কামরুজ্জামান পলাশ:
গত ১১ মার্চ ২০১৫ খ্রিঃ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় , “স্ত্রীকে আটকে রাখা হয়েছে?” শীর্ষক একটি লেখা প্রকাশিত হয়। যেখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে। এতে বলা হয় যে, তরুণ-তরুণী পরিবারের অমতেই বিয়ে করে নেয় যদিও ছেলেটির পরিবার বিয়েটি মেনে নিয়েছিল। একপর্যায়ে যখন মেয়েটির মা-বাবা উভয়ই মেনে নিতে চায়, তখনই বাদ সাধে মেয়ের বড় ভাই। সেই বড় ভাই বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসে পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নিয়েছে এই মর্মে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সুকৌশলে বোনকে নিয়ে যায় তাদের বাড়ীতে। যথারীতি বোন সরল বিশ্বাসে ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে চলে যায় ভাইয়ের সাথে নিজ বাড়ীতে। পরবর্তীতে বোনের স্বামী তার স্ত্রীর মুঠোফোন বন্ধ পেয়ে তার স্ত্রীর বড় ভাইয়ের কাছে ফোন দিলে মেয়েটির বড় ভাই বোনের স্বামীকে গালিগালাজ করেন ও ফোনটি কেটে দেন।
এইরকম সমস্যার শিকার হয়েছেন অনেকেই। আমরা সিনেমার পর্দায় বহুবার দেখেছি নায়কের স্ত্রী (নায়িকা) কে জোর করে আটকে রেখেছে নায়িকার বদমেজাজী ও অহংকারী মা।যার একটি অবিকল দৃশ্য আমরা দেখতে পাই কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেঞ্জিৎ চ্যাটার্জি ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অভিনীত সিনেমা “শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ” ছবিটিতে। যেখানে নায়কের স্ত্রী (নায়িকা) কে তার মা জোর করে আটকে রেখেছেন। তাই নায়ক তার দলবল নিয়ে হাজির হন শ্বশুর বাড়ীতে তার বিয়ে করা বউ (নায়িকা) কে উদ্ধার করতে। তবে বলা যায়, এই প্রতিকার সিনেমার পর্দার মধ্যেই সীমাবব্ধ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে এ ধরনের সমস্যার প্রতিকার কি?
আমাদের দেশের ১৮৬৯ সালের ৪ নং আইন “দ্য ডিভোর্স এ্যাক্ট–১৮৬৯” এর ধারা-৩২; তাছাড়া ১৮৯৮ সালের ৫ নং আইন “ ফৌজদারী কার্যবিধি–১৮৯৮” এর ধারা-১০০ এবং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন, গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর আর্টিকেল-১০২ এইরূপ ঘটে যাওয়া অবৈধ আটকের (ইলিগ্যাল কনফাইনমেন্ট)বিরুদ্ধে প্রতিকার প্রদান করে।
প্রতিকার- ১
“দ্য ডিভোর্স এ্যাক্ট–১৮৬৯” এর ধারা-৩২ এ বলা হয়েছে, যখন স্বামী কিংবা স্ত্রী যুক্তিসঙ্গত কারন ছাড়াই একজন অন্যজনকে ছেড়ে চলে যায়, তখন স্বামী কিংবা স্ত্রী এর “দাম্পত্য জীবন পুনঃউদ্ধার” আবেদনের প্রেক্ষিতে জেলা জজ আদালত কিংবা হাইকোর্ট বিভাগ যদি সন্তুষ্ট হন, তাহলে বিজ্ঞ আদালত দাম্পত্য জীবন পুনঃউদ্ধারের জন্য একটি ডিক্রি জারি করবেন।
প্রতিকার- ২
“ফৌজদারী কার্যবিধি–১৮৯৮” এর ধারা-১০০ এ বলা হয়েছে, যখন মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট, ১ম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট কিংবা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট এই মর্মে বিশ্বাস করেন যে, একটি ব্যক্তি এমন অবস্থায় বন্দী রয়েছেন যে বন্দীত্বটি একটি অপরাধ গঠন করে, তাহলে উক্ত বন্দি ব্যক্তিকে খোঁজার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেট সার্চ-ওয়ারেন্ট (তল্লাশি হুকুমনামা) জারি করবেন এবং বন্দিকৃত ব্যক্তিকে যদি পাওয়া যায় তাকে অবিলম্বে ম্যাজিষ্ট্রেটের সামনে হাজির করা হবে।
প্রতিকার- ৩
কোন ব্যক্তিকে অবৈধভাবে বন্দি রাখার কারনে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান কর্তৃক প্রদানকৃত মৌলিক অধিকার আর্টিকেল- ৩১,৩২,৩৬ এর লঙ্ঘন হয় ,যা গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর আর্টিকেল-১০২ অনুসারে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট “হ্যাবিয়াস কর্পাস” (Habeas Corpus)দায়ের করার মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়া যাবে।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান আর্টিকেল-৩১ এ আইনের সুরক্ষা উপভোগ করা এবং আইন অনুযায়ী বিবেচিত হওয়ার কথা বলা হয়েছে যা প্রত্যেক নাগরিকের অবিচ্ছেদ্য (Inalienable)অধিকার হিসেবে গন্য করা হয়েছে।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান আর্টিকেল-৩২ এ জীবন (Life) ও ব্যক্তি স্বাধীনতা (Personal Liberty) অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান আর্টিকেল-৩৬ এ প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে চলাফেরা (Freedom of Movement) করার অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
“হ্যাবিয়াস কর্পাস” (Habeas Corpus) অর্থাৎ ব্যক্তি কে আদালতের সামনে হাজির করা হোক ।অবৈধভাবে কোন ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত করা হলে “হ্যাবিয়াস কর্পাস” (Habeas Corpus) রিটের মাধ্যমে প্রতিকার পাবে। এটি কারাগার বা ব্যক্তিগত হেফাজতে(Private Custody) বে-আইনী ও অযৌক্তিক আটকের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার একটি প্রক্রিয়া।
হাইকোর্ট বিভাগে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এর আর্টিকেল-১০২ অনুসারে রিট “হ্যাবিয়াস কর্পাস” (Habeas Corpus)দায়ের করা হলে, যদি বিজ্ঞ আদালত আবেদনে প্রাথমিকভাবে (Prima Facie) সন্তুষ্ট হন,তাহলে বিজ্ঞ আদালত আটককৃত ব্যক্তির মুক্তির উদ্দেশ্যে একটি রুল জারি করবেন ।
এইভাবেই শ্বশুর বাড়ী কর্তৃক আটককৃ স্ত্রী কে সহজেই মুক্ত করা যাবে।
লেখক: শিক্ষানবীশ আইনজীবী,ঢাকা জজ কোর্ট; শিক্ষার্থী, মাস্টার্স অব হিউম্যান রাইট্স, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।