অ্যাডভোকেট মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী (বাবু) : পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গুণী ব্যক্তির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। যুগে যুগে কালে কালে যারা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন তেমনি বাংলাদেশের আইন অঙ্গনে বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ.ক.ম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী হলেন আলোকবর্তিকার মতো ও অবিস্মরিণীয় একটি উজ্জল নক্ষত্রের নাম।
পরিশ্রম, সততা, মেধা, আন্তরিকতা ও অধ্যবসায়ের বলে পেশাগত জীবনে তিনি ছিলেন এক মহীরুহ। অতি অল্পদিনে চলে গেলেন আমাদের আইনজীবী সমাজের গর্বের মানুষ বিশাল হৃদয়ের এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিটি। আজ অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আন্তরিক শ্রদ্ধাভরে এই বরেণ্য আইনজীবী স্যারকে স্মরণ করছি।
আ.ক.ম. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, দেশ বরেণ্য সিনিয়র আইনজীবী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বারের অনেক বিশিষ্ট গুণী আইনযোদ্ধা বিভিন্ন সময়ে আমাদের কাছ থেকে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
আইনজীবী পরিবারের তেমনি একজন সূর্য সন্তান ছিলেন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক সদস্য, সাবেক চট্টগ্রাম জেলা পিপি (জীবনের শেষ অবধি পর্যন্ত) বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আ.ক.ম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যাঁকে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য মানস কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঐতিহাসিক লালদীঘির ময়দানে ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম ১৫ আসন (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) হতে নৌকার প্রতীক নিয়ে মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য নির্বাচন করার মনোনয়ন দিয়েছিলেন।
এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালনসহ বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ নীতি নির্ধারণী ষ্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ছিলেন। শুধু তাই নয় পটিয়া আইন কলেজের অধ্যাপক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এই বরেণ্য আইনজীবী আদালত পাড়ায় সর্বজন গুণীজন ও বিচারাঙ্গণে একজন আইনী অভিভাবক সহ আইন অংগনের বটবৃক্ষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিতি ছিলেন।
স্যারের আপন মেজ ভাই আমার শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম অ্যাডভোকেট মফিজুর রহমান চৌধুরীর উৎসাহ ,অনুপ্রেরণায় তিনি আইন অঙ্গনে পদার্পন করেন। শুরু করেন আইন বিষয়ে পড়াশুনা। আইনজীবী সমাজের অহংকার এই মহান ব্যক্তির পৃথিবীতে আর্বিভাব ঘটে ১৯৫৫ সালের ১০ নভেম্বর চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া থানার চাকফিরানী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হায়দার আলী সিকদার বাড়ীর এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। যে শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে উঠেন আইনজীবীদের সেরা একজন ও রাজনৈতিক অবিসংবাদিত নেতা।
শৈশবেই তিনি বাবা মরহুম মকবুল আহমেদ ও মাতা মরহুমা মায়মুনা খাতুনকে হারিয়েছিলেন। স্যারের শৈশব কাটে তাঁর সুজলা সুফলা প্রকৃতির আচ্ছন্ন ঘেরা নিজ গ্রামে। পথ ঘাট শান্ত ছায়া নিভৃত পল্লীতেই তাঁর বেড়ে উঠা। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান এই বরেণ্য আইনজীবী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হতে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী শেষ করে আইনের বিদ্যাপীঠ ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম আইন কলেজ হতে আইনে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন এবং একজন আইনজীবী হিসেবেই তিনি তার কর্মজীবন শুরু করেন।
ধীরে ধীরে আইন জগতের এই অভিভাবকের আইন পেশায় সফলতা আসতে থাকে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও বেশ সুনাম অর্জন করেন। তিনি আইনজীবী পেশায় তাঁর জীবনের সুদীর্ঘ ৪২ টি বছর অতিবাহিত করেছিলেন। স্যারের চেম্বার থেকে হাজার হাজার আইনজীবী জুনিয়রশীপ শেষ করেছেন। অনেকে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করছেন এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট পদেও বহাল আছেন।
আগাগোড়া একজন পেশাজীবী হয়েও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম ও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। ছাত্র জীবন থেকে কর্মজীবনের সর্বস্তরে জবাবদিহিতা, সৎ ও সুস্থ রাজীতির বিকাশ, গণ মানুষের উন্নয়ন তথা সামাজিক কর্মকান্ডে তিনি সব সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু,গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি সারাটা জীবন আন্দোলন করে গেছেন। তাঁর জীবনটাই ছিল গনতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত প্রাণ। এ ক্ষেত্রে তিনি পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
ছাত্র জীবন হতেই তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি সাহিত্য চর্চায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং ছাত্র অবস্থায় অসংখ্য নাটক ও উপন্যাস লিখেছিলেন। তাঁর স্বরচিত বিভিন্ন নাটকে নির্দেশনা,অভিনয় ও করেছেন। মানব সেবায় তাঁর অবদান ছিল অবিস্মরণীয়। এই বিশিষ্ট আইনজীবী মেধায়, মননে, দক্ষতায়, অত্যন্ত জ্ঞানী, নিরহংকারী ও সহজ সরল ব্যক্তি হিসেবে অতি অল্প সময়েই সকলের আস্থাভাজন হয়ে উঠেন এবং আদালত পাড়ায় অবিসংবাদিত আইনজীবী নেতা হিসেবে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। জীবনের শুরু হতে শেষ অবধি সবকিছু পরিচালনা করেছেন অসীম দক্ষতা ও যোগ্যতায়। সর্ব পেশার মানুষকে শ্রদ্ধা করতেন তিনি। সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ছিল মানুষকে উদ্ভোদ্ধ করার মতো অসাধারণ বজ্রকন্ঠ। খুব অল্প সময়েই তিনি আইনজীবী ও রাজনৈতিক নেতা হিসেবে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
একাধারে রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, আইনজীবী হিসেবে পরিচিতি হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন অনলবর্ষী বক্তা হিসেবেও ভক্তদের কাছ থেকে প্রচুর সুনাম অর্জন করে নিয়েছিলেন ইতোমধ্যে। খুব অল্প কথায় তাঁর বক্তব্যের প্রধান প্রধান বিষয় কোন গুরুত্বপূর্ণ দিকই বাদ না দিয়ে উপস্থিত দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতেন।
২০২২ সালের চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে চট্টগ্রাম বারের অডিটরিয়ামে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের সংগঠন সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত সভায় এই অনলবর্ষী বক্তা সিরাজ স্যার বলেছিলেন ‘‘হিমালয়ের সাথে যেমন সিআরবি পাহাড়ের তুলনা হয়না, তেমনি সমন্বয়ের সাথে ঐক্য পরিষদের তুলনা হয়না’’। স্যারের এই বক্তব্য বেশ আলোড়ন ও সাড়া জাগিয়েছিল এবং তাঁর মৃত্যুর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক আইনজীবী তাঁর বক্তব্যটি লিখে সম্মানসূচক স্ট্যাটাসও দিয়েছেন।
স্যারের তুলনা স্যার নিজেই। অন্য কারো সাথে এই মহান ব্যক্তির তুলনা চলেনা। স্যারের মৃত্যুর পর তাঁর একজন শুভানুধ্যায়ী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন ‘‘আমি বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি কিন্তু উকিল সিরাজকে দেখেছি’’। এছাড়াও স্যারের একজন শিষ্য চট্টগ্রাম বারের আইনজীবী রফিকুল হাসান সাহেব লিখেছিলেন- ‘‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথারিয়া, কোথাও তুমি নেই, লুসাই থেকে কর্ণফুলী, সুর্যোদয় থেকে সুর্যাস্তে, তোমাকে মনে পড়বেই। …… এইভাবে কবিতা লিখে স্যারের নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির যেকোন র্দুদিনে, সময়ে, অসময়ে, সংকটময় মুর্হুতে তিনি পাশে থেকেছেন। আইন অঙ্গণে দেওয়ানী,ফৌজদারী ও রাজস্ব আইনে পারদর্শী ছিলেন বিধায় যেকোন মুর্হুতে আইনগত যে কোন সমস্যার দ্রুত সমাধান দিতে পারতেন।
শত ব্যস্ততার মাঝেও স্যার প্রতি সপ্তাহে নিজ গ্রামে ছুটে যেতেন। গ্রামবাসীদের সুখে দুঃখে, ভালমন্দে, বিপদে আপদে সব সময় তাদের পাশে থাকতেন। আত্মীয়, অনাত্মীয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে মূল্যায়ন করেছেন স্রষ্টার সৃষ্টি সেরা মানব হিসেবে। তিনি এলাকায় বিভিন্ন স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, সামাজিক সংগঠনের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
দেশ বরেণ্য আইনজীবী ও একজন প্রতিভাবান মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সবার সাথে তিনি সহজ সরল মনোভাব পোষণ করতেন। সুবিধা বঞ্চিত অসহায় মানুষের প্রতি ছিলেন কোমল ও সহানুভুতিশীল। ‘‘কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত’’ জন্মিলে মরিতে হইবে। প্রকৃতির নিয়মের কাছে হার মেনে এই দেশ বরেণ্য আইনজীবী সবাইকে কাঁদিয়ে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন রোজ বৃহস্পতিবার চট্টগ্রামস্থ পার্কভিউ হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
৬৭ বছর বয়সী এই স্যারকে তাঁর নিজ জন্মভুমি লোহাগাড়া থানার চাকফিরানী গ্রামের ঐতিহ্যবাহী হায়দার আলী সিকদার বাড়ীর পারিবারিক গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। আইনী জগতের অভিভাবক এই মহান ব্যক্তির শুন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়। আত্মীয়, অনাত্মীয়, দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন, আইনজীবীগন, সহযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সচিব, মেয়র, সাংবাদিক, সাধারন জনগন, পাড়া প্রতিবেশী তথা চট্টগ্রাম এর সর্বস্তরের জনগণ ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজার হাজার মানুষ তাঁর জানাযায় অংশ গ্রহণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ, মন্ত্রীবর্গ, সাংবাদিকগন শোক প্রকাশ আনয়ন করেছেন। এখনও তাঁর অনুসারীরা গভীর শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করেন এবং তাঁর কবর জিয়ারত করেন।
এই বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলার পিপি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও নানান গুনে গুনান্বিত অ্যাডভোকেট আ.ক.ম সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উজ্জল ও অসাধারণ কর্মজীবন তাকে তাঁর সময়ে একটি জীবন্ত কিংবদন্তী এবং পরবর্তী প্রজম্মের জন্য একটি স্মরণীয় নাম হিসেবে উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন আজীবন। আইনজীবী সমাজের এই মহামানবের উল্লেখ্যযোগ্য অবদানগুলো অনন্ত কাল ধরে মানুষের নিকট নজীর স্থাপন হয়ে থাকবে।
শারীরীকভাবে স্যারের মৃত্যু হলেও তিনি আমাদের কাছে অমর অক্ষয় হয়ে থাকবেন সারাটা জীবন। অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে গভীর ভালোবাসায় তিনি সিক্ত হয়ে আছেন, থাকবেন। কালের বিবর্তনে যাতে স্যারের স্মৃতি বিলীন হয়ে না যায়, আইনজীবী পরিবারের এই মহানায়কের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের নিকট তাঁর জন্মস্থান লোহাগাড়া থানার চাকফিরানী গ্রামে স্যারের নামে একটি সড়ক নামকরন এবং চট্টগ্রাম বারের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে (ফোকাল পয়েন্ট) একটি স্মৃতিফলক নামকরনের জন্য চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির স্যারের সকল শুভানুধ্যায়ী, সহযোদ্ধা, বর্তমান ও সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মহোদয় ও বার কাউন্সিলের বর্তমান ও সাবেক সদস্যগণ মহোদয়ের নিকট প্রাণের দাবী ও বিনীত আরজ জ্ঞাপন করছি। ভালো থাকুন স্যার পরপারে ভালো থাকুন। আল্লাহ আপনাকে বেহেস্তের উঁচু মাকামে নসীব করুক।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট।