সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০২২’ দেশের পাঁচজন নারী পাচ্ছেন। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এর মধ্যে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ বছর বেগম রোকেয়া পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন অ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম। বাকি চারজন হলেন- নারী শিক্ষায় অবদানের ক্ষেত্রে ফরিদপুরের রহিমা খাতুন, নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় সাতক্ষীরার ফরিদা ইয়াসমিন, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নারী জাগরণে অবদান রাখায় নড়াইলের ড. আফরোজা পারভীন এবং পল্লী উন্নয়নে অবদান রাখায় ঝিনাইদহের নাছিমা বেগম।
আগামী শুক্রবার (৯ ডিসেম্বর) বেগম রোকেয়া দিবস। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পাঁচ নারীকে এ সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।
বেগম রোকেয়া পদক-২০২২ এর জন্য মনোনীত নারীরা ওইদিন রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মাননা পদক বিতরণ করবেন।
পদকপ্রাপ্তরা ১৮ ক্যারেট মানের ২৫ গ্রাম সোনা দ্বারা নির্মিত একটি পদক, পদকের একটি রেপ্লিকা, নগদ চার লাখ টাকা এবং একটি সম্মাননাপত্র পাবেন।
কামরুন নাহার বেগমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
প্রবীণ মানবাধিকার কর্মী, সাবেক স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর ও বর্তমানে এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর (সরকারি আইন কর্মকর্তা), বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও কলামিস্ট অ্যাডভোকেট কামরুন নাহারের সুনাম আইন আদালত ও মানবাধিকার অঙ্গনে সর্বজনবিদিত।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কামরুন নাহার বেগম চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া থানার অন্তর্গত খানমোহনা গ্রামের সম্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মোহাম্মদ আবদুল মালেক এবং মাতার নাম রাবেয়া খানম।
পটিয়ার গ্রামে বাড়ীতে কামরুন নাহার বেগম প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তিনি ১৯৭০ সালে গভ: ইন্টারমেডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি চ.বি ১৯৭৬ ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বি এস এ এবং ১৯৮০ সালে বিএড কলেজ থেকে ১ম শ্রেণিতে বিএড ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম আইন কলেজ থেকে এলএল.বি ডিগ্রী লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
একাত্তরের দিনগুলোতে অন্ধকারে নিপতিত হয়েছিলেন তিনি ও তাঁর পরিবার। হানাদারদের আক্রমণের কারণে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন তো হারিয়েই গিয়েছিল। তবে দেশ স্বাধীনের পর নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। তাঁর ছোট ভাইও মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
তাদের বাড়ির অদূরে খুরুশিয়া পাহাড়ে মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ নিতো। যুদ্ধের প্রথমদিকে সুখবিলাস স্কুলে লঙ্গরখানা খুলেছিল। সেখানে বড় বড় ডেকচি দিয়ে রান্না করতে হতো। কোনো কোনো সময় ৫০ জনের জন্যও রান্না করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোর সাক্ষী কামরুন নাহার বেগম পাকিস্তানি সেনারা বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার পর পালিয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা। তাঁর ছেলে হাছান (বর্তমান তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ) ও এরশাদকে (মেজো ছেলে) নিয়ে পাহাড়ে থাকতে হয়েছিল।
তার স্বামী তখন কোনদিকে থাকতো জানতেন না। তিনি একাত্তরে যুদ্ধ করেছেন অস্ত্র হাতে। বন্দুক নিয়ে তিনি তাদেরকে পাহাড়ে দেখতে যেতেন। হাছান, এরশাদ তার সাথে ছিল।
যেদিন পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেদিনই তাঁর মেয়ের জন্ম হয়, সে এখন ডাক্তার। তেমন কাপড় ছিল না, কাঁথা ছিল না। আর্থিকভাবে গরীব মানুষ যেমন, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা। থামি কাপড় খুঁজে পরতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এমন অবস্থার মধ্যে দিয়ে তারা দিন পার করেছিলেন।
কর্মজীবন
পেশাগত জীবনের শুরুতে তিনি পদুয়া ডিগ্রী কলেজে বেশ কিছুদিন রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অধ্যাপনা করেন। ১৯৮৮ সালে আইন পেশায় যোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনি বিভাগীয় স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর দায়িত্ব পান। পরে জজ কোর্টের এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবেও নিয়োগ পান।
তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, নারী উন্নয়ন ও মানবাধিকারমূলক কর্মকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ মানবাধিকার এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান। তিনি নারী অধিকার এবং সমাজে নারীদের মর্যাদা সম্পর্কে স্থানীয় পত্রপত্রিকায় লিখে থাকেন এবং বিভিন্ন সময়ে টিভি-রেডিওতে নারী নির্যাতন এবং নারীদের অধিকার ও নারীসুরক্ষা সম্পর্কে আইনগত বক্তব্য রেখেছেন।
তিনি হিউম্যান রাইটস কমিশন চট্টগ্রাম ডিভিশনের প্রাক্তন ডিভিশনাল কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম জেলার হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি। তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট, চট্টগ্রাম রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা ইসলামী পাঠাগারের সদস্য, লেডিস ক্লাবের সদস্য, চট্টগ্রাম রোজ গার্ডেনের পি.পি।
রাজনীতি
ছাত্রী অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যকরী সদস্য, দক্ষিণ জেলা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ চট্টগ্রামের সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং জাতীয় পেশাজীবী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি।
রচিত বই ও সম্মাননা
‘তাঁর রচিত “নারী, মানবাধিকার ও বর্তমান সমাজ প্রেক্ষাপট”, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ এবং “আমার দেখা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ এবং এশিয়া ও ইউরোপের ১৩ টি দেশ ” বই ৩টি পড়লেই তাঁর জ্ঞানের গভীরতা অনুভব করা যায়।
মানবাধিকার কর্মকাণ্ডে বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি একাধিক পদক এবং সম্মাননাও লাভ করেন। প্রফেসর এ্যাডভোকেট কামরুন নাহার বেগম একজন সফল মানবাধিকার কর্মী হিসেবে ২০০০ সালে মানবাধিকার কমিশনের জাতীয় সম্মেলনে ‘ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস’ পদকে ভূষিত হন। দুস্থ নারী ও মহিলাদের সহায়তা দানের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রের বায়োলজিকেল ইন্সটিটিউট ২০০৩ সালে তাঁকে ‘ওম্যান অব দ্যা ইয়ার’ মনোনীত করে।
মানবিক কাজ
ঘরে বসে আয়েশি কিংবা ঘুরে বেড়িয়ে বিলাসী জীবন-যাপনের অবারিত দ্বার তাঁর সামনে। কিন্তু বৈষয়িক, জাগতিক এসব প্রাপ্তি, ভালো থাকা তাঁর খুব বেশি পছন্দ নয়। গরিব-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, তাদেরকে আইনী সহায়তাপ্রদান কিংবা মানবতা লঙ্ঘনের জায়গায় প্রতিবাদী ঝাণ্ডা হাতে লড়াই করার রক্ত যার শরীরে, দীক্ষা-শিক্ষা যে জীবনে; সে জীবনের কাছে লাভ-অলাভ, বিলাসব্যসন সবই তুচ্ছ, নস্যি।
তিনি রাংগুনিয়ায় সুখবিলাস গ্রামে স্বামীর বাড়ীর সামনে ১ কানি জমি মসজিদে দান করেন এবং নিকটস্থ বাঙ্গাল খালিয়ায় ১৭ লক্ষ টাকা ব্যয়ে দুই গন্ডার উপর একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ।
১৭ বৎসর আগেই হারিয়েছেন চলৎশক্তি। হাঁটেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কথা বলতে গেলে জড়িয়ে যায়। কিন্তু এসব কিছুই এক মুহূর্তের জন্য তাঁকে দমাতে পারেনি। ঝড়-তুফান, বৃষ্টিবাদল যাই আসুক- প্রতিদিন তিনি নির্দিষ্ট সময়ে ছুটে যান আদালতে।
নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখের গল্প শোনেন চেম্বারে বসে। জুনিয়রদের ইন্সট্রাকশন দিয়ে সাধ্যমত সমস্যাসঙ্কুল মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কখনো কখনো বিচারকের কক্ষে নিজেই ছোটেন গাউন পরে।
পরিবার
রাঙ্গুনিয়ার কৃতিসন্তান খ্যাতিমান আইনজীবী, ও আইন অঙ্গনের পুরোধা পুরুষ, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও দু’বারের জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর মরহুম আলহাজ্ব নুরুচ্ছফা তালুকদারের সহধর্মিণী। ৮০ বছর বয়সে তাঁর স্বামী মারা যান, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও আদালতে গিয়েছিলেন। নামকরা আইনজীবী ছিলেন। বিপদে-আপদে সবাই এসে ধরতেন ওনাকে, আদালতে না গিয়ে পারতেনই না। তিনি ভালো আইনজীবী ছিলেন।
আইনি সহায়তা পেতে ওনার চেম্বারে অনেক নারীও আসতেন। তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখে কামরুন নাহার ভাবতেন, আইনজীবী হলে তিনিও নিপীড়িত মেয়েদের পাশে দাঁড়াতেন। গরীব মানুষকে সাহায্য করতেন। পরে আইনজীবী হয়ে এখন তা করছেন। স্বামীর উৎসাহে আইন পেশায় আসেন তিনি।
তাঁর ৮ সন্তানের সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে ঋদ্ধ, প্রতিষ্ঠিত। স্বমহিমায় উজ্জ্বল। বড় ছেলে বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী। উচ্চশিক্ষিত মেজো ছেলে বিশাল মৎস্যখামারি, স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। তৃতীয় ছেলে শিপিং ব্যবসায়ী। ৪র্থ ছেলে বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর সেখানেই বসতি। কনিষ্ঠ ছেলে আন্তর্জাতিক পর্যটন ব্যবসায়ী। তিন কন্যার একজন চিকিৎসক, মেজ মেয়ে ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে এখন অস্ট্রেলিয়ায় কর্মরত এবং ছোট মেয়ে এলএল.এম করে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বার-এটল তে অধ্যয়নরত।