রেদওয়ান আহমেদ : অগ্রক্রয়ের অধিকার হচ্ছে কোন হস্তান্তরিত সম্পত্তি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত হওয়ার অধিকার। ইংরেজীতে যা রাইট অব প্রিয়েমশন এবং মুসলিম আইনে যা হক শূফা নামে পরিচিত। কোন জোত জমার মধ্যে আগন্তুক ব্যক্তির শরীক হিসাবে প্রবেশরোধ কল্পেই মূলত অগ্রক্রয় প্রথার উৎপত্তি। ভারতীয় উপমহাদেশে অগ্রক্রয় অধিকার সর্ব প্রথম মুসলিম আইনের মাধ্যমে মুসলিম শাসনামলে প্রচলন ঘটে। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলেও এর প্রচলন অব্যহত থাকে।
অগ্রক্রয়ের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য
অগ্রক্রয় হলো এমন একটি অধিকার যার মাধ্যমে কোন স্থাবর সম্পত্তি তার মালিক কর্তৃক যথাযত পন্থায় অন্য কোন ব্যক্তির নিকট বিক্রয় ও হস্তান্তরিত হওয়া স্বত্বেও যথাযথ মূল্য পরিশোধে সম্পত্তির ক্রেতা কে অগ্রক্রয়ের অধিকারী ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করতে বাধ্য করার অধিকার। একই জোত জমা ভুক্ত বা ওয়ারিশী সম্পত্তি গুলো যাতে উক্ত জোত জমা ভুক্ত শরীক বা ওয়ারিশদের নিকটেই বিক্রয় করা হয় এবং সম্পত্তি গুলো যাতে ক্ষুদ্র ক্ষু্দ্র অংশে বিভক্ত না হয় বা আগন্তুক ব্যক্তির আগমনে পূর্বে থেকে বসবাসরত শরীকদের শান্তিপূর্ন বসবাসে বিঘ্ন না ঘটে এইরুপ প্রভৃতি উদ্দেশ্যেই মূলত অগ্রক্রয় অধিকার প্রথার উৎপত্তি।
যখন অগ্রক্রয় অধিকারের উৎপত্তি হয়
অগ্রক্রয় অধিকার একটি স্থাবর সম্পত্তি সংক্রান্ত অধিকার। জোত জমার সহ শরিক ব্যতিত আগন্তুক ব্যক্তির নিকট স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় বা হস্তান্তরিত হলে সহ শরিক প্রজার অগ্রক্রয় অধিকার উৎপত্তি হয়। এক্ষেত্রে যেই দিন সম্পত্তি টি রেজিস্ট্রেশন এবং স্বত্ব হস্তান্তরিত হয় ঐদিনই অগ্রক্রয় দাবিদার ব্যক্তির অধিকার জন্মায়। তবে দান, ছদকা, ওয়াকফ, মিরাশ, উইল বা স্হায়ীভাবে ইজারা থেকে কারো অগ্রক্রয় অধিকার উৎপত্তি হয় না।
অগ্রক্রয় মামলার ধরণ
কৃষি এবং অকৃষি উভয় ধরণের সম্পত্তির ক্ষেত্রেই অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবি করে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশে ৪ ধরনের অগ্রক্রয় মামলা হয়ে থাকে। যেমন-
(১) কৃষি জমির ক্ষেত্রে- রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন এবং প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধন ২০০৬) ১৯৫০ এর ৯৬ ধারা অনুসারে অগ্রক্রয় মামলা।
(২) অকৃষি জমির ক্ষেত্রে- অকৃষি প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৪৯ এর ২৬ ধারায় অগ্রক্রয় মামলা ।
(৩) মুসলিম আইনের অধিন অগ্রক্রয় মামলা।
(৪) বন্টন আইনের ৪ ধারায় অভিভক্ত বাড়ীর সম্পত্তির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় মামলা।
এপর্বে আমরা কৃষি জমি অগ্রক্রয় মামলা সংক্রান্ত বিধানাবলি সবিস্তর অলোচনা করবো।
কৃষি জমির অগ্রক্রয়
কৃষি জমির ক্ষেত্রে দুই ভাবে অগ্রক্রয় অধিকার দাবী করে মামলা করা যায়-
(১) রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহন এবং প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধন ২০০৬) ১৯৫০ এর ৯৬ ধারা অনুসারে
(২) মুসলিম আইন অনুসারে
রাষ্ট্রিয় অধিগ্রহন এবং প্রজাস্বত্ব আইন এর ৯৬ ধারা অনুসারে কৃষি জমির ক্ষেত্রে যদি কোন রায়তের জমির কোন খন্ড বা অংশ অন্য কোন এক ব্যক্তির কাছে বিক্রয় করা হয় যিনি ঐ জমার শরীক প্রজা নয়, তবে ঐ জমার এক বা একাধিক শরীক প্রজাদের মধ্যে কেউ যদি উক্ত জমি খরিদ করতে ইচ্ছুক থাকে তবে বিক্রি পরবর্তী উক্ত আইনের ৮৯ ধারা অনুসারে জমার সহ শরীকগণের উপর নোটিশ প্রদানের ২ মাসের মধ্যে এবং যে ক্ষেত্রে নোটিশ প্রদান না করা হয় তবে উক্তরূপ বিক্রয় সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার তারিখ হতে ২ মাসের মধ্যে সহ শরীকদের মধ্যে যে কেউ আদালতের নিকট অগ্রক্রয় অধিকার দাবী করে মামলা করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে বিক্রয় সম্পর্কে জ্ঞাত হওয়ার পর ২ মাস সময় অবশ্যই দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার তারিখ হতে ৩ বছরের বেশি হবে না।
অপর দিকে মুসলিম আইন অনুসারে অগ্রক্রয় দাবীকৃত ভূমি বিক্রির সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অগ্রক্রয় দাবীদারকে তালাবি মসিবত অর্থাৎ উহা খরিদ করার ইচ্ছা প্রকাশ করতে হবে এবং তালাবি ইসসাদ অর্থাৎ উক্ত সম্পত্তির ক্রেতা বা বিক্রেতার সম্মুখে অথবা বিক্রিত সম্পত্তির উপর অন্তত দুইজন সাক্ষির সম্মুখে উক্ত সম্পত্তি তিনি ক্রয় করতে না পারায় তাহার বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়েছে মর্মে তৎক্ষণাৎ ঘোষণা করতে হবে। মুসলিম আইন অনুসারে অগ্রক্রয় অধিকার দাবির ক্ষেত্রে উপরোক্ত দুইটি শর্ত (তালাবি মসিবত এবং তালাবি ইসসাদ) যথাযত সময় সম্পন্ন করা হয়েছে মর্মে প্রমাণ করা জরুরী।
যারা অগ্রক্রয় অধিকার দাবী করতে পারবেন
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধন ২০০৬) ১৯৫০ এর ৯৬(১)ক ধারা অনুসারে কৃষি জমি অগ্রক্রয়ের দাবী করে শুধু মাত্র উক্ত জমার উত্তরাধিকার সূত্রে সহ শরীকগণ মামলা করতে পারবেন।
অপর দিকে মুসলিম আইনে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ শরীক ছাড়াও ক্রয়সূত্রে সহ শরীকগণ এবং সংলগ্ন ভূমির শরীকগণ অগ্রক্রয়ের দাবী করতে পারেন। এদের মধ্যে উত্তরাধিকার সূত্রে সহ শরীকগন প্রথমে অগ্রক্রয়ের অধিকারী হবেন। এর পর ক্রয়সূত্রে সহ শরীকগণ সংলগ্ন ভূমির শরীকগনের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবেন এবং সর্ব শেষ সংলগ্ন ভূমির শরীকগণ অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবী করে মামলা করতে পারবেন। কেউ একজন অগ্রক্রয়ের অধিকার দাবী করে মামলা করলে পরবর্তীতে একই শ্রেণিভুক্ত অন্য কোন সহ শরীক উক্ত মামলায় বাদী শ্রেণিভুক্ত হওয়ার আবেদন করতে পারবেন।
যাদেরকে মামলায় পক্ষ ভুক্ত করা জরুরী
অগ্রক্রয়ের অধিকারী ৩ শ্রেণির ব্যক্তি বর্গের মধ্যে ক্রমানুসারে যে কোন শ্রেনীর দাবীদার অগ্রক্রয়ের দাবী করে দেওয়ানী আদালতে মামলা করতে পারেন। অগ্রক্রয়ে মামলায় নিম্নক্তো ব্যক্তিবর্গ দের বিবাদী শ্রেণিভুক্ত করা আবশ্যক-
(১) অগ্রক্রয় দাবীকৃত সম্পত্তির দলিলের গ্রহীতা।
(২) উত্তরাধিকার সূত্রে অগ্রক্রয় দাবীর ক্ষেত্রে বাকী সকল উত্তরাধিকার সূত্রে সহ শরীক।
(৩) ক্রয় সূত্রে অগ্রক্রয় দাবীর ক্ষেত্রে সকল উত্তরাধিকার সূত্রে এবং ক্রয় সূত্রে সহ শরীক।
(৪) সংলগ্ন ভূমির মালিক সূত্রে অগ্রক্রয় দাবীর ক্ষেত্রে সকল উত্তরাধিকার সূত্রে, ক্রয় সূত্রে এবং সংলগ্ন ভূমির সহ শরীক।
অগ্রক্রয় মামলায় জমাকৃত অর্থের পরিমাণ
রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ এবং প্রজাস্বত্ব আইন (সংশোধন ২০০৬) ১৯৫০ এর ৯৬(৩) ধারা অনুসারে অগ্রক্রয় দাবীদার ব্যক্তিকে নিম্নরূপ তিন ধরণের টাকা আদালতে জমা দিতে হবে-
(১) অগ্রক্রয় দাবীকৃত দলিলে উল্যেখিত জমির মূল্য।
(২) উক্ত মুল্যের উপর শতকরা ২৫ টাকা হারে ক্ষতিপূরণ অর্থ।
(৩) দলিল রেজিস্ট্রি হওয়ার তারিখ হতে মামলা দায়েরের সময় পর্যন্ত উক্ত মূল্যের উপর বার্ষিক শতকরা ৮ টাকা হারে সুদ।
উপরোক্ত অর্থ মামলা দায়ের করা সময় অথবা আদালতের অনুমতি স্বাপেক্ষে পরবর্তী কোন দিনে আদালতে জমা দিতে হবে। এছাড়াও প্রথম ক্রেতা যদি জমি ক্রয়কৃত ভূমির কোন উন্নয়ন সাধন করেন বলে প্রমাণিত হয় তবে আদালত উক্ত উন্নয়ন বাবদ যেরূপ সমীচীন মনে করেন সেরুপ অর্থ অগ্রক্রয় দাবীদারকে আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।
অপর দিকে মুসলিম আইনে অগ্রক্রয় দাবীর ক্ষেত্রে ক্রেতা যেই অর্থের বিনিময় সংশ্লিষ্ঠ সম্পত্তি ক্রয় করেছিল অগ্রক্রয় দাবীদারকে সেই পরিমাণ অর্থ অথবা আদালত যেরূপ নির্দেশ দিবেন সেই পরিমান অর্থ ক্রেতাকে পরিশোধ করবেন।
আদালত কর্তৃক আবেদন মঞ্জুরের ফলাফল
সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে অগ্রক্রয়ের আবেদন মঞ্জুর হলে আদালত দলিল গ্রহীতার রেজিস্ট্রিকৃত দলিল আবেদনকারী অনুকূলে রেজিস্ট্রি করে দিবেন। এক্ষেত্রে আবেদনকারী কে রেজিস্ট্রেশন বাবদ কোন রাজস্ব বা সরকারী ফি প্রদান করতে হবেনা।
অগ্রক্রয়ের অধিকার বিলুপ্ত
নিন্মে উল্যেখিত ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তির অগ্রক্রয় দাবীর অধিকার বিলুপ্ত হবে-
(১) অগ্রক্রয় দাবীদারের সহ শরীক মর্যাদা শেষে হয়ে গেলে
(২) তামাদি আইনে উল্যেখিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অগ্রক্রয়ের আবেদন করতে ব্যর্থ হলে
(৩) বিক্রিত জমি পুনরায় বিক্রেতার নিকট হস্তান্তরিত হলে
লেখক : শিক্ষানবিশ আইনজীবী; জেলা ও দায়রা জজ আদালত, শরীয়তপুর।