সিরাজ প্রামাণিক : আইন অনুযায়ী, সরকারী কর্মচারীর ক্ষমতা সর্বক্ষেত্রে নিরঙ্কুশ ও অবারিত নয়। খামখেয়ালীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগে আইন প্রতিরোধ মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। সম্প্রতি কাল্পনিক ঘটনা, গায়েবি মামলা ও স্বেচ্ছাচারিতাবশতঃ সরকারী কর্মচারীদের দ্বারা দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারার যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে।
সরকারি কর্মচারীকে তার কাজ সম্পাদনে বাধা দান কিংবা সরকারি কর্মচারীকে কর্তব্য সম্পাদনে বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণের বিষয়ে দন্ডবিধির ১৮৬ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সরকারি কর্মচারীদের সরকারি কার্যাবলি সম্পাদনে ইচ্ছাপূর্বক বাধা দান করে, তবে সেই ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা পাঁচশ টাকাসহ যেকোনো পরিমাণ অর্থদন্ডে অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
কিন্তু উচ্চ আদালত বলেছেন, দন্ডবিধির ১৮৬ ধারার অভিব্যক্তি অনুযায়ী বাধাটি অবশ্যই প্রত্যক্ষভাবে হওয়া প্রয়োজন। পরোক্ষভাবে বাধা দিলে এই ধারার আওতায় অপরাধ হবে না। এখানে বাধা বলতে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাধা দেয়াকে বুঝায়। (৯ ডিএলআর ৭৭, রাষ্ট্র বনাম ফজর আলী)।
তাছাড়া দন্ডবিধির ৩৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি এমন অন্য কোনো ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বা তার ওপর বলপ্রয়োগ করে, যে ব্যক্তি সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী হিসেবে কর্তব্য সম্পাদনরত অথবা অনুরূপ কর্মচারীকে তার সরকারি কর্মচারী হিসেবে করণীয় কর্তব্য সম্পাদনে বাধা দানের উদ্দেশ্যে তার ওপর অনুরূপ আক্রমণ বা অপরাধমূলক বপ্রয়োগ করে তিন বছর বা যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডে অথবা অর্থদন্ডে, এমনকি উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে।
ফলে সচরাচর সরকারি কাজে বাধা দান বা বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণ বলতে যা বোঝায় এবং বর্তমানে ওই দুটি ধারায় যে ধরনের গায়েবি মামলা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। কোনো ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে এভাবে কাল্পনিক কাহিনী সৃষ্টি করে মামলা দেয়া অনৈতিক। বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিস্ফোরক আইন, বে-আইনি সমাবেশ ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঙ্গা সংক্রান্ত দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারাসহ হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের ৩০৭ ধারার সঙ্গে দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারা যুক্ত করে মামলা দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।
জরিপে আসছে মামলাগুলো গায়েবি ও ভুতুড়ে। যেখানে এ ধরণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি সেখানে এ ধরনের মামলা দেয়া নিছক হয়রানি ছাড়া আর কিছু নয়। আর পুলিশ যদি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেই কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে যায় এবং বিপরীতে পুলিশের ওপর যদি কেউ বলপ্রয়োগ ও আক্রমণ করে তাহলে এ ধরনের মামলায় দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারার প্রয়োগ পুলিশের জন্য সহজ কাজ।
অনেক ক্ষেত্রে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) যে তারিখ, স্থান ও ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেই স্থানে কোনো ঘটনা দূরে থাক, পুলিশকে বাধা দান ও হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। অথচ পুলিশের কাজে বাধা দান বা বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণের বিষয়টি মামলার এফআইআর-এ উল্লেখ করা হচ্ছে। এমনকি এক যুগ আগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকেও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। তবে বিচারের গিয়ে এসব মামলার কোনরূপ অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
আমি নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি, সরকারি কর্মচারী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা সরকারি কর্মচারী আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধির লঙ্ঘন। পুলিশও সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন। পুলিশের জন্য আলাদা প্রবিধানও রয়েছে পিআরবি। পুলিশ যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাহলে তাদের জন্যও ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।
প্রতিটি আইনেরই প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ রয়েছে। আইন যেমন দরকার আছে তেমনি আইনের অপপ্রয়োগ হোক তা কোনো মানুষই চায় না। কিন্তু আইনের এ ধরনের অপপ্রয়োগ অনৈতিক ও বেআইনি। পুলিশের ক্ষমতা আছে বলেই এ ধরনের কাজ করা যায় না। এখন রাষ্ট্রশক্তি যদি আইনের অপপ্রয়োগ করে তখন প্রকৃতপক্ষে আদালতের কাছেই বিচার চাইতে হবে। উল্লেখিত ধারাগুলো জামিনযোগ্য নয়, এ কারণেই হয়তো এই ধারা প্রয়োগ করে বেশি করে মামলা দেয়া হচ্ছে। আসলে মামলা করার জন্য মামলা দেয়া হচ্ছে। এর কোনো আইনগত ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।
আইনশৃঙ্খলা বহিনী যদি ক্রমাগত মিথ্যাচার করে এবং ক্রমাগতভাবে জনগণের আস্থা হারায় তাহলে অবধারিত ফল হলো নিকট ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশঙ্কাজনক অবনতি। আর যে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের পরিবর্তে সরকারের বাহিনী হয়ে যায়, সেই সব দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না। কিন্তু কোথাও যদি আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে থাকে তাহলে এর জন্য আদালতে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। তবে কার ঘাড়ে কয়টি মাথা আছে জানতে ইচ্ছে করছে?
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ই-মেইল: seraj.pramanik@gmail.com