খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ) নির্মলেন্দু দাশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবীকে ভর্ৎসনা করেছেন হাইকোর্ট।
আজ মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চের তলবে হাজির হয়ে তিন আইনজীবীর নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
অপর দুই আইনজীবী হলেন- অ্যাডভোকেট শেখ নাজমুল হোসেন ও অ্যাডভোকেট শেখ আশরাফ আলী পাপ্পু।
আদালতে আইনজীবীদের পক্ষে ছিলেন সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন ফকির, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা, বার কাউন্সিল সদস্য রবিউল আলম বুদু, সুপ্রিম কোর্ট বার সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল, অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি। সাথে ছিলেন অ্যাডভোকেট রিনা পারভীন মিমি, সেগুফতা তাবাসসুম ও সাইফুল বাহার মজুমদার।
শুনানির শুরুতে খুলনা বার সভাপতিসহ তিন আইনজীবীর পক্ষে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির।
এসময় আদালত সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতিকে প্রশ্ন রেখে বলেন, কোনো সভ্য লোক কি বিচারকের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করতে পারে? তিনি কি বার সভাপতি হয়ে আদালতে দাপট দেখাচ্ছেন। আপনারা কেন এসব মানুষের পক্ষ নিয়ে আদালতে আসেন? আপনারা ডিফেন্ড করতে আসলে আমরা বিব্রত হই। মানুষ কতটা নিচু হলে বিচারকের সঙ্গে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করতে পারে।
এসময় খুলনা বার সভাপতিকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, আপনি শুধু আইনজীবী সমাজের কলঙ্ক না, আপনি খুলনার কলঙ্ক। আপনি কি নিজেকে খুলনার মহানায়ক মনে করেন।
তখন খুলনা বার সভাপতি বলেন, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি নিঃশর্ত ক্ষমা চাইছি। আমাকে মাফ করে দেন।
এসময় জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, আমরা লজ্জিত তাদের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাইছি। তিনি বলেন, এটা সত্যি অভিযোগ পড়তে লজ্জা লাগে। রেপ ভিকটিমের জবানবন্দির মতো মনে হয়।
আদালত বলেন, আইনজীবীরা যদি আদালতের সঙ্গে এ রকম আচরণ করেন তাহলে আদালত, বার কিছুই থাকবে না। তারা ক্রিমিনাল অফেন্স করেছে।
এসময় তিন আইনজীবীর পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নূর দুলাল, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা, অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি, অ্যাডভোকেট রবিউল আলম বুদু আদালতকে বলেন, এবারের মতো ক্ষমা করে দেন। আর কখনও এমন হবে না।
তখন আদালত বলেন, যারা আদালত অবমাননা করে, বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে আপনারা তাদের পক্ষে নিয়ে আসবেন না। তাদের আশ্রয় দেবেন না। আপনারা তাদের পক্ষে দাঁড়ালে ভুল ম্যাসেজ যায়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলেন, এবারের মতো ক্ষমা করে দেন। আমরা দায়িত্ব নিয়ে বলছি আর কখনও এমন ভুল হবে না।
তখন আদালত বলেন, আপনারা ভুল করেননি। অপরাধ করেছেন।
এসময় আদালত খুলনার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট শেখ আশরাফ আলী পাপ্পুকে ডায়াসের সামনে ডাকেন।
তাকে আদালত বলেন, আপনি এর আগে কি করতেন ? তখন তিনি বলেন, ব্যবসা করতাম। আদালত বলেন, আপনার আচরণ আইনজীবীর মতো না। বিচারকের সঙ্গে খারাপ আচরণের ক্ষেত্রেও আপনি মেইন রোল প্লে করেছেন। আপনাদের মতো ব্যবসায়ীরা এসে আইন পেশাকে নষ্ট করে দিচ্ছেন। খুলনার আরেক আইনজীবী শেখ নাজমুল হোসেনকেও ভর্ৎসনা করেন হাইকোর্ট।
এর আগে খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ) নির্মলেন্দু দাশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবীকে তলব করেন হাইকোর্ট।
গত ১ নভেম্বর বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেন আদালত। আজ ২২ নভেম্বর তাদের হাজির হয়ে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
সেদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর খুলনা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের সাবেক বিচারক (বর্তমানে যুগ্ম জেলা জজ) নির্মলেন্দু দাশের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের ঘটনায় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলামসহ তিন আইনজীবী বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়ে প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দেওয়া হয়।
চিঠির একাংশে বলা হয়, গত ২ সেপ্টেম্বর একটি মোকদ্দমায় আইনজীবী পিযুষ কান্তি দত্ত জেরা করছিলেন। সে সময় খুলনা জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম, শেখ আশরাফ আলী পাপ্পু, শেখ নাজমুল হোসেন, জেসমিন পারভিন, এম এম সাজ্জাদ আলী, এস এম তারিক মাহমুদ তারা (সাধারণ সম্পাদক), সুস্মিতা, সাদিক সাদ, মিল্টন বাগচী, রাজুসহ একাধিক আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে আদালত কক্ষে প্রবেশ করেন এবং সামনে দাঁড়িয়ে গুঞ্জন করতে থাকেন।
তখন বিচারক বলেন, ‘আপনারা বসেন’। কিন্তু তারা তার কথায় কর্নপাত না করে তাদের মতো গুঞ্জন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বারের সভাপতি সাইফুল ইসলাম কৈফিয়ত তলবের সুরে বলেন, ‘আমরা একটা মোকদ্দমায় উভয়পক্ষ সময়ের দরখাস্ত করেছিলাম, আপনি সেই দরখাস্ত না-মঞ্জুর করেছেন। এরপর জিপি সাহেব হাতে লেখা দরখাস্ত দিয়েছেন। তারপর সাক্ষী হয়েছে। পরে আমরা সময়ের দরখাস্ত দিলে নেওয়া হয়নি। কেন নেওয়া হয়নি এবং সময়ের দরখাস্ত কেন না-মঞ্জুর করলেন, আমাকে বলতে হবে।
এসময় বিচারক বলেন, “সভাপতি সাহেব আপনি এভাবে আমার কাছে জানতে চাইতে পারেন?” উনি বলেন, “কিভাবে পারি। কোনভাবে জানব, বলেন।” বিচারক বলেন, “আপনি আমার কাছে সময়ের আবেদন করছেন। আমি না-মঞ্জুর করছি। আদেশে কারণ দেখে নিবেন। কিন্তু আপনি আমার কাছে এখন কৈফিয়ত তলব করলে তো হবে না।”
তখন তিনি (উক্ত আইনজীবী) বলেন, “কৈফিয়ত চাচ্ছি তো। কারণ আপনি যখন টাকা নিয়ে, ঘুষ নিয়ে অবৈধভাবে সিদ্ধান্ত দেন, সেটার তো জবাব আমরা চাই না।” তিনি আবার বলেন, “আপনি টাকা নিয়ে, ঘুষ নিয়ে বে-আইনীভাবে কাজ করে…, তিনি (সংশ্লিষ্ট বিচারক) বলেন, “না না, এভাবে বলতে পারেন না।” উক্ত আইনজীবী ধমক দিয়ে বলেন, “দাঁড়ান আপনি।” তখন তার সাথে থাকা আইনজীবীগণ ধমকা-ধমকি করেন।
সাইফুল ইসলাম বলেন, “আপনাকে দরখাস্ত নেবেন কিনা মানে কি? এখানে রাষ্ট্রপক্ষ বলতেছে, আমরা বলতেছি, আপনি নেবেন না কেন।” বিচারক বলেন, “দরখাস্ত তো নেওয়া হয়েছে। দরখাস্ত শুনানী করে না-মঞ্জুর হয়েছে।
সাইফুল ইসলাম বলেন, “কেন, আপনি কি মনে করেন, আপনি এই খুলনা অঞ্চলের শাসক হয়েছেন। আপনার ইচ্ছামত চলবে কোর্ট, তাই নাকি। আপনি মনে করেন নাকি। বিচারক বলেন, “না না, কোর্ট আইনানুযায়ী চলবে।”
তিনি বলেন, “আপনি কোর্ট আইনানুযায়ী চালান না আপনি। আপনি অসৎ মানুষ, ঘুষখোর মানুষ, দুর্নীতিবাজ মানুষ, আপনি আমাদের উপর ৪০/৫০ হাজার মামলা দিয়ে খুলনা অঞ্চলের মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে রাখছেন। আইনজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, “আপনি কত শক্তিশালী, আমরা দেখতে চাই।
অভিযোগ পাওয়ার পর গত ২৫ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তা নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে পাঠিয়ে দেন।