওরি
এই মতবাদ অনুযায়ী, একজন সভ্য মানুষ সমাজে যে সুযোগ, সুবিধা ও স্বাধীনতা ভোগ করেন, অপরাধীকে ঠিক সেই স্বাভাবিক সুযোগ, সুবিধা ও স্বাধীনতা থেকে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বঞ্চিত করলে করলে, অপরাধী অপরাধপ্রবণতা বা অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবেন। অর্থাৎ, সাময়িক সামাজিক সুবিধা বঞ্চিত করলে, অপরাধীর অপকর্ম থেকে সমাজ সুরক্ষিত থাকবে। এই মতবাদের উৎপত্তি ব্রিটেন থেকে। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে যারা বৃটিশ রাজত্বে অপরাধী বলে পরিগনিত হতেন, তাদের অনেককেই শাস্তিস্বরূপ অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বাসনে পাঠানো হত।
কমপেনসেটরি থিওরি
কমপেনসেটরি থিওরি অনুযায়ী, ভিকটিম দন্ডিত ব্যক্তির নিকট থেকে ক্ষতিপূরন পাবেন। তবে, কমপেনসেটরি পদ্ধতিতে শাস্তি/দণ্ড সাধারণত যে সকল অপরাধীরা/আইন অমান্যকারীরা অপরাধ করে, সেটা অনুধাবন করে অনুতপ্ত হয়ে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রেই প্রায়োগিক হয়ে থাকে। এই মতবাদের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়, শাস্তি/দণ্ডের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র জেল বন্দী করা নয়, বরং অপরাধীকে পুনর্বাসন ও সংস্কার করা।
‘ড. জ্যাকব জর্জ বনাম স্টেট অব কেরালা’ কেসে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, শাস্তি/দণ্ড প্রদানের প্রত্যেকটা ধরন বা মতবাদ নির্দিস্ট কেস/ঘটনা/ফ্যাক্ট ভেদেই ভিন্নতর হয়ে থাকে, কোন একটি ধরন বা মতবাদ অন্য মতবাদের ওপর প্রাধান্য করার সুযোগ নেই।
লেখক : সুদীপ চন্দ্র হালদার; পিএইচডি গবেষক [আইন], বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত।