ফাঁকা স্ট্যাম্পকে বায়না দলিল বানিয়ে সেই দলিল দেখিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করায় মামলার বাদীকে এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন রাজশাহীর একটি আদালত। একইসঙ্গে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করায় চারজন আসামির প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ এর ম্যাজিস্ট্রেট মারুফ আল্লাম বুধবার (২৩ নভেম্বর) এই আদেশ দেন ।
দণ্ডিত বাদী হলেন আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ঝলমলিয়া গ্রামের সামছুদ্দিন সরকারের ছেলে।
পার্শ্ববর্তী কামার ধাদাস গ্রামের হাজেরার বিরুদ্ধে তিনি মামলায় অভিযোগ করেন, তার কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে হাজেরা বায়না দলিল করেন কিন্তু পরে বায়নার শর্ত ভঙ্গ করে ভিন্ন ব্যক্তিকে জমির দলিল করে দেন।
তবে আদালতের কাছে সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে স্পষ্ট হয় যে, আসামি হাজেরা মূলত আবু বক্কর সিদ্দিকের কাছে জমি বন্ধক রেখেছিলেন এবং কয়েক বছর পরে বন্ধকি জমির ওপর অতিরিক্ত কিছু টাকা নিয়েছিলেন। আসামি হাজেরা অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার সময় আবু বক্করকে ফাঁকা স্ট্যাম্প দিতে বাধ্য হন। আবু বক্করের আশা ছিল জমিটি একসময় তার কাছেই হাজেরা বিক্রি করে দেবেন।
কিন্তু পরে হাজেরা ওই জমি আবু বক্করের কাছে বিক্রি না করে জনৈক সাজেদুর রহমানের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে দেন। সাজেদুর রহমান জমি কেনার আগে হাজেরার সব ঋণ আবু বক্করকে পরিশোধ করে দেন।
এদিকে হাজেরা অন্যত্র জমি বিক্রি করায় আবু বক্কর ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকেন। হাজেরার কাছ থেকে নেয়া ফাঁকা স্ট্যাম্পকে এবার তিনি বায়নানামা হিসেবে পরিণত করে হাজেরার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দেন। সঙ্গে হাজেরার স্বামী হযরত আলী, ছেলে আল আমীন ও ভাই আব্বাস মোল্লাকেও এই মামলায় জড়িয়ে দেন আবু বক্কর।
মামলাটিতে আবু বক্করের পক্ষে তার চার ভাই সাক্ষী দিতে আদালতে আসেন। কিন্তু আদালতের জিজ্ঞাসাবাদে তারা বলেন, বাস্তবে বায়নার নামে কোনো টাকাপয়সাই বাদী-আসামির মধ্যে লেনদেন হয়নি। তারা আরও স্বীকার করেন, জমির ওপর হাজেরা যত টাকা নিয়েছিলেন, সেই টাকা পরিশোধ হয়ে গেছে।
সাজানো এই মিথ্যা মামলা থেকে হাজেরা ও তার স্বজনদের খালাস দেন আদালত। একইসঙ্গে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করায় চারজন আসামির প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে আদালতের আদেশে।
রাজশাহীর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১ এর বেঞ্চ সহকারী মোঃ নজরুল ইসলাম ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, বিচার শেষে আদালতের কাছে বাদীর অভিযোগ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক প্রতীয়মান হয়। ফলে আদালত আসামিদের খালাস দিয়ে বাদীকেই এক মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। একই সঙ্গে চারজন আসামির প্রত্যেককে এক হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দেন।
আদালত তার আদেশে বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনা হলেও সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে দেখা যায়, বাদী আবু বক্করই বরং ফাঁকা স্ট্যাম্পকে বায়না দলিল হিসেবে পরিণত করে আসামি হাজেরা ও তার স্বজনদের হয়রানি করেছেন। বায়না দলিলটি তিন বছরের পুরাতন স্ট্যাম্পে লেখা। ফাঁকা স্ট্যাম্পগুলোর শেষ পাতার মাঝামাঝি জায়গায় আগেই হাজেরার স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
পরে ওই স্বাক্ষরের ওপরই বায়নানামা প্রিন্ট দেওয়া হলে দলিলের লেখার নিচে বেখাপ্পাভাবে হাজেরার স্বাক্ষর পড়ে যায়। বায়না দলিল আগে লিখে পরে হাজেরার স্বাক্ষর নেওয়া হলে এই অসঙ্গতি থাকত না। এছাড়াও জনৈক আফজালকে দলিললেখক হিসেবে এবং পিতা সামছুদ্দিনকে দলিলের সমন্বয়কারী হিসেবে দেখানো হলেও তাদেরকে সাক্ষী মান্য করেননি বাদী।
সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং উভয় পক্ষের বক্তব্য অনুসন্ধানে আদালতের কাছে স্পষ্ট হয়, বাদী আবু বক্করের কাছে আসামি হাজেরা জমি বিক্রি না করায় প্রতিশোধ হিসেবে বাদী এই মামলাটি করেছেন।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, এর আগে রায় ঘোষণার দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন না বাদী আবু বক্কর সিদ্দিক। ওইদিন আদালত তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক প্রমাণিত হওয়ায় আসামিদের প্রত্যেককে বাদী কেন ক্ষতিপূরণ প্রদান করবেন না এবং বাদীকে কেন মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের জন্য কারাদণ্ড প্রদান করা হবে না তা জানতে চান আদালত।
পরবর্তীতে বুধবার ধার্য তারিখে বাদী এক ব্যাখ্যা আদালতে দাখিল করেন, যা সন্তোষজনক না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কারাদণ্ড ও ক্ষতিপূরণের আদেশ দেন আদালত।