মনজিলা সুলতানা ঝুমা : প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগনকে সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতিতে সেবা প্রদানের লক্ষে বাংলাদেশ পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত সেবার নাম জাতীয় জরুরী সেবা। সরকার সকল স্তরের জনগণকে নাগরিক সুবিধা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ; জাতির জন্যে এক বিরাট অর্জন। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ ৪১তম অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। তাই বর্তমান সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সকল ক্ষেত্রে ডিজিটালাজইড করছেন। এরই ধারাবাহিকতা ‘৯৯৯’ কোড এর মাধ্যমে ন্যাশলাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।
জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’ কি
তিন ডিজিটের একটি সংখ্যা ৯৯৯ বাংলাদেশ পুলিশের অধীনে পরিচালিত একটি জরুরি কল সেন্টার। এটি জাতীয় জরুরী সেবা নামে পরিচিত। সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘন্টা চালু রয়েছে এ কল সেন্টার। ৯৯৯ একটি টোল ফ্রি নাম্বার। দেশের সর্বস্তরের নাগরিকদের জরুরি সেবা প্রদানের উদ্দেশ্য ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর এই সেবা চালু হয়। যেকোনো বিপদে পড়লে, সাইবার অপরাধের শিকার অথবা যৌন হেনস্থার শিকার হলে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে দ্রুত সেবা পাওয়া যায়। মানুষের বিপদে সহায়ক হিসেবে যুক্ত হওয়া নতুন এই সেবা পরিচালিত হয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে। জরুরি সেবা হিসেবে এখান থেকে শুধু পুলিশী সাহায্য, জরুরি প্রয়োজনে ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্স সেবাও পাওয়া যায়। বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ এই সেবার জন্য ফোন করতে পারেন। সপ্তাহে ৭ দিন ২৪ ঘণ্টা চালু রয়েছে এ সেবা। ‘৯৯৯ ইউনিট’ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস প্রদান করে যাচ্ছে। ৯৯৯–এ ফোন করতে কোনো খরচও নেই, এটি সম্পূর্ণ টোল ফ্রি।
জরুরী সেবা ৯৯৯-এ কল করা আগে যেসব বিষয় জানা জরুরি
বাংলাদেশ পুলিশ জনগণের বন্ধু। নাগরিকদের যে কোনো সমস্যায় তাদের সহযোগিতা করা পুলিশের কর্তব্য। পুলিশী সেবা আরো দ্রুত করা এবং বিপদজনক মুহুর্তে জনগনকে সঠিক পদ্ধতিতে দ্রুত সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের একটি দক্ষ টিম কাজ করছে জাতীয় জরুরী সেবা সেন্টারে। নাগরিক কখন,কীভাবে পুলিশ সহযোগিতা নেবেন কখন নেবেন না এটা জানা জরুরী।
৯৯৯ জরুরী সেবা থেকে কী কী সুবিধা পাওয়া যায়
জরুরী সেবা হিসেবে যে ৩ ধরনের সেবাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তা হলো-
১. পুলিশ সম্পর্কিত তাৎক্ষণিক যে কোনো সেবা।
২. ইমারজেন্সি এ্যাম্বুলেন্স সেবা।
৩. ইমারজেন্সি ফায়ারসার্ভিস সেবা।
জরুরী অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ারসার্ভিস সেবা
৯৯৯ সার্ভিসের মাধ্যমে যে অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিস সেবা নেয়া যায়। তবে অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদান করা হয়, তা কিন্তু বিনামূল্যে নয়। এছাড়া শুধু অগ্নিকাণ্ড নয়, ফায়ার সার্ভিস আরও নানা ধরনের সেবা প্রদান করে থাকে। যেমন সড়ক দুর্ঘটনা, নৌ দুর্ঘটনা, আটকে পড়া মানুষ বা পশু-পাখি উদ্ধার ইত্যাদি।
৯৯৯ থেকে তাৎক্ষণিক জরুরি সেবা পেতে যা যা করতে হবে
১. সঠিক ঠিকানা প্রদান এবং পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করা
জরুরি সেবা পাওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য হলো সাহায্য প্রার্থীর সঠিক লোকেশন বা ঠিকানা জানানো। জেলা বা উপজেলার নাম উল্লেখ করা বা রাস্তা বা বাড়ির নাম উল্লেখ অথবা সঠিক অবস্থান জানা না থাকলে পার্শ্ববর্তী কোন নির্দিষ্ট স্থানের নাম উল্লেখ করতে হবে। ভিকটিমের ফোন ট্র্যাক করে ৯৯৯ অবস্থান জানতে পারবে। কিন্তু তাদের কাজ আরো সহজ করতে নির্দিষ্ট অবস্থান সম্পর্কে ভালোভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তাই ফোন করা পরে পুলিশকে সেবা প্রার্থীর যথাযথ ঠিকানা জানানো জরুরী।
২. ৯৯৯ এর কল সেন্টারের প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদান
জরুরি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এক্ষেত্রে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ) সেবা প্রার্থীকে কিছু প্রশ্ন করবেন যাতে তারা যথাযথ কর্মকর্তা বা কর্তৃপক্ষের কাছে যাতে প্রয়োজন জানাতে পারে। অথবা সেবা প্রার্থীকে জীবন রক্ষাকারী কিছু পরামর্শ বা করণীয় সম্পর্কে জানাতে পারেন। ফোনে সমস্যা বিস্তারিত তুলে ধরার সময় ধৈর্যশীল থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে অস্থির হয়ে বা বিচলিত হয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা বলা থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। জরুরি পরিস্থিতি ব্যাখ্যার সময় কয়েকটি বিষয়ে সতর্কতার সঙ্গে তথ্য দিতে হবে। কলকারী ব্যক্তি নিজে নাকি তার কাছের কেউ সমস্যায় পড়েছে, সমস্যার উৎপত্তি, বর্তমান পরিস্থিতি এবং কোন ধরনের জরুরি সেবা প্রয়োজন – অ্যাম্বুলেন্স? পুলিশ? নাকি অন্য জরুরি সেবা? অথবা কেউ আহত হলে তার পরিস্থিতি পরিষ্কারভাবে জানাতে হবে।
৯৯৯-এ ফোন করে তথ্য প্রদান করে পুলিশকে সাহায্য করলে তাকে পরবর্তী সময়ে কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয় কি?
না , ৯৯৯-এ ফোন করে তথ্য প্রদান করে পুলিশকে সাহায্য করলে তাকে পরবর্তী সময়ে কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয় না।
এখানে তথ্যদাতার গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। তাঁর তথ্য প্রকাশ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তথ্যদাতার পরিচয় প্রয়োজন হয়। সেটাও নিজস্ব চ্যানেলে মোকাবিলা করা হয়।এই সেবা পেতে হলে বাড়তি কিছুই করতে হয় না। শুধু ৯৯৯-এ একটি কলই যথেষ্ট। বাকিটা হেল্প ডেস্ক থেকেও করা হয়ে থাকে।
২৪ ঘণ্টা জরুরি সেবা কি আসলেই সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। নাগরিকদের জরুরি সেবা দিতে ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছে জাতীয় জরুরি সেবা হেল্প ডেস্ক ৯৯৯। দুর্বৃত্ত আক্রান্ত নারী কিংবা সন্ত্রাসীদের কবলে পড়ে কল, অথবা কোন এলাকায় পুরোনো গাছ উদ্ধারে, নারী নির্যাতন, চাঁদাবাজী রোধে বিরাট ভুমিকা রেখেছে ৯৯৯। দুর্ঘটনায় সহায়তা, বাল্যবিবাহ রোধ, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধীদের গ্রেপ্তার, গৃহকর্মী নির্যাতন রোধ, পারিবারিক নির্যাতন বন্ধ ইত্যাদিতে ৯৯৯-এ তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন লাখো মানুষ। ৯৯৯-এ ফোন করে ঝামেলা এড়িয়ে সহজে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন জরুরি সেবা পেয়েছেন মানুষ। আশপাশ থেকে সচেতন নাগরিকদের ফোন পেয়ে পুলিশ গিয়ে পশুপাখি কিংবা অজ্ঞাত কোন লাশ উদ্ধার করেছে এমন ঘটনা অহরহ আছে।
বাংলাদেশে জরুরি সেবার ধরণ
বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ৯৯৯ নম্বরে ফোন করা হলে প্রশিক্ষিত এজেন্টরা জরুরি ফায়ার সার্ভিস বা পুলিশ কিংবা এ্যাম্বুলেন্স সেবা প্রদানকারীর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেন। এখানে যারা কল রিসিভ করেন তাদেরকে বলা হয় কল টেকার। তাদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন কয়েকজন কর্মকর্তা। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা এখানে চারটি শিফটে কাজ করা হয়ে থাকে।
অন্যান্য দেশে জাতীয় জরুরী সেবার ধরণঃ
যুক্তরাজ্য, মালেয়েশিয়া, হংকং, পোলান্ড, আরব আমিরাত, বাহরাইন, কেনিয়া, কাতার, আয়ারল্যান্ড, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও জিম্বাবুয়েসহ অনেক দেশেই ৯৯৯ শর্টকোড জরুরি সেবা সার্ভিস চালু রয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়াতে ‘০০০’, নিউজিল্যান্ডে ‘১১১’, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ‘১১২’, কানাডা ও আমেরিকায় ‘৯১১’ শর্টকোড দিয়ে জরুরি সেবা সার্ভিস চালু রয়েছে।
মন্তব্য
মনে রাখবেন ৯৯৯ এ অযথা ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন না। ভুল তথ্য প্রদান এবং বেআইনি কর্মকান্ডে জড়িত থাকার কারণে তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে নেয়া হতে পারে আইনি ব্যবস্থা। তাই সবসময় প্রয়োজনে ফোন দিতে হবে অপ্রয়োজনে নয়। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই নম্বরটি মোটামুটি পরিচিত হলেও নির্দিষ্টভাবে কি ধরনের সেবার জন্য এখানে ফোন করা যাবে তা জানেন না এখনো অনেকে তাই জনগণকে সচেতন করার পাশাপাশি, প্রচারণার মাধ্যমে এই সেবাকে জনসেবায় পরিণত করা যাবে।
লেখক : আইনজীবী; জেলা ও দায়রা আদালত, ঢাকা এবং খাগড়াছড়ি।