এস.এম. আরিফ মন্ডল : দেশের সব নাগরিকের জন্য আইন সমান, তাই হিজড়াদের ক্ষেত্রেও কোন ব্যতিক্রম নেই। হিজড়ারা (তৃতীয় লিঙ্গ) সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।তাদের উত্তরাধিকার আইন নিশ্চিত করার জন্য ২০২০ সালে মন্ত্রিপরিষদ নির্দেশনা দিয়েছে। শরিয়া আইনেও তৃতীয় লিঙ্গের সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন নীতিমালা- ২০১৩’ সরকার কর্তৃক প্রণীত হয়েছে মূলত তাদেরকে শিক্ষিত করে মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার জন্য। হিজড়াদের পারিবারিক, আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ২০২০-২১ অর্থ বছরে সরকার প্রায় ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল।
এবছরের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট ট্রান্সজেন্ডার এর সংখ্যা প্রায় ১২,৬২৯ জন। এই জনগোষ্ঠীকে মূল স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত করার জন্য সরকার বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করে থাকে। তাদেরকে ট্রাফিক পুলিশের চাকরি দেওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের বাস্তবায়নাধীন।
গতবারের বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে চাকুরী দিলে প্রতিষ্ঠানে কর্পোরেট করহারে ছাড়ের বিধান ছিল। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও উন্নয়ন সংস্থা অনেক হিজড়াদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ভবঘুরে কেন্দ্রে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে হিজড়ারা থাকতে চান না। হিজড়াদের নিয়ে সরকারের প্রকল্পগুলো সফলতার মুখ দেখে না, কারণ তারা বর্তমান পেশা ছাড়তে আগ্রহী না।
একটি পরিবারে স্বাভাবিক বাচ্চার মত হিজড়ারও জন্ম হয়। জন্মের পর স্বাভাবিক বাচ্চাটি পরিবারের সাথেই থাকে, আর তৃতীয় লিঙ্গের বাচ্চাটি জন্মের কয়েক বছর পর বিভিন্ন কারনে হিজড়া সম্প্রদায়ের কাছেই বড় হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে তৃতীয় লিঙ্গের বাচ্চাটির মধ্যে হিজড়াদের অমানবিক (!) আচরণগুলো পরিলক্ষিত হয়। তৃতীয় লিঙ্গের বাচ্চাটিকে মূল স্রোতধারায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে তাদের পরিবারেই সম্পৃক্ত করতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গ বাচ্চাটিকে পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও সামাজিকভাবে সম্পৃক্ত সবাইকে স্ব- স্ব অবস্থানে সহযোগিতা করতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের বাচ্চাটিকে তার পরিবারেই ঠাই দিতে হবে আর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যথায় সরকার এবং ব্যক্তি/ প্রতিষ্ঠানের কোন উদ্যোগেই ফলপ্রসূ হবে না।
ঢাকা শহরে এমন একজন লোকও পাওয়া যাবে না তিনি হিজড়ার বিড়ম্বনায় পরেননি। প্রতিদিন বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে তারা বকশিসের নামে চাঁদা আদায় করে থাকেন। যদি আপনার সাথে কথাবার্তায় একটু নড়াচড়া হয় মুহূর্তে অশ্লীল ভাষায় গালি হজম করতে হবে। আর আপনাকে বেশি পছন্দ হলে দেখবেন আপনার শরীরের যেকোনো স্থানে তার হাত চলে গেছে! আর তাদের চাহিবা মাত্র টাকা দিলে আপনার সম্মান অটুট থাকবে। রিকশায় সহযাত্রী যদি আপনার প্রিয়তম লাজুক স্ত্রী/প্রেমিকা হয়, তবে হিজড়ার পোয়া বারো! এমতাবস্থায় আপনাকে টাকা দিতে হবে আর সাথে সাথে তার মনমোহিনী বানীও শুনতে হবে।
হিজড়ারা ঢাকা শহরে বকশিসের নাম করে বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি করে আসছে। বিশেষত: রাস্তাঘাটে, পরিবহনের যাত্রী, দোকানদার,বাসা – বাড়িতে নবজাতক সন্তান জন্ম নিলে নিশ্চিত চাঁদা আদায় করে থাকে। হিজড়াদের এমন চাঁদা আদায়ের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোর বার্তা দেওয়ার শর্তেও তারা মানছে না। ক্ষেত্রবিশেষে হিজড়াদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের হচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় একটি ভবনে নবজাতকের জন্য দুটি পরিবারের কাছ থেকে চাঁদার দাবিতে ‘উৎপাত ও ভয়-ভীতি’ দেখানোর অভিযোগে চার হিজড়াকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরিবহনে চাঁদাবাজির অভিযোগে এমাসেই উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের হলে চারজন হিজড়াকে গ্রেফতার করা হয়।
হিজড়াদের অযাচিত চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ‘আইন – শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন-২০০২ এর ধারা ২(খ) এর সংজ্ঞাভুক্ত অপরাধ বিশেষত: ২(খ)(ঈ),২(খ)(উ) করলে পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও অপরাধ সংঘটনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কিংবা অপরাধ সংঘটন সম্পকে অবহিত আছেন এমন কোন ব্যক্তির লিখিত অভিযোগে আদালত কোন অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ করতে পারেন।
উল্লেখ্য, হিজড়ারা ভাসমান হওয়ায় তাদের নাম ও ঠিকানা জোগাড় করা সম্ভব হয় না। উপর্যুক্ত আইনের অপরাধসমূহ আমলযোগ্য (cognizable) তাই হিজড়ারা চাঁদাবাজি সহ অন্যান্য অপরাধের চেষ্টা করলে তাদের হাতে-নাতে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে মামলা দায়ের করতে পারেন।
নবজাতক জন্ম নিলে বকশিসের নামে চাঁদাবাজি করতে সাধারণত বাসা বাড়িতে জোরপূর্বক প্রবেশ করে টাকাসহ, মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায়। কথিত হিজড়ারা দলবদ্ধ ভাবে যেকোনো সময় বাসায় জোরপূর্বক প্রবেশ করে তাদের শক্তির মহড়া বা দাপট প্রদর্শন করে ভয়-ভীতি বা ত্রাস সৃষ্টি বা বিশৃঙ্খলা বা অরাজকতা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে। পুলিশের কাছে সহযোগিতার জন্য ৯৯৯ ফোন দিয়ে আপনি তাৎক্ষণিকভাবে হিজড়াদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাসহ আত্মরক্ষা করতে পারেন।
লেখক : আইনজীবী; বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, ই-মেইল: mondolarif@yahoo.com